~ কলমে রণিতা জানা ~
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আসুন আমরা জেনে নিই গ্যালাক্সি বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি। আমাদের সৌরজগৎ যে গ্যালাক্সির অন্তর্গত তার নাম আকাশগঙ্গা। শহরের থেকে অনেক দূরে মেঘহীন আকাশে আমাদের অনেকের খালি চোখে ছায়াপথ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। একটা একটা করে ইঁট গেঁথে যেমন একটা বিরাট ইমারত তৈরি হয়, তেমনই আমাদের ছায়াপথের মত অজস্র গ্যালাক্সির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই মহাবিশ্ব। এই গ্যালাক্সিগুলি আসলে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে একসাথে থাকা অনেক গ্যাস আর ধূলিকণার সমষ্টি যার মধ্যে তারাদের জন্ম হয়। এছাড়াও গ্যালাক্সির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ডার্ক ম্যাটার। গ্যালাক্সিগুলোর বাইরে যে ফাঁকা জায়গা, সাধারণ দূরবীনে চোখ রেখে দেখলে সাধারণ ভাবে যা অন্ধকার দেখায়, তাকেই অনেক সময় মহাশূন্য বলা হয়। কিন্তু আসলে এটা কোন শূন্যস্থান নয়। এখানে আছে ভীষণ কম ঘনত্বের এক গ্যাসীয় মাধ্যম যা গ্যালাক্সির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই গ্যাসীয় মাধ্যম সম্পর্কেই আজ আমরা জানব।
একটা সময় ছিল যখন সবাই মনে করত আকাশগঙ্গাই আমাদের বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের শেষ সীমানা। কিন্তু Hubble deep field survey থেকে আমরা আজ জানি যে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কয়েক কোটি গ্যালাক্সি আছে। এই সমস্ত গ্যালাক্সি কিন্তু একই রকম দেখতে নয়। আমরা যদি আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের আশেপাশের গ্যালাক্সিগুলোকে লক্ষ করি তাহলে দেখব কিছু গ্যালাক্সি আছে যেগুলো দেখতে অনেকটা আমাদের ভাত খাওয়ার প্লেট এর মত, চ্যাপ্টা। তার কেন্দ্রে আছে একটা গোলাকার অংশ আর তাকে ঘিরে অনেক সর্পিল হাতের মত জিনিস, যেগুলোকে বলা হয় spiral arms। আর এই ধরণের গ্যালাক্সিকে বলা হয় স্পাইরাল গ্যালাক্সি। আমাদের আকাশগঙ্গাও একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি। এ ধরণের গ্যালাক্সির সর্পিল হাতগুলোই আসলে তারাদের আঁতুড়ঘর। তাই টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখলে এই সর্পিল হাতগুলো নীল রঙের দেখায় যা সেখানে অনেক নতুন তারার উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও আমরা কিছু গ্যালাক্সি দেখি যেগুলোকে দেখতে অনেকটা রাগবি বলের মত। এই গ্যালাক্সিগুলোতে নতুন তারার জন্ম হয়না। জ্বালানী শেষ হয়ে আসা বয়স্ক তারার সমষ্টি বলে এই গ্যালাক্সিগুলো টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখলে লালচে দেখায়। এদের বলি আমরা elliptical গ্যালাক্সি। এছাড়াও আছে এমন কিছু গ্যালাক্সি যাদের কোন নির্দিষ্ট আকার নেই যেমন আমাদের দুই প্রতিবেশী, Large Magellanic Cloud এবং Small Magellanic Cloud। এদের বলা হয় Irregular গ্যালাক্সি। এখন যদি আমরা আমাদের আকাশগঙ্গাকে পেছনে ফেলে মহাবিশ্বের আরও গভীরে চোখ মেলি তাহলে দেখব যে এই Irregular galaxy-র সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। গভীরে চোখ মেলার অর্থ হল সময়ের গতির বিপরীতে দেখা এবং এভাবে আমরা যদি মহাবিশ্বের প্রথম গ্যালাক্সি তৈরির সময়ে পৌঁছে যাই তাহলে হয়ত দেখব যে প্রথম গ্যালাক্সিগুলো আর কিছুই না, অনির্দিষ্ট আকারের কিছু ধুলো আর গ্যাসের মেঘ, যার মধ্যে তারাদের জন্ম হচ্ছে। এত কথা বলার উদ্দেশ্য এটাই, যে গ্যালাক্সিদের আকার এবং তার মধ্যে তারাদের জন্মের হার নির্দিষ্ট নয়, সময়ের সাথে সাথে তা বদলায়। কিন্তু কীভাবে? গ্যালাক্সিগুলোর নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে এধরণের পরিবর্তন হতে পারে। