~ কলমে এলেবেলে চিরশ্রী ~
চলচ্চিত্রের ইচ্ছাধারী নাগ নাগিনীদের সঙ্গে আমরা সবাই অল্প বিস্তর পরিচিত। সেই নাগিনী, যে কখনো সাপ হয়ে ফোঁস করে ছোবল দেয় দুষ্টু লোককে, আবার কখনো সুন্দরী নায়িকা হয়ে গাছের ডাল ধরে গান গেয়ে বেড়ায়। যখন যেমন প্রয়োজন, তখন তেমন রূপ ধারণের ক্ষমতা এই নাগিনীর; যেন এক দ্বৈত সত্ত্বা। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে কি আদৌ এরকম দ্বৈত চরিত্রের খোঁজ পাওয়া সম্ভব? দেখা যাক, গত পর্বের “পথ দেখানো আলো”র হাত ধরে আমরা সেই বিজ্ঞান ‘নাগিনী’র খোঁজ পাই কিনা!
এই যে আলোর সঙ্গে আমাদের এত পুরনো আলাপ, তাতে তো আমরা জেনেই গেছি যে ‘আলো’ একটি তরঙ্গ। আমরা এটাও জেনেছি যে, একটা তরঙ্গের কিছু বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে। আলোর যে প্রতিফলনের জন্য আমরা আশেপাশের জীব-জড়র দুনিয়াকে দেখতে পাই, তা আসলে আলোর তরঙ্গরূপেরই সাক্ষ্য প্রমান। এছাড়া, বালতির জলে পেন্সিলের অর্ধেকটা ডুবিয়ে রাখলে, ডুবন্ত অংশটা আলোর যে স্বভাবের জন্য বাঁকা দেখতে লাগে, সেই প্রতিসরণও (ছবি ‘ক’) কিন্তু তরঙ্গেরই চরিত্রগত ধর্ম। তবে প্রতিফলন বা প্রতিসরণই শুধু নয়, একটা তরঙ্গ বা তরঙ্গ গুচ্ছ আরো কিছু মজাদার কান্ড কারখানা ঘটিয়ে থাকে। এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল তরঙ্গের অপবর্তন (ডিফ্রাকশন) (ছবি ‘খ’) । একটা তরঙ্গ যখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি মাত্রার (ডাইমেনশন) কোনো ফাঁক-ফোকর অথবা কোনও অভেদ্য দেওয়ালের একদম ধার ঘেঁষে বেরিয়ে যায়, তখন তরঙ্গগুলোর বিন্যাসের কারসাজিতে আমরা বিভিন্ন রকমের জ্যামিতিক আদল (প্যাটার্ন) পেতে পারি (ছবি ‘গ’)। উল্টোভাবে বললে, যদি কোথাও আমরা এই জ্যামিতিক আদল খুঁজে পাই, তখনি আমাদের পক্ষে তাকে তরঙ্গের অস্তিত্বের প্রমান হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া সম্ভব। তবে সে গল্পে আসছি একটু পরে। তার আগে গত পর্বের মতই আমরা আরো একবার ঊনবিংশ শতকে ফিরে যাব।
আমরা এখন পৌঁছে গেছি ১৮৮৬-৮৭ সালের এক গবেষণাগারে। ততক্ষণে সেখানে জার্মান পদার্থবিদ হেইনরিক হারৎজ তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্বের সত্যতা হাতেনাতে প্রমান করে ফেলেছেন। এই তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্বটির (ক্লাসিকাল ইলেক্ট্রোডিনামিক্স) ভিত কিন্তু আবার বিজ্ঞানের সনাতনী ধারণার উপর নির্ভরশীল। এই সময়েই তিনি অন্য একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনাও দেখতে পেলেন। হারৎজের যন্ত্রে যে ভাবে তড়িৎ প্রবাহ হওয়া উচিৎ, যন্ত্রটির একটি অংশে (তড়িৎদ্বার) উচ্চ শক্তিবিশিষ্ট অতিবেগুনি রশ্মি ফেলা হলে, এই তড়িৎ প্রবাহের তারতম্য ঘটে যায়। কিন্তু আবার কৃষ্ণবস্তুর অঙ্কটার মতই এখানেও বিজ্ঞানের সনাতনী ধারণা এই পর্যবেক্ষণের উপযুক্ত উত্তর দিতে পারলো না। এভাবেই পরবর্তী দুই দশক কেটে গেল এই ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা পেতে। আমরাও বেশ কয়েকটা ক্যালেন্ডার টপকে চলে এলাম নতুন শতকে। ১৯০৫ সাল