~ কলমে এলেবেলের অতিথি আগমনী পাঠক ~
(১)
‘উফফ, উফফ, হু , কি ঝাল!’ মৃদু স্বরে বলতে বলতে রিনি বাঁ হাতে গ্লাসটি হাতে নিয়ে জল খেল। খাসির মাংস দিয়ে ভাত আর তৃপ্তি করে খাওয়া হচ্ছে না, ওর মুখ ক্রমেই লাল হয়ে যাচ্ছে, এবার তো নাক চোখ দিয়ে জল চলে আসার জোগাড়। সামনের রাখা জলের গ্লাসও খালি হয়েগেছে দু দুবার!
সাজুর ছোটো ননদিনী, রিনি, সাজুর থেকে ছোটো, এই সবে মাধ্যমিক পাশ করেছে। সাজু রিনির এই অবস্থা দেখে চুপচাপ এক কাপ ঠান্ডা দুধ এনে রাখল। আর রিনিকে বলল, ‘খেয়ে নাও ঝাল কমে যাবে!’ নতুন বউ সাজু একটু লজ্জাবতী ঠিকই কিন্তু বোকা নয়।
রিনি সাজুর কথা মেনে দুধ খেতে খানিক স্বস্তি পেল।
***
দুপুরে সবাই যখন যে যার ঘরে বিশ্রামরত তখন সাজুর ঘরে রিনি গেল। সাজু একাই বসে ছিল, রিনি ঢুকেই সাজুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বৌদি, তুমি খুব ভালো! তখন আমার যা অবস্থা হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল সামনের মাংসের টুকরো গুলো রেখেই উঠে যাই। কিন্তু ইচ্ছাও করছিল না যে’
‘ও এই ব্যাপার! তা তুমিই বা ঢক ঢক করে জল কেন খাচ্ছিলে? দুধ বা অন্যকিছু চাইলেই তো হত!’
‘নাও, বোঝো ঠ্যালা। ঝাল লাগলে তো জলই খায়। এই তো জানি, দুধ তো আজ জানলাম’
‘হুম, রিনি জানো কি কেন তুমি আরাম পেলে?’
‘ঠান্ডা, তাই কি?’ রিনি উত্তর দিল।
‘না ঠান্ডার জন্য ঠিক না’
‘কী কারণ বৌদি?’
‘তবে শোনো, লঙ্কার মধ্যে ক্যাপসাইসিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এছাড়া ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন নামক রাসায়নিকও থাকে। এর মধ্যে ক্যাপসাইসিন যে লঙ্কায় যত বেশি থাকে, সেই লঙ্কা তত ঝাল হয়। এবার ক্যাপসাইসিন জলে মিশে বা গুলে বা দ্রবীভূত হয় না। ওটা দুধ জাতীয় তরলে দ্রবীভূত হয়’
‘কেন বৌদি, এমনটা হয়? নুন চিনি এরা তো দিব্যি জলে গুলে যায়। তাছাড়া আমি তো পড়েছি জল সার্বজনীন দ্রাবক, জৈব-অজৈব সবকিছুই দ্রবীভূত হতে পারে’
‘বাঃ রিনি, এই তো চাই। প্রশ্ন কর, জিজ্ঞাসু মনই বিজ্ঞানের ধারক বাহক। তুমি খুব ভালো প্রশ্ন করেছ। এই ব্যাপার বুঝতে হলে জানতে হবে ওই সব রাসায়নিকের নাম ও গঠন’ বলতে বলতে সাজু একটা খাতা আর পেন নিয়ে এল। তাতে কিছু রাসায়নিকের নাম আর গঠন লিখল।
আবার বলতে শুরু করল, ‘দেখো, এটা হল জলের অনু। এর দুটি অংশ’
‘হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন’ রিনি বলল।
‘হুম, তাহলে বল তো এই দুই অনুর মধ্যে কী পার্থক্য?’
রিনি একটু ভেবে বলল, ‘হাইড্রোজেন তড়িৎ ধনাত্মক মৌল আর অক্সিজেন তড়িৎ ঋণাত্মক’
আর কিছু বলতে পারবে রিনি?
‘আর কী?’
