যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়! হোম ওয়ার্কের কঠিন অঙ্কগুলো বাকি, এসময়েই হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল! ঝুপ করে সব অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকারে বুবুন ভয়ে ভয়ে মাকে ডাকল, মা! লাইট, ফ্যান সব বন্ধ হয়ে গেলো তো!
মা রান্নাঘর থেকে বলল, বেশ হয়েছে। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো। কখন থেকে বলছি অঙ্কগুলো শেষ করতে, এখনো শেষ করতে পারলি না! থাক বসে অন্ধকারে!
বুবুন চেঁচিয়ে বলল, আমার ভয় করছে তো অন্ধকারে!
এসময় বুবুনকে অভয় দিতে বুবুনের দাদু হাজির হলেন হ্যারিকেন নিয়ে। নাও, বুবুনবাবু, হ্যারিকেন-এর আলোতে অঙ্কগুলো শেষ করে ফেল দেখি। কতক্ষণে কারেন্ট আসে, তার তো ঠিক নেই!
বুবুন হঠাৎ খুব চিন্তায় পড়ে গেল, আচ্ছা দাদু, যদি কারেন্ট একেবারে না আসে, তাহলে কি হবে? পড়াশুনো, টিভি দেখা, চার্জ শেষ হয়ে গেলে মোবাইল-এ গেম খেলা, বন্ধুদের সাথে ফোনে গল্প করা, কারেন্ট ছাড়া তো সবই তো বন্ধ! কারেন্ট ছাড়া তো বাঁচাই যাবেনা!
- কেন যাবে না, দাদুভাই! আমাদের ছোটবেলায় তো গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলই না, আমরা তো দিব্যি বেঁচে ছিলাম।
বুবুন দাদুর কথা শুনে অবাক হয়ে যায়, বিদ্যুৎ ছিল না? সত্যি? তাহলে তোমরা কি করে সব কাজ করতে? বিদ্যুৎ ছাড়া কিচ্ছু করা যায় না! - করা যায়, দাদুভাই। তুমি যখন ক্রিকেট খেলো, ফুটবল খেলো, তখন তো বিদ্যুৎ লাগে না। তাছাড়া একটা সময় তো পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ছিলই না।
বুবুনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়, সে কি গো দাদু! তখন সবাই কি করতো? ও বুঝেছি, তখন সব কিছু আমার খেলনাগুলো-র মতন ব্যাটারিতে চলতো। তাই না? - না গো না, ব্যাটারি-ও তখন ছিল না!
- সে কি! বিদ্যুৎ ছিল না? ব্যাটারি ছিল না? সব কাজ কি করে হত তাহলে? তাহলে কি সবাই তখন শুধু খেলে বেড়াত আর ঘুমোতো?
দাদু খুব একচোট হেসে বললেন, কি যে বলো দাদুভাই! সবাই যদি ঘুমোতো আর খেলে বেড়াত, তাহলে তাজমহল বানালো কে? মিশর-এর পিরামিডগুলো বানালো কে? ইতিহাস-এর বই তে যে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর কথা লেখা আছে, সেগুলো বানালো কে? আর কি ভাবেই বা বানালো?
বুবুন বিজ্ঞের মত বলল, তাজমহল বানালেন শাহজাহান, পিরামিড বানিয়ে ছিলেন মিশর-এর ফারাওরা! কিন্তু ওই প্রাচীন সভ্যতাগুলো কে বানালো, সেটা জানিনা। কারো নামও তো বইতে লেখা নেই! - সেটাই তো গল্প দাদু, শাহজাহান কি আর নিজে হাতে তাজমহল বানিয়েছেন? না ফারাও নিজে একা একা পিরামিড বানিয়েছেন? এই যে আমাদের পাশের বাড়িতে ছাদে কাজ হচ্ছে, দেখেছ কতজন একসাথে কাজ করে?
বুবুন ধন্ধে পড়ে যায়। সত্যি তো! তাহলে তো নিশ্চই অনেকে মিলেই বানিয়েছে! কিন্তু কারা বানিয়েছে, কি করে বানিয়েছে, এগুলো কিচ্ছু বইতে লেখা নেই! - ভেবে দেখ দাদু! এখন তো অনেক সুবিধে হয়েছে। লিফট্ আছে, বালি, সিমেন্ট মেশানোর জন্যে বৈদ্যুতিক যন্ত্র আছে। পাম্প ব্যবহার করে কুয়ো থেকে জল একদম ছাদ অবধি উঠে যাচ্ছে। এগুলোও তো সব বিদ্যুতে চলে। বিদ্যুৎ ছাড়া তখন এ কাজগুলো হল কি করে?