তখন। আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি তত্ত্ব আমাদের বুঝিয়ে দিল যে, সেদিনের হারৎজের পরীক্ষা ইতিহাসে এক খুবই বিরল ঘটনা, যেখানে একই সঙ্গে সনাতনী তত্ত্বের প্রমানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্যও সলতে পাকানো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কি ভাবে? কোনো বস্তুর উপর উচ্চ শক্তি বিশিষ্ট তড়িৎ-চুম্বকীয় ‘আলো’ এসে পড়লে তার থেকে ঋণাত্মক আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রন কণা বেরিয়ে আসে, যা আদতে হারৎজের যন্ত্রে তড়িৎপ্রবাহের তারতম্যের কারণ। এই ঘটনাকে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া (ফটো – ইলেকট্রিক এফেক্ট) বলা হয় (ছবি ‘ঘ’)। এই ক্রিয়ায় তরঙ্গটির সমস্ত শক্তি শোষণ করে বস্তটির পরমানুর একদম ভিতরের দিকে থাকা একটি ইলেকট্রন কণা পরমানুর অভ্যন্তরীণ আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই ঘটনাটাও একটা রুদ্ধশ্বাস ছায়াছবির গল্পের মতই। এক দুঁদে আসামী, গারদের নিরাপদ প্রহরায় ঘানি টানে রোজ। পালানোর পথ নেই। একদিন হঠাৎ তার হাতে চলে আসে কিছু টাকা। সেই টাকার খানিকটা খরচ করে প্রহরীদের ঘুমের বড়ি সহ চপ সিঙ্গারা খাইয়ে গারদের বাইরে আসে এবং বাকী টাকা নিজের পকেটে পুরে একদম চম্পট। এখানে ইলেকট্রনটিও ওই দাগী আসামীটির মত পরমাণুর প্রহরা থেকে বেরোতে কিছুটা শক্তি খরচ করে, তারপর বাকি শক্তি নিয়ে ছুট লাগায়। এই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য আইনস্টাইন ম্যাক্স প্লাঙ্কের দেখানো শক্তির সংজ্ঞা (E = প্লাঙ্ক ধ্রুবক X কম্পাঙ্ক) ব্যবহার করলেন (আগের পর্বের মইয়ের গল্পটা মনে আছে নিশ্চই)। শুধু এর পেছনে থাকা তত্ত্বটা একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পেলেন তিনি।
সেটা কি রকম? এতক্ষণ আমরা তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণকে একটা তরঙ্গের মত দেখছিলাম, অনেকটা জলের মধ্যে ঢিল ছুঁড়লে যে ভাবে জলের তরঙ্গকে আমরা চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে দেখি। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, এই E পরিমান শক্তিটি তরঙ্গের মতো বিকিরিত হচ্ছে না। বরং খুবই ছোট আয়তনের একটা জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হচ্ছে এই শক্তিটি। সহজ ভাষায় বললে, এই E পরিমান শক্তিটি একটা থলি বা প্যাকেটের মধ্যে আবদ্ধ, যাকে এখন আমরা একটা কণার মত করে ভাবতে পারি। অনেকটা, একটা পাথরকে এক জায়গা থেকে ছুঁড়ে অন্য জায়গায় পাঠানোর মতোই, এই পুঞ্জীভূত শক্তির থলিগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবে। মজার বিষয় এই যে, সব থলিগুলোই আলোর বেগে চলাচল করবে। আমরা এখন থেকে এই শক্তিবাহী থলিগুলোকে ‘ফোটন’ কণা বলে ডাকব। তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের কণারূপই হল এই ফোটন।
