~ কলমে এলেবেলে চিরশ্রী ~
(কণা-কাহিনী : প্রথম পর্ব – এর পর। এখন অব্দি আমরা চিনেছি – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনকে। আলাপ হয়েছে প্রতি-কণা, মেসন, নিউট্রিনোর সাথেও। চার প্রকারের বল বা আন্তঃক্রিয়ার ধারণা করা গেছে। এরপর……)
এবারে আমরা চলে আসব ১৯৬৪ সালে। মার্কিন পদার্থবিদ মারে গেলম্যান এবং রাশিয়ান-মার্কিন জর্জ জুইগ স্বতন্ত্রভাবে প্রস্তাবনা দেন ‘কোয়ার্ক’ মডেলের। এই মডেল থেকে জানা গেল, নিউট্রন, প্রোটন, পায়ন এবং ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত অন্যান্য মেসনেরা আদৌ মৌলিক কণা নয়। এরা অন্য কোনো মৌলিক কণা ‘কোয়ার্ক’ ও তার প্রতি-কণা (অ্যান্টি -পার্টিকেল) ‘অ্যান্টি-কোয়ার্ক’-এর সমন্বয়ে গঠিত। উদাহরণ স্বরূপ, প্রোটন কণাটি আসলে তিনটি কোয়ার্ক কণার সমন্বয়ে তৈরি; দু’টি আপ এবং একটি ডাউন কোয়ার্কের সমষ্টি এটি। প্রথমে এরকম তিন ধরণের কোয়ার্কের কথা প্রস্তাবিত হল – ‘আপ’, ‘ডাউন’, এবং ‘স্ট্রেঞ্জ’ কোয়ার্ক। কিছুদিনের মধ্যেই ‘চার্ম’ নামে আরেক সদস্য কোয়ার্কদের দলে নাম লেখালো। ১৯৬৮ সালেই কোয়ার্কের অস্তিত্ব স্ট্যান্ডফোর্ডের ন্যাশানাল এক্সেলারেটর পরীক্ষাগারে (SLAC) ধরা পড়ল। শুরু হল কণাবিদ্যার জয়যাত্রা। বর্তমানে কোয়ার্ক পরিবারে আরো দুই সদস্য যোগ হয়েছে, ‘টপ’ এবং ‘বটম’ কোয়ার্ক। ১৯৯৫ সালে পরীক্ষায় পাওয়া ‘টপ’ কোয়ার্ক এখনো অব্দি আবিষ্কৃত সবথেকে ভারী মৌলিক কণা।
১৯৬২ সালে মারে গেলম্যানের তত্ত্বে দৃঢ় আন্তঃক্রিয়ার বাহক কণা – ‘গ্লুওন’ এর কথা উল্লিখিত হল। ইউকাওয়া যে বাহকের কথা ভেবেছিলেন পায়ন হিসেবে, এতদিনে জানা গেল, সেটি আসলে ‘গ্লুওন’ নামক একটি মৌলিক বাহক কণা। ১৯৭৯ সালে পরীক্ষাগারে পাওয়া গেল গ্লুওনকে। এর কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯৮৩ সালে আবিষ্কৃত হল মৃদু আন্তঃক্রিয়ার বাহক কণা W+, W- এবং Z বোসন। আমরা দেখতে পেলাম, মহাবিশ্বে থাকা চার রকম বল বা আন্তঃক্রিয়ার মধ্যে তিন ধরণের বলের বাহক কণার পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া গেল (ছবি – ক)। এখানে মনে রাখা দরকার, মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের পথে বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই চারটি আন্তঃক্রিয়া আসলে একই বলের বিভিন্ন রূপ। এই উদ্দেশ্যে মৃদু এবং তড়িৎ-চুম্বকীয় আন্তঃক্রিয়াকে মিলিয়ে তৈরি হল ‘ইলেক্ট্রো-উইক’ আন্তঃক্রিয়া। খানিকটা হলেও, দৃঢ় আন্তঃক্রিয়াকেও আনা গেল এক ছাদের তলায়। কিন্তু বাধ সাধলো