বুবুন গভীর সমস্যায় পড়ে, সত্যিই তো! বিদ্যুৎ না থাকলে এই কাজগুলো কি করে হত?
দাদু বললেন, আসলে জানো তো, কাজ করার জন্যে বিদ্যুৎ-ই কিন্তু একমাত্র শক্তি নয়। আরো বিভিন্ন রকম ভাবেও কাজ করা যায়। শক্তি অনেক রকম হতে পারে। - শক্তি? মানে গায়ের জোর? আমারই তো গায়ে অনেক জোর!
ঠিকই বলেছ। একটা সময় ছিল যখন সারা পৃথিবীতে গায়ের জোরেই কাজ হতো। আর গায়ের জোরে কাজ করতে হতো বলেই, অনেক অনেক লোকজন লাগতো! জানো তো শক্তি অনেক ধরণের হতে পারে, একেকটার একেকরকম নাম! তুমি যে গায়ের জোরে ফুটবলে লাথি মারো, সেটা কি শক্তি জানো?
বুবুন বলল, কি? গা-জোয়ারি?
দাদু হেসে বললেন, না, একে বলে মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক শক্তি। এই শক্তি দিয়েও কিন্তু অনেক ধরণের যন্ত্র চালানো যায়। ধর, ছুরি, কাঁচি, হাতুড়ি থেকে শুরু করে সাইকেল, রিক্সা, ঠেলাগাড়ি এগুলো সবই যান্ত্রিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। এর জন্যে তো বিদ্যুৎ লাগে না।
– গায়ের জোর লাগাতে হচ্ছে মানে মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক শক্তি? তাহলে ওই যে পাশের বাড়ির ছাদে কাজ করার সময় মাথায় করে ইঁট নিয়ে যাচ্ছে, বা দড়ি দিয়ে বালতি ভর্তি বালি তুলছে, তার জন্যে যে গায়ের জোর লাগছে, সেটাও কি যান্ত্রিক শক্তি? মামা বাড়িতে যে কুয়ো থেকে জল তুলেছিলাম, সেটাও তাহলে যান্ত্রিক শক্তি? - ঠিক বলেছ! একটা সময় ছিল যখন গায়ের জোরেই সব কাজ করতে হতো। বাড়ি বানানো, রাস্তা বানানো থেকে শুরু করে সমস্ত রকম কাজেই মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক শক্তিই ছিল একমাত্র উপায়।
– কিন্তু দাদু, পাশের বাড়িতে শুধু ছাদে কাজ করতেই তো এতো লোকজন লাগে, তাহলে পিরামিড বা তাজমহল বা একটা গোটা শহর বানাতে তো অনেক অনেক লোক লাগবে, আর অনেক দিন লাগবে। - খুব ভালো বলেছ দাদুভাই। হাজার হাজার লোকজন সারা জীবন ধরে কাজ করে এই সব সভ্যতা বানাত। এবং তারা কখনো ছুটিও পেত না। আর এর থেকেই ক্রীতদাস প্রথা শুরু হয়।
- ছুটি পেত না? কেন?
- পৃথিবীতে যতদিন না অন্যান্য উপায়ে সস্তায় শক্তি উৎপাদন করা গেছে, ততদিন মানুষকে অন্য মানুষ-এর গায়ের জোরের উপরেই নির্ভর করতে হয়েছে। হাজার হাজার লোকের হাজার হাজার দিনের কাজের ওপরেই তৈরী হয়েছে একেকটা সভ্যতা। তাদের কোনো ছুটি ছিল না। মহাসমুদ্রে জাহাজ চালানো থেকে চাষ করা, নগর থেকে পিরামিড বানানো, এরা সব কিছুই করতে বাধ্য হত। ক্রীতদাস হয়ে, বন্দি হয়ে, কোনো ছুটি ছাড়া, বেতন ছাড়া।
- আমার তো ভাবলে কষ্ট হচ্ছে দাদু! ছুটি ছাড়া দিনের পর দিন কিভাবে কাজ করতো? এটা কষ্টের গল্প। তুমি অন্য গল্প বল।
- সে না হয় বললাম। কিন্তু দাদুভাই, এই গল্পগুলোও তো একটু জানতে হবে।
- বুবুন একটু অধৈর্য্য হয়ে বলল, আচ্ছা, সে পরে শুনব একদিন। তুমি বল, ট্রেনগুলো তো মাথার উপরে বৈদ্যুতিক তার থেকেই বিদ্যুৎ নেয়, তাই না?