এর বেশ কিছুকাল পরে ১৯২৩ সালে, মার্কিন বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন ইলেকট্রনের সঙ্গে ফোটনের সংঘর্ষ সংক্রান্ত একটি পরীক্ষা করলেন। সাধারণত দুটো বস্তুর (বা কণা) একে অপরের সাথে সংঘাত হলে, সেই টক্কর বলবিদ্যার কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলে। যেমন, সংঘাতের আগে ও পরে বস্তু দুটোর সমষ্টিগত ভরবেগ (ভর এবং গতিবেগের গুণফল) এবং শক্তি সবসময় সংরক্ষিত থাকবে। কম্পটনের পরীক্ষার ফল এই বলবিদ্যার নিয়মগুলোকে মেনে নিল। এই ফল অনুযায়ী, কম্পটনের পরীক্ষায় দু’টি কণা বা বস্তুর উপস্থিত থাকার কথা। আর ইলেকট্রন যে একটি কণা তা তো আমরা আগে থেকেই জানি। তাহলে এই সিদ্ধান্তে তো পৌঁছানোই যায় যে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী আর এক সদস্য ফোটনও কণার মতই আচরণ করছে। পরবর্তী কালে আমরা অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও তরঙ্গের এই কণাধর্মের সন্ধান পাব।
এতক্ষণ আমরা যা দেখলাম তাতে এটুকু বোঝা গেছে যে, যাকে আমরা এতদিন শুধুমাত্র তরঙ্গ বলেই চিনেছিলাম, সে কণারূপেও আত্মপ্রকাশ করতে পারে। অনেকটা সেই নাগিনী কন্যার মতই। উদাহরণ স্বরূপ প্রতিফলন, প্রতিসরণ, অপবর্তন প্রভৃতি ক্রিয়ায় আমরা যে তড়িৎ-চুম্বকীয় আলোর তরঙ্গরূপ দেখতে পাই, সেই আলোই আলোকতড়িৎ ক্রিয়া, কম্পটনের পরীক্ষায় ফোটন কণা রূপে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু উল্টোটাও কি তাহলে সম্ভব? কোনো বস্তু বা কণাও কি তাহলে তরঙ্গের মত আচরণ করতে পারে ?
১৯২৪ সাল তখন। ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রয় নিজের পি.এইচ.ডি গবেষণাপত্রে প্রথম উল্লেখ করলেন কণার তরঙ্গধর্মের কথা। প্লাঙ্ক এবং আইনস্টাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ব্রয় বললেন, ঠিক যেমন ভাবে আলো তরঙ্গ ও কণার দ্বৈত চরিত্রে আমদের সামনে আবির্ভূত হতে পারে, তেমনি একটি গতিশীল কণাও তরঙ্গের মত আচরণ করতে সক্ষম। দ্য ব্রয় দেখালেন, ভরবেগ (বস্তু বা কণাচরিত্রের একটা ধর্ম) এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য (এটি তরঙ্গ চরিত্রের ধর্ম ) একে অপরের সাথে ব্যাস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয়। দ্য ব্রয়-এর সমীকরণটিতে আবার আমরা পূর্ব পরিচিত প্লাঙ্ক ধ্রুবককে দেখতে পেলাম। একই দশকে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিসন এবং জার্মার ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিক(পরবর্তী কালে বেল ল্যাবরেটরি নাম পরিচিত) পরীক্ষাগারে ইলেকট্রনকে নিয়ে একটি পরীক্ষা করছিলেন। সেই পরীক্ষায় এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া গেল, যা একমাত্র অপবর্তন (ডিফ্রাকশন) ক্রিয়াতেই পাওয়া সম্ভব। আর আমরা তো আগেই দেখেছি যে এই কান্ডটির জন্য একমাত্র তরঙ্গধর্মই দায়ী। ডেভিসন ও জার্মারের এই পরীক্ষাটি দ্য ব্রয়-এর কণার তরঙ্গধর্ম (ম্যাটার ওয়েভ) বিষয়ক তত্ত্বের সত্যতা যাচাই করলো। একই সত্য উদ্ঘাটিত হল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জর্জ থমসন এর একটি স্বতন্ত্র পরীক্ষায়।
কিন্তু তারপর ? কোয়ান্টামের গল্প কি এই দ্বৈত চরিত্রের খোঁজেই থেমে গেল? নাকি সবে শুরু হল কোয়ান্টামের পথচলা?
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।