মহাকর্ষ বল। আসলে, বাহক কণার ধারণা আসে কোয়ান্টামের তত্ত্ব থেকে। কিন্তু মহাকর্ষ বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব যে বাহক কণা ‘গ্রাভিটন’-এর অনুমান করে, তা এখনো পরীক্ষায় পাওয়া যায়নি। উপরন্তু, কণাদের আণুবীক্ষণিক দুনিয়ায় মহাকর্ষ বলের শক্তি এতটাই দুর্বল, তার কোনো প্রভাব কণাবিদ্যার পরিসরে আসবে না। তাই আপাতত মহাকর্ষ বল কণাবিদ্যার গল্পে ব্রাত্য।
একদল কণা মেনে চলবে ফের্মি এবং ডিরাকের প্রস্তাবিত FD পরিসংখ্যান, অন্যদেরকে মানতে হবে সত্যেন বোস এবং আইনস্টাইন প্রদত্ত BE পরিসংখ্যান।
তবে কণাবিদ্যার দুনিয়ার ফেরার আগে আরেকটা ছোট্ট তথ্য না জেনে নিলেই নয়। আজ অব্দি যত রকম কণা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আবিষ্কার হবে, কিছু পরিসংখ্যানের (স্ট্যাটিসটিকস্) উপর ভিত্তি করে তাদেরকে দু’টি দলে ভাগ করা যায়। একদল কণা মেনে চলবে ফের্মি এবং ডিরাকের প্রস্তাবিত FD পরিসংখ্যান, অন্যদেরকে মানতে হবে সত্যেন বোস এবং আইনস্টাইন প্রদত্ত BE পরিসংখ্যান। যারা FD পরিসংখ্যান মানবে, তারা ‘ফের্মিয়ন’। যারা BE পরিসংখ্যানের আদেশ মেনে চলবে তারা ‘বোসন’। একটু সহজ করে বোঝা যাক। ধরা যাক, দু’টো ট্রেন আছে। এদের মধ্যে একটা হল, রাজধানী এক্সপ্রেস। এই গাড়িতে এক একটা আসনে একজন করেই বসার অনুমতি আছে। এটা হল ফের্মিয়নদের গাড়ি। আরেকটা ধরা যাক, বনগাঁ লোকাল। এই ট্রেনে একটা আসনে বসা অনেকটা তেঁতুল পাতায় ন’জনের মতই। এই গাড়ির সদস্যরা হল বোসন। ষ্টেশনে দু’টোই গাড়ি। যেই আসুক না কেন, নিজের বৈশিষ্ট্য বুঝে ফের্মিয়নরা উঠবে রাজধানীতে, বোসনেরা বনগাঁ লোকালে। এর কোনও অন্যথা হবে না, তৃতীয় কোনো বিকল্পও নেই। উদাহরণ স্বরূপ, প্রোটন, নিউট্রন, নিউট্রিনো, ইলেকট্রন, পজিট্রনরা হল ‘ফের্মিয়ন’ পদবীধারী। অন্যদিকে, পায়ন ও অন্যান্য মেসন, ফোটন, গ্লুওন, মৃদু আন্তঃক্রিয়ার বাহক W এবং Z কণা হল ‘বোসন’। এদিকে, এক একটা কোয়ার্কও আবার নিজেরা ফের্মিয়ন। কিন্তু এদের দ্বারা তৈরি কণা ফের্মিয়ন বা বোসন, দু’টোই হতে পারে। সহজ ভাষায় বললে, কোয়ার্ক দ্বারা তৈরি ফের্মিয়নদের বলে ‘ব্যারিয়ন’ (যেমন, প্রোটন, নিউট্রন), আর বোসনদের বলে ‘মেসন’ (যেমন, পায়ন)। ঘেঁটে গেলে নিচের ছবিটা দেখুন (ছবি-খ)। তবে এটুুুুকু নিশ্চই বোধগম্য হল, মেসন বা ব্যারিয়ন, কেউই মৌলিক কণা নয়।