‘হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন এই তড়িৎ ধর্মের পার্থক্যের জন্য পোলারিটি বা মেরুকরণ সৃষ্টি হয়। ধর একটা কাঠি নিলি তার একদিকে একটা বড় বল আর অন্য প্রান্তে ছোটো বল লাগানো হল। তাহলে ওই কাঠিটাকে বলতে পারি বল দিয়ে মেরুকরণ হয়েছে। এই পোলারিটির জন্যই, জল একটি জৈব যৌগ তবুও এরমধ্যে আয়নীয় ধর্ম প্রকাশিত হয়’
রিনি বলল, ‘হুম, আচ্ছা’
‘দাঁড়াও আরও বলছি…এবার নুন অর্থাৎ সোডিয়াম ক্লোরাইড হল একটি আয়নীয় যৌগ। সোডিয়াম একটি পজিটিভ আয়ন ও ক্লোরাইড একটি নেগেটিভ আয়ন, এরা একেওপরের সাথে আকৃষ্ট হয়ে থাকে (ধনাত্মক ও ঋণাত্মক একে ওপরকে আকর্ষণ করলে যে বন্ধন তৈরি হয় সেটা আয়নীয় বন্ধন)। নুনকে জলে দেওয়া হলে সোডিয়ামের সাথে জলের অক্সিজেনের স্থিতিশীল সংস্পর্শ হয়, আর ক্লোরাইডের সাথে জলের হাইড্রোজেনের সাথে এই স্থিতিশীল সংস্পর্শে আসে। এই স্থিতিশীল সংস্পর্শের কারণেই নুন জলে দ্রবীভূত হয় বা মিশে যায়’
‘তাহলে চিনি কীভাবে মেশে? চিনি তো জৈব যৌগ’ আবার রিনি প্রশ্ন করল।
সাজু একটু হেসে বলল, ‘বুদ্ধিমতী রিনি, একটু ধৈর্য্য ধর। বলতে পারবে চিনির রাসায়নিক যৌগটির নাম?’
‘সুক্রোজ’
এবার সাজু সুক্রোজ আঁকল।
সুক্রোজে কোনও ধাতু নেই, সুক্রোজ শুধুমাত্র কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন এর সমন্বয়ে গঠিত। এটি আয়নীয় যৌগ নয় মোটেই। তাহলে?
‘সুক্রোজের অক্সিজেন – হাইড্রোজেন দুই মৌলের অবস্থানের জন্য এটিতে আংশিক আয়নীয় ধর্ম তৈরি হয়, সেই কারণেই দ্রবীভূত হয়। আরও পরিষ্কার করে বলতে হলে, বলতে হয়, কার্বন অক্সিজেনের তুলনামূলক আলোচনায় ফেললে কার্বন অক্সিজেনের তুলনায় অধিক তড়িৎ ধনাত্মক। কার্বন অক্সিজেন বন্ধনে কার্বন আংশিক তড়িৎ ধনাত্মক হয় আর অক্সিজেন আংশিক তড়িৎ ঋণাত্মক হয়। এইভাবে আংশিক আয়নীয় ধর্ম পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে এই সুক্রোজ অণুর মধ্যেও। এবার অক্সিজেন কার্বন থাকলেই হবে না, একটা নির্দিষ্ট অনুপাত থাকলে তবেই সেই কাঙ্খিত আংশিক আয়নীয় ধর্ম পরিস্ফুট হয় যাতে অণুটি জলে দ্রবীভূত হতে পারে। এই দ্রবীভুত হওয়ার ব্যাপারটা অনেকটা বন্ধুত্ব করার মত। ধর, তুমি একটা নতুন স্কুলে ভর্তি হলে, সেখানে তুমি তাদের সাথেই বন্ধুত্ব করবে যারা স্বভাবে তোমার মত, তোমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে। কিন্তু কোনওভাবেই তোমার কোনও গুণ বদলাতে চাইবে না তারা। কী তাই তো?’
