~ কলমে এলেবেলের অতিথি প্রজিৎ সিংহ ~
জুলাই ১৯১৭। বেলজিয়ামের দক্ষিণ পশ্চিমের ছোট্ট শহর ইপ্রেস অনেকদিন আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গ্রটে মার্কট স্কোয়ারের চেনা ভিড় আর গাড়ির আওয়াজ আর নেই। শুধু মাঝেমধ্যে সাঁজোয়া গাড়ির যান্ত্রিক গর্জনের সাথে ভারী বুটের আঘাত মিশে একটা প্রাণ কাঁপানো আর্তনাদ মেনিন গেট ছেড়ে দূরে কোথাও মিলিয়ে যায়।
এক বছর আগে যখন সেনাদের হাতে গ্যাস মাস্ক আসা শুরু হয়নি সে সময় তো ইউরিয়া বা অ্যামোনিয়াতে চোবানো সুতির রুমালই ব্যবহার হতো।
নিজের জুতো আর মোজাটা শুকোতে দিয়েছিল এডমন্ড। কদিন আগেই বন্ধু ডেসপার্ডকে হারিয়েছে ও। গোলা গুলি খেয়ে মরেনি ছেলেটা, টেঞ্চ ফুট নিয়ে পাইরেক্সিয়ার জ্বরে ভুগে মরলো। প্রায় নীল হয়ে আসা পা দুটো দেখে ডাক্তার বলেছিল এতদিন ধরে এই স্যাঁতস্যাতে পরিখা আর পা ডোবা জলে ভিজে মোজা আর জুতো থেকেই সংক্রমণ হয়েছে। ভয় ওর মনেও ধরেছে, তাই ছাউনীতে বিশ্রামের সময়ে জুতোটা শুকোতে দেয়। দিনটা বড়ো মনোরম আজ, গ্রীষ্ম আসে এই সময়টাতে এখানে। মন চলে যায় নিজের দেশ ইংল্যান্ডে, ওখানেও তো গরম এখন। কার্টমেল-এর একটা শান্ত ছায়া ঘেরা ঘর, আর তার পাশে আইভিলতা আর স্নাপড্রাগনের ঝোপ। মাকে দেখেনি অনেকদিন, এই সময়টাতে হয়তো উল বুনছে বসে বসে। বাবা চলে যাবার পর ও লন্ডনে উইলসনের অফিসে একটা পিয়নের চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল কোনরকমে। কিন্তু যুদ্ধ এলো, সাথে চাকরিও গেলো। খবর পাওয়া গেলো সেনাবিভাগে লোক নেওয়া হচ্ছে, সাথে উচ্চতা আর ওজনের কড়াকড়িও কমেছে এখন। তাই তো কর্পোরাল হয়ে আজ দুইমাস এখানে পড়ে আছে । মনে মনে ভাবছে— যে পারুক জিতুক, কিন্তু যুদ্ধটা যেন শেষ হয় ভগবান, বাড়ি ফিরে এবছরে বড়দিনটা কাটাবো। চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায় একটা চিৎকারে— “”হাইকমান্ডের নির্দেশ, গ্যাস মাস্ক নিয়ে তৈরি হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়াও, যেকোনো মুহূর্তে জার্মানরা গ্যাস শেল দিয়ে হামলা চালাতে পারে।”” জুতোটা গলিয়ে রাইফেলটা বাগিয়ে নিলো এডমন্ড, মাস্কটা নিয়ে দেখলো গ্রেনেডগুলো ঠিক জায়গাতেই আছে। গ্যাস আক্রমণ তো প্রায়ই করে জার্মানরা, ব্রিটিশরাও জবাব ফিরিয়ে দেয়। যদিও এই পদ্ধতিটা একটু নতুন, সত্যি বলতে দু’বছর আগে জার্মানরা ফরাসিদের প্রায় ল্যাজে গোবরে