এবার ফিরে আসা যাক মৌলিক কণার দুনিয়ায়। আমরা কোয়ার্ক কাদেরকে বলি? তাদের কি কোনো বিশেষ ধর্ম আছে? সব মৌলিক কণাই কি কোয়ার্ক? একদমই তা নয়! মৌলিক কণার সংসারকে মূলত তাদের আন্তঃক্রিয়ার ভিত্তিতে দু’টি ভাগ করা হয়। ‘লেপ্টন’ এবং ‘কোয়ার্ক’। যে মৌলিক কণারা মৃদু এবং তড়িৎ-চুম্বকীয় আন্তঃক্রিয়ায় অংশ নেয়, তাদেরকে বলা হল ‘লেপ্টন’। এই কণারা দৃঢ় বলের দাদাগিরিতে অংশ নেয় না। যেমন, ইলেকট্রন, পজিট্রন, মিউওন, নিউট্রিনো প্রভৃতি কণা হল লেপ্টন। অন্যদিকে, পরমাণু কেন্দ্রকের মধ্যে থাকা যে কণাগুলো মৃদু, তড়িৎ- চুম্বকীয় আন্তঃক্রিয়ার পাশাপাশি দৃঢ় আন্তঃক্রিয়াতেও অংশ নেয় তারা হল কোয়ার্ক। অন্যভাবে বললে, কোয়ার্ক কণারা তিন রকম আন্তঃক্রিয়াতেই অংশ নিলেও, দৃঢ় আন্তঃক্রিয়া একমাত্র কোয়ার্কদের মধ্যেই সম্ভব।
এতক্ষণ যে বল বা আন্তঃক্রিয়া, এবং মৌলিক কণাগুলোর কথা বললাম, সত্তরের দশকে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী শেলডন গ্লাসো, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ এবং পাকিস্তানী পদার্থবিদ আব্দুস সালাম এগুলোকে এক ছাদের তলায় এনে তৈরী করেছিলেন কণাবিদ্যার “”স্ট্যান্ডার্ড মডেল””।
এতক্ষণ যে বল বা আন্তঃক্রিয়া, এবং মৌলিক কণাগুলোর কথা বললাম, সত্তরের দশকে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী শেলডন গ্লাসো, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ এবং পাকিস্তানী পদার্থবিদ আব্দুস সালাম এগুলোকে এক ছাদের তলায় এনে তৈরী করেছিলেন কণাবিদ্যার “”স্ট্যান্ডার্ড মডেল””। এই মডেলই প্রথম তাত্ত্বিক ভাবে W+, W-, Z বোসন এবং টপ কোয়ার্কের অস্তিত্বের উল্লেখ করে, যার আবিষ্কারের ইতিহাস আমরা একটু আগেই জেনে ফেলেছি। হিসেব মত এই মডেলেই তিন রকম আন্তঃক্রিয়া (আগেই বলেছিলাম, মহাকর্ষ বল কণার দুনিয়ায় গুরুত্বহীন) এবং কোয়ার্কদের সব রকম গুণাবলী পাওয়া সম্ভব। কিন্তু গণনা করে দেখা গেল, যে মৌলিক কণাদের কথা এতক্ষণ বললাম, এই মডেল অনুসারে সকলেই ভরহীন। এ আবার হয় নাকি! আমরা তো জানি, কোয়ার্কের ভর আছে, তাই কোয়ার্ক দ্বারা তৈরি ব্যারিয়ন, মেসনরাও ভরযুক্ত। অন্যদিকে ইলেকট্রন, পজিট্রন জাতীয় লেপ্টনেরাও ভরশূন্য নয়। অবশ্য, ১৯৬২-৬৩ সালের মধ্যে তিনটি গবেষণা দল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে একটি কণার অস্তিত্বের কথা নিজেদের তাত্ত্বিক গবেষণায় তুলে ধরেন, যা এই গুরুতর সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। এর মধ্যে একটি গবেষণাপত্র এককভাবে প্রকাশ করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস, যাঁর নামাঙ্কিত এই কণাটি। বাকি দু’টি গবেষণাদলের একটিতে ছিলেন ব্রাউট এবং এংলার্ট, অন্যটিতে তিন পদার্থবিদ গুরালনিক, কিবল এবং হেগেন। ২০১২ সালে, লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC) যন্ত্রে হিগস কণার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