‘হুম’
‘ভালো করে ভেবে দেখো বন্ধুত্ব আর দ্রবীভুত হওয়ার বিজ্ঞানের লজিক একই রকম। এবার আসি সেই ক্যাপসাইসিনের ব্যাপারে। ক্যাপসাইসিনও কার্বন , হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের জৈব যৌগ’ বলতে বলতে সাজু ওটা খাতায় এঁকে নিয়ে আবার বলল, ‘কার্বন-অক্সিজেন অনুপাত যথেষ্ট নয় যৌগের আংশিক আয়নীয় ধর্মের উৎপাদনের জন্য। সুতরাং এই যৌগ সম্পূর্ণভাবে সমযোজী (বিজ্ঞানের পরিভাষায় আয়নীয় নয় এমন যৌগকে সমযোজী বলে, আরও একটা ভাগ আছে সেটা পরে বলব)। জলে তাই এই যৌগ দ্রবীভূত হয়না। এই ধরনের যৌগকে জল বিকর্ষী বা হাইড্রোফোবিক বলা হয়। হাইড্রো মানে জল আর ফোবিক কথাটা ফোবিয়া থেকে এসেছে। যার অর্থ ভয়। অর্থাৎ ওই যৌগ গুলোর জলে ভয়। এর অন্য ভাগটি হল হাইড্রোফিলিক মানে যারা জল ভালবাসে। এই হাইড্রোফোবিক যৌগগুলো জলে নয় তেলে দ্রবীভূত হয়। তেল অর্থাৎ ফ্যাট। এবার বুঝলি কেন দুধ খাইয়েছিলাম’
‘হ্যাঁ, বুঝেছি। তাই জল খেলে ঝাল কমে না? আচ্ছা তেল খেলেও তো হয়!’
‘হা হা হা, তাহলে কি তোকে কুকিং ওয়েল খেতে দিতাম? এই যা তোমায় তুই বললাম’
‘হ্যাঁ, বউদিভাই তুমি তুইই বল। দুধে কী আছে?’
‘দুধ আসলে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ফ্যাটের একটা সুষম মিশ্রণ। তাই ক্যাপসাইসিন দুধে মিশে যায়। বুঝলি। এই হাইড্রোফোবিক আর ফিলিক এর রসায়নের আরও একটা ব্যবহার আছে, যা রোজ ব্যবহার করিস। জানিস সেটা?’
‘কী সেটা?’
‘এই যে সাবান, ডিটারজেন্ট এর ব্যবহার।’
‘বল না বৌদিদি, প্লিজ’
রিনির উত্তেজনায় জল ঢেলে,
‘রিনি রিনি ই ই, মাস্টার মশাই এসেছে , পড়ার ঘরে যা’ মায়ের ডাক শুনল।
রিনি জিভ কেটে বলল, ‘এই রে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি এখন আসি, কাল গল্প শুনব। তবে ওই মাস্টারকে আর আসতে হবে না, এরপর থেকে তোমার কাছেই রসায়ন পড়ব। কাল বলবে তো ওই গল্পটা?’
বলেই রিনি দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
রিনি তো বুঝেছে জলে ভয় নাকি তেলে! তোমরা / আপনারা কি বুঝলেন?
(২)
পরের দিন
রিনি আবার বসেছে সাজুর ঘরে…
‘ও বৌদিদি, আমি মাকে বলেছি তোমার কাছে পড়ব। মা তোমায় বললে তুমি রাজি হয়ে যেও প্লিজ’
‘কেন, তোর ওই মাস্টারমশাই তো ভালোই পড়ান। তাহলে? আর তাছাড়া ওনার ইনকামে হাত পড়ে যাবে তাই না?’
‘ধুর, ছাড় তো, বৌদিদি, উনি ভালো পড়ান। কিন্তু তোমার মত করে গল্প করে বোঝায় না’
‘আচ্ছা, উনি থাকুন, আমিও এক্সট্রা টিচার হই তোমার’
‘পরে হবে, তুমি ওই কাল যে বলবে বললে সাবানের ব্যাপার। ওটা বল’
‘তাই বরং বলি। আচ্ছা বলত ময়লা আসলে কী ? বা ওর প্রকৃতি কী?’
‘ময়লার প্রকৃতি? কঠিনও হয় তরলও হয়’
‘না ওটা তো হয়ই। আরও কিছু…’
রিনি একটু ভাবল… তবে সাজু বলল, ‘ময়লা হয় তেল জাতীয় হয় না হয় জলে দ্রবনীয় জাতীয় হয়’
‘তারপর?’
‘ধর, তোর ঘরে চুরি হয়েছে , তুই কাকে ডাকবি?’
‘পাড়াপড়শীকে চিল্লিয়ে ডাকব!’