করে ছেড়েছিল একটা সবুজ গ্যাস দিয়ে। সেবারই জার্মান সেনার স্পেশাল ইউনিট বড় আকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের শুরু করে প্রায় ছয় হাজার স্টিল সিলিন্ডারের ক্লোরিন ব্যবহার করে। তিন সপ্তাহ আগে থেকে জড়ো করে রাখা প্রায় ১৬০ টনেরও বেশি ক্লোরিন ১০ মিনিটের মাথায় ছড়িয়ে পড়েছিল ফরাসি ছাউনীগুলোর উপর। ফরাসিরা ভেবেছিল জার্মানরা হয়ত গ্যাসের আড়ালে লুকিয়ে হামলার ছক কষছে; তাই সেনাদের প্রায় সবাইকে সম্মুখভাগে মোতায়েন করেছিল। মারাত্মক ভুল ছিল ওটা, বুকে হেঁটে আসা সবুজ বিভীষিকা গিলে খেয়েছিল ১০০০-এরও বেশি ফরাসি সেনাকে। খবরের কাগজে বেঁচে ফেরা প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলেছিল তা মনে করে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল এডমন্ড। ওর কাছে তো মাস্ক আছে, গ্যাস ওর খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না, এক বছর আগে যখন সেনাদের হাতে গ্যাস মাস্ক আসা শুরু হয়নি সে সময় তো ইউরিয়া বা অ্যামোনিয়াতে চোবানো সুতির রুমালই ব্যবহার হতো। অ্যামোনিয়া নাকি ওই সবুজ গ্যাসের সাথে মিশে সাদা গুঁড়ো একটা লবণ বানায় যেটা গ্যাসের ক্ষমতা কমিয়ে দিত অনেকটাই। কিন্তু অ্যামোনিয়ার গন্ধ নেওয়ার থেকে দমবন্ধ হয়ে মরে যাওয়া ভালো। নিজের মনেই হেসে নিজেকে প্রবোধ দিল এডমন্ড। মন শান্ত হল না, শুধু পাটা কেঁপে উঠলো একটু।
গানপয়েন্টের সামনের আকাশ ধোঁয়ায় ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা প্রায়, আর তার মাঝেই গোলার আওয়াজে হঠাৎ করে কেঁপে উঠছে দিগ্বিদিক। পরিখাতে সবাই গাদাগাদি করে ঘাড়ের উপরে বসে সেনাধ্যক্ষের আদেশ পালন করছে। এডমন্ড নিজের জায়গাতেই ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে মাঝারি মাপের একটা গ্যাস শেল ছিটকে এসে পড়ল ওর পায়ের কাছে, মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ট্রেঞ্চে আরও কটা ছিটকে এলো। কয়েকটা হাল্কা পটকা ফাটার শব্দ, আর তারপরেই ধূসর রঙের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। চটপট মাস্কটা মুখে জড়াতে জড়াতে এডমন্ড একটা সর্ষের সস কি হর্সরেডিশের মত গন্ধ পেলো, এ গন্ধ তো ক্লোরিন এর নয়। সে যাই হোক, অত ভাবার সময় নেই এখন, চারদিকে “”গ্যাস, গ্যাস”” আর্তনাদের মাঝে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করলো ও…..