কিন্তু কে এই হিগস কণা? এই ভারী কণাটি (যদিও এর ভর টপ কোয়ার্কের থেকে কম) আসলে ‘হিগস মেকানিজম’ নামক একটি পদ্ধতিতে বাকি কণাদের ভর প্রদান করে। এই কণার উপস্থিতির জন্যেই বাকি কণারা আমাদের কাছে ‘ভর বিশিষ্ট’ হিসেবে প্রতিভাত হয়। এই হিগস কণাটি আবার ‘বোসন’ পদবীধারী। তাই একে আমরা হিগস বোসন বলেই ডাকি।
যেহেতু বর্তমান গবেষণায় কণাবিদ্যার এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো দিতে পারেনি, তাই আমার গল্প আপাতত ফুরালেও কণাবিদ্যার নটেগাছটা এখনো মুড়ায়নি। সে এখনো বেড়ে চলেছে তরতর করে।
পুনশ্চ – এই হিগসই কি তাহলে সেই ‘ঈশ্বরকণা’? ২০১৩ সালের সংবাদপত্র যে ‘ঈশ্বর’এর খোঁজে ছেয়ে গিয়েছিল? ১৯৯৩ সালে মার্কিন পদার্থবিদ লিওন লেডেরমান এই কণাটিকে নিয়ে একটা বই লেখেন। এই কণাটা বিজ্ঞানীদের এমন ঘোল খাওয়াচ্ছে, উনি মজা করে কণাটার একটা ডাকনাম দিলেন – “”The Goddamn Particle”” । Goddamn-কে বাংলা করলে হবে ওই অনেকটা ‘ধুত্তোর!’ মার্কা। বইয়ের প্রকাশক দেখলেন, এরকম নামে বই ছাপা হলে ব্যাপারটা খুব একটা ভদ্রোচিত হবে না! তার বদলে ‘damn’ টুকু উড়িয়ে দিলেই লোকে ভাববে ‘গড’ বা ঈশ্বর, হু হু করে বিকোবে বই! দুঃখের কথা, শুধুমাত্র বিপণনের স্বার্থে হিগস কণা জনমানসে ঢুকে গেল ঈশ্বর-কণা হিসেবে, যার ফলস্বরূপ এটি ভুল ভাবে প্রচারিত হল বিভিন্ন মাধ্যমে। এই কণাটিকে নিয়ে বাংলার সংবাদপত্রগুলো আরো একটু ভুল বুঝে ফেললো। আগেই বলেছিলাম, যে কোনো কণা হয় ফের্মিয়ন পদবীধারী, অথবা বোসন পদবীধারী। এই বোসনের আবিষ্কার কর্তা হলেন আমাদের বাংলার সত্যেন্দ্রনাথ বোস। সোজা ভাবে বললে, আমাদের উদাহরণের বনগাঁ লোকালকে প্রথম চিনেছিলেন সত্যেন বোস এবং আইনস্টাইন। তাঁদের নামেই BE পরিসংখ্যান। কিন্তু তার সাথে হিগস আবিষ্কারের ততটাই সম্পর্ক, যতটা সম্পর্ক বনগাঁ লোকালে চড়া একজন যাত্রীর সঙ্গে ট্রেন বানানো প্রযুক্তিবিদের। বোস এই কণাটির খোঁজ জানতেন না, ঠিক যেমন ভাবে ট্রেনের প্রযুক্তিবিদ ট্রেনে ওঠা খগেনবাবুর খোঁজ রাখেন না। তাই হিগস কণাটির ‘বোসন’ পদবী দেখে সেই কণার প্রস্তাবনা ও খোঁজে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের অবদানকে জুড়ে দেওয়া আখেরে স্বনামধন্য বোসেরই অবমাননা।
এলেবেলে দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
এলেবেলে – Elebele