~ কলমে ড: অনুরাগ রায়
সূর্যালোক কেন্দ্রীভূতকরণের মাধ্যমে আমরা এক সাথে অনেকটা পরিমান আলো এক জায়গায় পাই। ঠিক যেমনটা ঘটে থাকে আয়না, লেন্স বা আতস কাঁচের মাধ্যমে। এক জায়গায় (ছোট জায়গায়) অনেকটা আলোকে একত্রিত করার পদদ্ধতিকে গাঢ় সৌরশক্তি (Concentrated Photovoltaics) বলা হয়। সূর্যালোকের এহেন গাঢ়ত্বের ফলে স্বল্প ক্ষেত্রফল যুক্ত সৌর প্যানেলগুলো প্রচুর সৌরশক্তি উৎপাদনে সক্ষম হয়। এর প্রাথমিক সুবিধা হল বেশি বড় আকার বা পরিসর বিশিষ্ট সৌরশক্তির প্যানেল তৈরি করতে হয়না, যার জন্য খরচ অনেকটাই কমে আবার অন্যদিকে সৌরপ্যানেলগুলির পরিচর্যা করার ও ঝামেলা থাকেনা। এছাড়াও, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় বেশি তড়িৎ উৎপাদন করার জন্য সৌর কোষগুলিকে আকারে বড় করা হয়।
সৌরকোষের প্যানেলগুলো বড় আকারের করার জন্য পর্যাপ্ত স্থানেরও প্রয়োজন হয়, আবার আকারে বড় হলে সৌরপ্যানেলে ব্যবহৃত বিভিন্ন যৌগ উপাদানের নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়! এই যেমন বেশি সিলিকন (Si) ব্যবহার হলে প্যানেলগুলো ভারী হয়ে পড়ে, কখনো বা ভঙ্গুর! সুতরাং, গাঢ় সৌরশক্তি হল এমন একটি উপায় যার মাধ্যমে আলোর সাধারণ প্রতিসরণ ও প্রতিফলন ধর্মের মাধ্যমে সহজেই কম স্থানে বেশি পরিমান সৌরশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব।
কিন্তু, এখানে আজ গল্প বলব কী করে প্রকৃতি নিজের থেকেই এই ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমরা প্রকৃতি থেকেই কি দারুন ভাবে সমস্ত ধারণা পাই যাকে সৌরশক্তি উৎপাদনে বাস্তবায়িত করাই আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য। বর্তমান বিশ্বে কার্বন নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ একটি মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— প্রতিটি দেশ পরিকল্পনা মাফিক একটি নির্দিষ্ট দিশাতে এগোচ্ছে, কী করে দ্রুত কমানো বা শুন্য করা যায় কার্বন নির্গমণ! তারই একটি সম্ভাব্য সমাধান-স্বরূপ প্রাকৃতিক শক্তিকে তড়িৎ বা জ্বালানি শক্তিতে বেছে নেওয়া আর এর জন্য যতটা সম্ভব কম উপাদান, স্বল্প খরচে, সহজ সরল প্রক্রিয়া, দূষণহীন এবং বিশেষ করে প্রাত্যহিক ঘটে চলা প্রাকৃতিক বিষয়ের থেকে ধারণা নিয়ে তাকে কাজে লাগানো! আর এই বিষয়ে আমরা বেছে নিয়েছি প্রজাপতির ডানাকে।
প্রজাপতি কোথায় পেলি ভাই এমন রঙ্গীন পাখা! নজরুলের গানের এই লাইনগুলো যেমন প্রকৃতির সাথে আমাদের মিশিয়ে দেয় ঠিক তেমন ই প্রশ্নও জাগায়, সত্যিই তো এমন সুন্দর রকমারি পাখা কী করে প্রজাপতি পেল! পাখা বা ডানা কী করে তৈরি হল সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছিনা, আরো এক ধাপ এগিয়ে এই ডানা থেকে কী করে আলোক বিজ্ঞানের সরল কৌশলে বেশি পরিমান সৌরশক্তি উৎপাদন সম্ভব তারই এক ঝলক এই লেখার বিষয়!