‘হা হা, এবার ভাব ডাকাতি হয়েছে, তখন তুই পুলিশকে ডাকবি নিশ্চয়’
‘হ্যাঁ’
‘ঠিক সেইভাবে অপরাধ এর মাপকাঠি মেনে কখনও পুলিশ, কখনও গোয়েন্দা কখনও বা ইন্টারপোল। ঠিক সেইভাবে ময়লার প্রকার অনুযায়ী … মানে যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল লাগবে বুঝলি’
রিনির উৎসাহী মুখের দিকে তাকিয়ে সাজু আবার বলতে শুরু করল, ‘ময়লা যদি এমন হয় যা জলে গুলে যায় তা জল দিয়েই ধুয়ে ফেলা যায়। সমস্যা তখনই হয় যখন সেটা তেল জাতীয় হয়’
‘তেল জাতীয় মানে তেলে গুলে যাবে, তাই তো? তাহলে তেল দিয়ে ধুতে হবে?’ রিনি বলল।
‘তেল দিয়ে ধুলে, ধোয়ার জন্য ব্যবহার হওয়া তেলটা কীভাবে যাবে?’
‘তাই তো!’ রিনি ভেবে বলল।
‘তাহলে এমন কিছু লাগবে যা জলেও যাবে তেলেও যাবে!’
‘আরে, উভচর প্রানীর মত যে!’
একটু হেসে সম্মতি দিয়ে সাজু আবার বলল, ‘এই ধরনের যৌগগুলোকে লং চেন ফ্যাটি অ্যাসিড বলা হয়। এর দুটো অংশ মাথা আর লেজ। মাথার অংশটা জলআকর্ষী হয় আর লেজের অংশটা সাধারনত হাইড্রোকার্বন চেন অর্থাৎ হাইড্রোজেন ও কার্বনের দীর্ঘ শৃঙ্খল। সুতরাং…’
সাজুর কথা শেষ করতে না দিয়েই রিনি বলল, ‘অক্সিজেন নেই, তারমানে ওই লেজের অংশটা জল বিকর্ষী অর্থাৎ জলে ভয়’
‘বাঃ, রিনি সব মনে রেখেছিস তো! ওই ফ্যাটি অ্যাসিড গুলোই থাকে সাবান , ডিটারজেন্টে। এবার জলে দিলে ওই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোর অবস্থা হয় ‘না ঘর কা না ঘাট কা!’’
‘কীরকম?’
‘জল আকর্ষী অংশ জলে থাকতে চাইছে, জল বিকর্ষী অংশ জল থেকে পালাতে চাইছে। যাকে বলে পুরো টানাটানি কাণ্ড। তখন অন্যান্য অনুর জল বিকর্ষী অংশ একত্রে মিলে যায়, মিলে একটা গোলকের ন্যায় আকৃতি তৈরি করে, যার অভ্যন্তর অংশ জল বিকর্ষী আর গোলকের বাইরের দিকটা জল আকর্ষী। এই বিশেষ আকৃতিকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় মাইসেল বা মিসেল বলে। জলের মধ্যে সাবানের একটা নির্দিষ্ট পরিমাপ দিয়ে নাড়ালেই এইগুলো তৈরি হয়’
‘তারমানে ওই ফেনা গুলো?’
‘একদম ঠিক রিনি। ময়লা যদি জল বিকর্ষী হয় তাহলে ওই মাইসেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আর আকর্ষী হলে মাইসেলের বাইরে চড়ে বসে। এবার ওই ফেনা ধুয়ে দিলেই ময়লা সাফ’
‘আরে! বাঃ , বৌদিদি, দারুণ তো। সবই দেখি, শুধু জানতাম না। কিন্তু এই সাবান কিন্তু ‘দো ধারী তলবার’ যাকে বলে। পুলিশ , গোয়েন্দা সব’
সাজু হেসে ফেলে বলল, ‘ঠিক ঠিক’
কী বুঝলেন তো আপনারা? সাবানের কাছে ‘বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়’।
ও হ্যাঁ, ভাইরাসের আবরক একধরনের প্রোটিন, সেই প্রোটিনও সাবানের সংস্পর্শে মিশে যায়, তাই ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তাই সাবান দিয়ে হাতধুলে করোনার জুজু পটল তোলে। তাই সাবান দিয়ে হাত ধুতে ভুলবেন না যেন!
—————————–
আগমনী সেপ্টেম্বর ২০২০ অবধি জাপানের চিবা ইউনিভার্সিটিতে ন্যানো অ্যাডভান্স সিরামিকের রিসার্চে যুক্ত ছিলেন।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
এলেবেলে – Elebele