এডমন্ডের ঘুম ভেঙেছিল পরদিন দুপুরে, সারা শরীরে থাকা অসংখ্য পোড়া ঘায়ে আগুন জ্বলার অনুভূতি নিয়ে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছিল ৬-৭ দিন পর। সেবারে ওর সাথে ওর শিবিরের অনেকেরই আর বাড়ি ফেরা হয়নি। যারা ফিরেছিল তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ধীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মৃত্যু।
ভালো নাম বিস (২-ক্লোরো ইথাইল) সালফাইড, জার্মানরা তৈরি করার সময় নাম রেখেছিল “”লস্ট”” আর “”এস-লস্ট””।
গ্যাসটা কি? গবেষণা শুরু হল ব্রিটিশ আর ফরাসিদের রসায়নাগারে। জানাও গেল কিছু সময় পরে। দেখা গেলো এর আগেও উনিশ শতকের শেষ দিকেই রসায়নবিদরা একে শনাক্ত করে রেখেছে একটি বিষাক্ত পদার্থ হিসেবে। ভালো নাম বিস (২-ক্লোরো ইথাইল) সালফাইড, জার্মানরা তৈরি করার সময় নাম রেখেছিল “”লস্ট”” আর “”এস-লস্ট””। কিন্তু বিশ শতক একে “”মাস্টার্ড গ্যাস”” বা “”মাস্টার্ড এজেন্ট”” ডাকনাম দিয়েই চেনে। ১৯৯৩-এ “”কেমিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশন”” (সি. ডাব্লিউ. সি) অ্যাক্ট একে শিডিউল ১; মানে প্রাণঘাতী রাসায়নিকের পর্যায়ভুক্ত করেছে। প্রকৃত অর্থে গ্যাস বলা যায় না একে, সালফার মাস্টার্ড একটি তরল পদার্থ যা বায়ুতে প্রলম্বিত অবস্থায় থাকতে পারে। বিশ্বযুদ্ধে এর আগে ব্যবহৃত ক্লোরিন বা ফসজিন-এর থেকেও এটা অনেকটাই ভারী; তাই ব্যবহার করা জায়গায় কখনো বা মাসের পর মাস না ছড়িয়ে কুয়াশার মতো ভেসে থাকতে পারতো। বিশুদ্ধ সালফার মাস্টার্ড বর্ণহীন, সান্দ্র তরল পদার্থ, কিন্তু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার অবিশুদ্ধ অবস্থায় এটি হলদেটে বাদামি রঙের তরল যার গন্ধ অনেকটাই সরষের সস-এর মতো। কখনো কখনো আর্সেনিক যুক্ত লিউসাইট-এর সাথে মিশিয়েও একে ব্যবহার করা হতো।
এবার আসা যাক এর রাসায়নিক সংকেত আর সংশ্লেষ পদ্ধতিতে। এর সাধারণ রাসায়নিক সংকেত (ClCH2CH2)2S। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এটির সংশ্লেষের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে যাদের মধ্যে লেভিনস্তেইন আর মেয়র- ক্লার্ক পদ্ধতি উল্লেখ্য। লেভিনস্টেইন পদ্ধতিতে ডাইসালফার ডিক্লোরাইড-এর সাথে ইথিলিন-এর বিক্রিয়ার মাধ্যমে সালফার মাস্টার্ড প্রস্তুত করা হয়, অন্যদিকে মেয়র- ক্লার্ক পদ্ধতিতে থায়োগ্লাইকলকে অ্যাসিডের সাথে বিক্রিয়া করিয়ে এটি পাওয়া যায়। কিংবদন্তি এক নোবেলজয়ী রসায়নবিদের নামও এই গ্যাসের সাথে জড়িয়ে আছে, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম এই বিষকে কাজে লাগিয়েছেন। নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে তাকে বলতে হয়েছিল ‘Death is Death, no matter how it is inflicted’.