প্রজাপতির ডানা আসলে আশ্চর্যজনকভাবে জটিল আর এই গাঢ় সৌরশক্তি সম্পর্কে রীতিমতন তাক লাগিয়ে দেয়। কারণ প্রজাপতির শুধু জোড়া ডানা থাকে না, সেটি বিশ্রামের সময় এক প্রকার, আবার যখন ওড়ে তখন অন্যপ্রকারের বিন্যাসে থাকে। আর তাদের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে ডানার স্কেল কোষগুলিও নাটকীয়ভাবে বিভিন্ন বিন্যাস, সজ্জা দেখায়।নিচের চিত্র ১ক -তে লক্ষ্য করলে দেখবেন, প্রজাপতি যখন ওড়ে সাধারণত দু’টি ডানা সর্বোচ্চ নব্বই ডিগ্রী পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। আবার, বিশ্রামের সময় দু’টি ডানার অবস্থান হয় প্রায় কাছাকাছি, যেখানে সর্বনিম্ন সতেরো ডিগ্রি পর্যন্ত ডানা দুটির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। প্রজাপতির ডানার এরকম দুটি গঠনগত ও একই সাথে বিন্যাসগত অবস্থানের ফলে সূর্যালোক শোষণ ও ডানার মধ্যে সেই আলোক বিন্যাসের উল্লেখযোগ্য গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করা যায়। চিত্র ১ক -তে আরো লক্ষ্যণীয়, যখন প্রজাপতি উড়ছে মাত্র দশ সেকেন্ডেই প্রজাপতির পৃষ্ঠ দেশের তাপমাত্রা প্রায় ৪৫–৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি চলে যায়, যখন বিশ্রামে থাকছে তখন পৃষ্ঠ দেশের তাপমাত্রা প্রায় ৬০–৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। একই সাথে সম্পৃক্ত তাপমাত্রায় প্রথম ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই পৌঁছে যায়! এই ক্ষেত্রে বলা জরুরি, এই সূর্যালোক কিন্তু প্রাকৃতিক সূর্যালোক নয়, আমরা এই ক্ষেত্রে সোলার সিমুলেটর-এর সাহায্যে ডানার মধ্যে আলো ও তার প্রভাবে যে তাপমাত্রার সৃষ্টি হয় সেটি পর্যবেক্ষন করেছি। আমাদের সোলার সিমুলেটর ১০০ থেকে ৩০০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত সৌর বিকিরণ দেয়; সাধারণত এই পদ্ধতিতেই সৌরশক্তি প্যানেলগুলো কাজ করে। তাহলে দেখতে পারছেন, প্রজাপতির ডানার বিন্যাসের মাধ্যমে কত দ্রুত আলোক এবং তাপশক্তি একই সাথে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়— লেন্স বা আতশ কাঁচের প্রায় সমান কাজটাই প্রজাপতির ডানা করে। আর প্রজাপতির পৃষ্ঠদেশের বদলে যদি সেখানে কোনো সৌর কোষ রাখা যায়, তাহলেও একই ঘটনা ঘটবে। নিচের ১খ ছবিতে দেখলে বুঝতে পারবেন, সিলিকোন সৌর কোষগুলির তড়িৎ উৎপাদহন ক্ষমতা প্রায় চল্লিশ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি হতে পারে প্রজাপতির ডানার বিশ্রামের সময় যে বিন্যাস থাকে সেটির উপযোগে।
চিত্র ১। (ক) ইনফ্রারেড (IR) ক্যামেরাতে তোলা প্রজাপতির ডানার তাপমাত্রা নির্ণায়ক ছবি এবং (খ) সামগ্রিক কাজের ধারণা ও গাঢ় সৌরশক্তির মাধ্যমে সিলিকোন সৌরকোষের অধিক তড়িৎ শক্তি উৎপাদন ও তড়িৎ বিভব পার্থক্যের পরিমাপ চিত্রলেখ। ( চিত্রসূত্র: https://doi.org/10.1038/srep12267)