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। আমরা জানি যে আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমাগত আয়তনে বাড়ছে এবং গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এই বৃহৎ ছবি থেকে আমরা যদি সরে আসি, তাহলে দেখব যে মহাবিশ্বের কোন কোন অংশে আবার স্থানীয়ভাবে গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে। এরকম ভাবে দুটো স্পাইরাল গ্যালাক্সির সংঘর্ষে তৈরি হতে পারে একটি বৃহৎ elliptical গ্যালাক্সি। আবার গ্যালাক্সি ও তার আশেপাশের গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলেও গ্যালাক্সির মধ্যে অনেক রকম পরিবর্তন আসতে পারে।
কিন্তু গ্যালাক্সির পারিপার্শ্বিক গ্যাসীয় মাধ্যম মানে আমরা ঠিক কি বুঝি? আমাদের ছায়াপথের কথাই ধরা যাক। ছায়াপথের চাকতির মত চ্যাপ্টা অংশটিকে ঘিরে আছে একটি গোলাকার গ্যাসের বলয় যাকে আমরা বলি গ্যালাক্সির পরিবেষ্টক মাধ্যম (Circumgalactic medium)। এখানে গ্যাসের ঘনত্ব খুব কম, তাপমাত্রা খুব বেশি। গ্যালাক্সিকে পরিবেষ্টন করে থাকা এই মাধ্যমে গ্যাসের গড় ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ১০০০ টি কণার সমান। কণা বলতে এখানে অণু, পরমাণু, আয়নিত কনা সবই বোঝায়। মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়েই এই গ্যাসীয় মাধ্যম তৈরি বটে, কিন্তু এ ছাড়াও এখানে থাকতে পারে অন্যান্য ধাতু যেমন কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি। মনে হতেই পারে হঠাৎ কার্বনকে কেন ধাতু বলছি আমি, জ্যোতির্পদার্থবিদ-রা অনেক জিনিসেরই অদ্ভুত নামকরণ করে থাকেন, তার মধ্যে এই ব্যাপারটি অন্যতম। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ছাড়া বাকি সমস্ত মৌলই আমাদের কাছে ধাতু নামে পরিচিত। তো যাই হোক, এই যে ছায়াপথের পরিবেষ্টক মাধ্যম, এখানে গ্যাসের তাপমাত্রা সাধারণত কয়েকশো হাজার কেলভিন বা তারও বেশি হতে পারে। আবার এই মাধ্যমেরই কিছু কিছু অংশে তাপমাত্রা বেশ কম, কয়েকশো কেলভিনও হতে পারে। এ তো গেল গ্যাল্যাক্সিকে একদম পরিবেষ্টন করে থাকা গোলাকার বলয়ের কথা। তারও বাইরে আছে আরও কম ঘনত্বের এক মাধ্যম, যার নাম আন্তঃগ্যালাক্সি মাধ্যম (Intergalactic medium)। মহাবিশ্বের সর্বব্যাপী এই মাধ্যম বিভিন্ন গ্যালাক্সির মাঝের ফাঁকগুলো ভরাট করে, তাই তার এমন নাম। এখানে গ্যাসের গড় ঘনত্ব আরও কম, প্রতি ঘনমিটারে একটি কণার সমান, আর গড় তাপমাত্রা থাকে দশ হাজার কেলভিন এর কাছাকাছি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই দুটি গ্যাসীয় মাধ্যমের ঘনত্ব এত কম (সমুদ্রপৃষ্ঠে আমাদেরকে ঘিরে থাকা বাতাস এর ১০^-৩০ গুণ) হওয়া সত্ত্বেও এদের নিয়ে আমাদের এত মাথা ব্যাথা কেন! আমাদের চারপাশে থাকা বাতাস এত ঘন হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেবল খুব জোরে হাওয়া দিলে বা ঝড় উঠলেই এর অস্তিত্ত্ব টের পাই। সেখানে তার চেয়ে এত কম ঘনত্ব যুক্ত এই দুই মাধ্যম কি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ? দেখা যাক। সাধারণ ম্যাটার (যে ম্যাটার বা পদার্থ আমরা সাধারণ ভাবে আমাদের চারপাশে দেখি), ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি এই নিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব তৈরি, তার মধ্যে সাধারণ ম্যাটার মাত্র ৫%। এই সাধারণ ম্যাটার এর মাত্র ১০% পাওয়া যায় গ্যালাক্সি এবং গ্যালাক্সি মন্ডলীর মধ্যে, বাকি ৯০% ছড়িয়ে আছে এই গ্যালাক্সিকে ঘিরে থাকা গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্যে। তাই ঘনত্বের দিক থেকে নগণ্য মনে হলেও আসলে এই গ্যাসীয় মাধ্যম এর মধ্যেই সিংহভাগ সাধারণ ম্যাটার লুকিয়ে আছে।