কতটা ভয়ানক ছিল এই সর্ষের গন্ধ? সুতি বা উল-এর ফেব্রিক এর ভিতরেও সহজেই ঢুকে পড়তে পারতো এটি। মানুষের শরীরের নরম কোষের সংস্পর্শে এর প্রথম কাজ হলো ক্লোরাইড আয়ন নিষ্কাশন করা এবং একটি চক্রাকার সালফোনিয়াম আয়ন তৈরি করা, যেটি আদতে একটি সক্রিয় অন্তর্বতী যৌগ, যা আমাদের ডি. এন. এ. নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্সে অ্যালকিল মূলকটিকে প্রতিস্থাপন করে এবং কোষের মৃত্যু ত্বরান্বিত করে। যদি কোষটির কোনো কারণে মৃত্যু না হয় তবে সেই ক্ষতিগ্রস্ত ডি. এন. এ থেকে ক্যান্সার কোষের জন্ম হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ মাস্টার্ড-এর সংস্পর্শে আসার ২৪–৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে অসম্ভব জ্বালা আর চুলকানি অনুভব করতে শুরু করতো। আর কিছু সময়ের মধ্যেই সারা শরীর জুড়ে অসংখ্য বড় আকারের ফোস্কা জন্ম নিত যা শেষ পযন্ত সেকেন্ড বা থার্ড ডিগ্রী কেমিক্যাল বার্নে পরিণত হত। ওদিকে চোখ আর ফুসফুসের সংস্পর্শে সাময়িক অন্ধত্ব আর পালমোনারি এডিমার মারাত্মক ঝুঁকি ছিল। আক্রান্ত ব্যক্তির জামাকাপড়ও মাস্টার্ড-এর সংস্পর্শে দূষিত হয়ে পড়েছে আর তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ত নার্স বা চিকিৎসকদের উপর। চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকসময়ই সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট-এর সাহায্যে ক্লোরিনেশন বা অক্সিডেশন-এর মাধ্যমে অথবা “”ডি. এস-২””(২% সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড,৭০% ডাইইথিলিন ট্রাইঅ্যামিন,২৮% মিথক্সিইথানল-এর মিশ্রণ) ব্যবহার করেই ক্ষতস্থান নিরাময়ের চেষ্টা করা হত। যা কিছুটা হলেও আক্রান্তের শরীরে সেপসিস-এর ভয় কমিয়ে ফেলতে সমর্থ ছিল।
ইতিহাসে (২- ক্লোরো ইথাইল) সালফাইড-এর সাথে আরও বিভিন্ন মাস্টার্ড এজেন্ট ব্যবহার করার প্রমাণ মিলেছে। যেগুলির রাসায়নিক সংকেত আর গঠনগত দিক বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
দুটি বড় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পশ্চিমা পৃথিবী আর আরও অনেক দেশই নিজের রাসায়নিক যুদ্ধের স্টকপাইল নষ্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্লোরিন, ফসজিন বা মাস্টার্ড এজেন্টদের অনেককেই সমুদ্রের গভীরে আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ৯০০০০ মানুষের মৃত্যুর কারণ এই “”পোস্টার চাইল্ড””। এর গল্প এখানেই শেষ নয়, বিষ আর ওষুধের অন্তরালে থাকা সূক্ষ্ম পর্দাটা সরিয়ে নিয়ে কি কিছু নতুন পাওয়া গেছিল? আর যে মানুষটার হাত ধরেই এই নারকীয় গ্যাসের যুদ্ধের আখ্যানে আবির্ভাব তার সম্পর্কেই বা কতটা জানি আমরা!
বিশ্বযুদ্ধ শেষের প্রায় ১৫ বছর কেটে গেছে। সুইজারল্যান্ড-এর বেসেল শহরের একটি হোটেলের অন্ধকার ঘরের এককোনে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে এক বছর ৬৫-র বৃদ্ধ। যে সে লোক নয় সে, নামের আগে বিখ্যাত বা কুখ্যাত বললেও খাপ খেয়ে যাবে বিশেষণ হিসাবে। কাইম ওয়েইজম্যান-এর ডাকে যাচ্ছিলেন প্যালেস্টাইনের সিইফ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এখন ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট) যোগ দিতে। পথেই বিপত্তি, তাই আশ্রয় নিতে হলো এখানে। বুকের বাঁদিকের চিনচিনে ব্যাথাটা কমছে না যেন কিছুতেই। ঝাপসা হয়ে আসা চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়লো ঝাপসা অতীত….
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।