- তা তো নেয়।
- কিন্তু ট্যাক্সি বা বাস-এর মাথার উপরে ওরকম তার থাকে না কেন? ওরা তাহলে কোথা থেকে বিদ্যুৎ নেয়?
- বেশিরভাগ ট্যাক্সি বা বাস তো তেল-এ চলে, তাই না! পেট্রল, ডিজেল-এর নাম তো তুমি শুনেছো। জ্বালানি তেল ব্যবহার করলে আর বিদ্যুৎ লাগে না।
- কেন লাগে না? আমরা তো গাড়িগুলোকে ঠেলছি না, মানে যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহার করছি না, আবার বৈদ্যুতিক শক্তিও ব্যবহার করছি না। তাহলে ওরা কোথা থেকে শক্তি পাচ্ছে?
- ওরা তেল পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করছে। তেলের ভেতর কেমিক্যাল বা রাসায়নিক শক্তি থাকে, সেটা পোড়ালে যে আগুন থেকে তাপ বেরোয়, সেটা হলো তাপশক্তি। তারপর গাড়িতে অনেক যন্ত্রপাতি আছে যা দিয়ে সেই তাপশক্তিকে যান্ত্রিকশক্তিতে পরিণত করে গাড়ি চলে। বোঝা গেল?
- বাপ্ রে, প্রথমে রাসায়নিক শক্তি, সেটা পাল্টে তাপশক্তি, আবার সেটা পাল্টে যান্ত্রিক শক্তি। তিন রকম শক্তি?
- এটাই তো মজা। জানো তো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা শক্তি বানাইনা। শুধু এক রকম শক্তিকে আরেক রকম শক্তিতে পরিবর্তন করি।
- বাঃ, বেশ মজার তো!
- তুমি বলছিলে না ব্যাটারি দিয়ে তোমার খেলনা চলে! ব্যাটারির মধ্যেও রাসায়নিক শক্তি আছে, যেটা বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত হয়, তারপর যান্ত্রিকশক্তিতে পরিণত হয়।
- আবার ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলে তো হাতে করেই আমি খেলনাগাড়ি চালাতে পারি, তখন আমি নিজের গায়ের জোর দিয়ে যান্ত্রিক শক্তি বানাচ্ছি, তাই না দাদু?
- ঠিক তাই। তুমি যেটা খেলনায় করছো, ঠিক সেরকম ভাবেই তো রিক্সা, ঠেলা গাড়িতে গায়ের জোরেই যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহার হচ্ছে।
- বুঝেছি, এই কারণে রিক্সা আর ঠেলা গাড়িতে তেল লাগে না?
- ঠিক তাই! আর শুধু তেল নয়, এই যে মা গ্যাস-এ রান্না করে, সেটাও তো রাসায়নিক শক্তি থেকে তাপশক্তি তৈরী করার উপায়। তারপর ধর, আমরা যে পিকনিকে গিয়ে কাঠ জ্বালিয়ে আর কয়লা পুড়িয়ে রান্না করেছিলাম, সেই রান্না-র জ্বালানিগুলোও কিন্তু রাসায়নিক শক্তির উদাহরণ। পুড়িয়ে সেটাকে তাপশক্তিতে পরিণত করে, তা দিয়ে রান্না হল।
- ও, তার মানে কাঠ, কয়লা আর তেল থেকেও শক্তি তৈরী হয়?
- নিশ্চয়ই!
- কিন্তু কি করে হয়?
দাদু কিছু বলার আগেই হঠাৎ দপ্ করে আলো জ্বলে উঠল।
আচ্ছা দাদুভাই, বাকি গল্প পরে বলব, এখন তুমি অঙ্কগুলো শেষ কর। ঠিক আছে? - হ্যাঁ দাদু, শক্তির গল্প শুনতে আমার ভালো লাগছে। কালকে আবার শুনবো।
- – দাদু বললেন, কাল তোমায় বলব, এই যে আমরা জলের পাম্পে বলি হর্স পাওয়ার বা অশ্বশক্তি, এটা কেন বলি। তারপর বলব, কি করে বাষ্পীয় ইঞ্জিন এল, আর তার ফলে দুনিয়া কি ভাবে বদলে গেল। (ক্রমশঃ)
~ কলমে এলেবেলের অতিথি সৈকত চক্রবর্তী ঠাকুর
সৈকত সান দিয়াগোতে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ার (UCSD) সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ-এ (CER) কর্মরত বিজ্ঞানী।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
“