এখন এই যে গ্যাসীয় মাধ্যম, তা কি আদৌ গ্যালাক্সিগুলোর উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে? যদি পারেও, সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কি কোনো পর্যবেক্ষণ সম্ভব? বিজ্ঞানীদের বহু বছরের চেষ্টায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দু’ধরণের প্রমাণই জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের সৌরজগৎ থেকে ১২ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি গ্যালাক্সি, মেসিয়ার ৮২, যেখানে তারাদের জন্মের হার আমাদের ছায়াপথের ১০ গুণ। বিজ্ঞানীরা সেই গ্যালাক্সির ছবি তুলেছেন বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে। সেই ছবিতে গ্যালাক্সিটির কেন্দ্র থেকে একটি ফানেল আকৃতির অংশের মধ্যে দিয়ে বাইরের দিকে গ্যাসের নির্গমন ঘটতে দেখা গেছে, ঠিক যেন চিমনির মত। গ্যালাক্সির তারাদের মধ্যে যে পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম ও অন্যান্য মৌল তৈরি হয়, সেই বিক্রিয়ার ফলেই উৎপন্ন হওয়া বিপুল পরিমাণ শক্তি এই বহির্মুখী গ্যাসের চালিকা শক্তি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় খুব ভারী তারার জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়ার পর ঘটা সুপারনোভা বিস্ফোরণের শক্তি। এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবে গ্যালাক্সি থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস বাইরের দিকে নির্গত হয়। একেই আমরা গ্যালাক্সির বহিঃপ্রবাহ (galactic outflow) বলে থাকি। গ্যাসের এই বহির্মুখী গতির জন্য গ্যালাক্সির মধ্যে নতুন তারা তৈরির জন্য যে প্রয়োজনীয় গ্যাস, তার পরিমাণ কমতে থাকে। তাই আমরা আমাদের আশেপাশে যে গ্যালাক্সিগুলো দেখি তাদের মধ্যে তারার জন্মের হার যা হওয়ার কথা তার থেকে অনেক কম (~১%) হারে গ্যালাক্সিগুলিতে তারার জন্ম হয়।
গ্যালাক্সিতে গ্যাসের যে শুধু বহির্মুখী গতি আছে, তা নয়, গ্যালাক্সির পরিবেষ্টক মাধ্যম ও আন্তঃ গ্যালাক্সি মাধ্যম থেকে গ্যাসের অন্তর্মুখী প্রবাহের পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে। মূলত গ্যালাক্সিতে থাকা আণবিক গ্যাস থেকেই তারাদের জন্ম হয়। আমাদের আশেপাশের গ্যালাক্সিগুলোতে এই গ্যাস নিঃশেষ হওয়ার সময়ের (মোট আণবিক গ্যাসের পরিমাণকে তারাদের জন্মের হার দিয়ে ভাগ করে) যদি আমরা একটা পরিমাপ করি তাহলে দেখব এই সময়সীমা মাত্র ১ বিলিয়ন বছরের কাছাকাছি। অন্যদিকে গ্যালাক্সিগুলি তৈরি হতে শুরু করেছিল আজ থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে। এর থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তেই আসতে পারি যে গ্যালাক্সিতে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও থেকে গ্যাসের যোগান আসছে নয়ত আমরা আজ কোন গ্যালাক্সিই দেখতাম না যেখানে তারাদের জন্ম হচ্ছে, অনেক আগেই গ্যালাক্সিগুলোর আণবিক গ্যাসের ভান্ডার শেষ হয়ে যেত। গ্যাসের এই বিকল্প উৎস আর অন্য কিছুই নয়, গ্যালাক্সির চারপাশের গ্যাসীয় মাধ্যম।
এই মাধ্যম তাই একাধারে তারাদের জন্মের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের উৎস, আবার তারাদের মৃত্যুর পরে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি এবং ধাতু মিশ্রিত গ্যাস উৎপন্ন হয় তাকে সংগ্রহ করার আধার। গ্যাসের এই চক্রাকার গতির সঙ্গে জলচক্রের অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। মেঘ সৃষ্টির জন্য নদী থেকে জল বাষ্পীভূত হয়ে উপরে ওঠে, আবার বৃষ্টি হয়ে সেই নদীতেই ঝরে পড়ে, সেই জল আবার বাষ্পে পরিণত হয়ে মেঘ সৃষ্টি করে। এই চক্রাকার গতি ক্রমাগত চলতে থাকে। একই রকম ভাবে, গ্যালাক্সিকে ঘিরে থাকা গ্যাসীয় মাধ্যম গ্যালাক্সির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে নতুন তারার জন্ম দেয়, আর সেই তারার মৃত্যুর পর আবার ফিরে যায় গ্যালাক্সির বাইরের গ্যাসীয় মাধ্যমে। সৃষ্টি ও ধ্বংসের এই খেলা চলতে থাকে প্রতিনিয়ত।
——————-