এছাড়াও আলোর প্রতিসরণ শুধুমাত্র ডানার বিন্যাস নয়, ডানায় অবস্থিত রঙ্গকের পরিমান, উপাদানের উপরও নির্ভরশীল। আমরা ডানার বিভিন্ন স্থানে সোলার সিমুলেটরের মাধ্যমে আলোকপাত করে লক্ষ্য করেছি, মোটের ওপর ডানার প্রতি অংশেই বাহ্যিক কোয়ান্টাম দক্ষতা (External Quantum Efficiency) প্রায় আশি শতাংশের ওপরে অর্থাৎ যা আলো পড়ছে তার প্রায় আশি শতাংশই মুক্ত ইলেক্ট্রন তৈরি করতে পারে। একই সাথে আমরা জানতে পারি, প্রায় ৩০০ থেকে ১২০০ ন্যানোমিটারের সুবিস্তৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্য এই বাহ্যিক কোয়ান্টাম দক্ষতা সূচককে প্রায় সমান ভাবেই ধরে রাখতে পারে (চিত্র ২)। অর্থাৎ সমস্ত রকম তরঙ্গদৈর্ঘ্যে একই সাথে প্রায় সমান ভাবে কার্যকরী মুক্ত ইলেক্ট্রন উৎপাদনে; যেটি সচরাচর খুব কম হয়, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই একই নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা স্বল্প সীমার তরঙ্গদৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ বাহ্যিক কোয়ান্টাম দক্ষতা দেয়।
চিত্র ২। ব্যবহৃত সাদা প্রজাপতির (Pieris rapae) ছবি প্রজাপতির ডানার আয়তন ও নির্ধারিত স্থানের বাহ্যিক কোয়ান্টাম দক্ষতা নির্ণয় ও আলোক বিকিরণের চিত্রলেখা। (চিত্রসূত্র: https://doi.org/10.1038/srep12267)
বলা বাহুল্য, বাহ্যিক কোয়ান্টাম দক্ষতা আর সৌরশক্তির দক্ষতা এক ব্যাপার নয়। বাহ্যিক কোয়ান্টাম দক্ষতা সৌরকোষকে ইলেক্ট্রন তৈরি করার ক্ষমতা যোগাবে, অন্যদিকে তৈরি হওয়া ইলেক্ট্রন সৌরকোষ কতটা মুক্ত রাখতে পারবে তার উপরি নির্ভর করছে সর্বোচ্চ তড়িৎ উৎপাদন। খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে, সৌরকোষের স্বল্প পরিসরে তড়িৎ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার অভিনব কৌশল হল এই গাঢ় সৌরশক্তি ধারণা। যেখানে প্রজাপতির ডানা খুব সহজভাবে ব্যবহার করা যায় আর সেটি প্রাকৃতিকও বটে! গাঢ় সৌরশক্তি ধারণার আরেকটার উপযোগিতা হচ্ছে সূর্যালোকের সমপরিমাণ বিস্তৃতি ও আবহাওয়া, বিশেষ করে মেঘলা দিনে বা ঠান্ডা জায়গায় আলোক বা তাপশক্তিকে কম স্থানে একত্রিত করতে এই ধারণার বিশেষ প্রয়োজন। অবশ্যই নবায়নযোগ্য শক্তি (সৌরশক্তি) উৎপাদনে আমাদের গবেষণার বিশেষ পদক্ষেপ।
বিস্তারিত আরো জানতে নেচার সাইন্টিফিক রিপোর্টে প্রকাশিত প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ করলাম!
———–
অনুরাগ রায় এক্সেটর বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড-এ পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কর্মরত।