~ কলমে এলেবেলে প্রত্যয় ~
“”স্যার, মেলটিং পয়েন্টটা খুঁজে পাচ্ছি না।” মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে গ্র্যাজুয়েশনের ছাত্র। সামনে বসে প্রফেসার। বয়স্ক, মাথায় টাক, চেহারাটি একটু ভারীর দিকে। ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর, কিন্তু তাঁর অসাধারণ সেন্স অফ হিউমার। একটু থেমে গিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “”তুমি এক কাজ করো। জোড়াসাঁকো থানায় একটা মিসিং ডাইরি করে এসো।”” ল্যাবের বাকি লোক হেসে খুন। ছাত্র ভ্যাবাচ্যাকা। গুটিগুটি পায়ে আবার এক্সপেরিমেন্টের কাছে ফিরে এসে ল্যাব পার্টনারকে বলল সব খুলে। “”পুরো প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন দিয়ে দিলো।”” ল্যাব পার্টনারটি আবার বেশ একটু ডাকাবুকো দুষ্টু টাইপ। বলল, “”এই টেকো PR-এর সব বিষয়ে বাড়াবাড়ি। হোঁতকা মুখো। মজা দেখাচ্ছি। মিসিং ডাইরি না? দাঁড়া।”” বলে ফোন খুলে টপাটপ টাইপ করতে শুরু করে দিল। মুখে একটা মিটিমিটি শয়তানি হাসি।
সন্ধ্যে ৮টা-সাড়ে ৮টা নাগাদ প্রফেসার PR-এর মোবাইলে একটা ফোন এলো। ফোন করেছে কলেজের দারোয়ান।
- হ্যালো।
- হ্যালো। হ্যাঁ স্যার, থানার বড়োবাবু কলেজের গেটে। বলছেন এখুনি নাকি ফিজিক্স ল্যাব খুলতে হবে। তদন্ত আছে। কিসব নাশকতামূলক কন্সপিরেসি-ফেসি বলছেন। খুব উত্তেজিত। বলছেন আটকাতেই হবে।
PR তো থতমত। কন্সপিরেসি! নাশকতা! কলেজে! তায় আবার ফিজিক্স ল্যাবে! আমি ডিপার্টমেন্ট হেড, টের পেলাম না। - একবার বড়বাবুকে ফোনটা দাও দেখি।
বড়বাবু ফোন ধরেই, “”হ্যাঁ, স্যার। চলে আসুন এখুনি। ল্যাব খুলতে হবে, খানা তল্লাসি আছে। আমি পুরো ফোর্স নিয়ে এসে গেছি। বম্ব স্কোয়াড স্ট্যান্ডবাই তে আছে। আসুন, আসুন।””
PR পড়লেন আরও ধন্ধে। “”কি হয়েছে একটু খুলে বলবেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”” - আপনার ল্যাবে একটা এত বড় ব্যাপার হয়ে গেলো আপনি কিছুই জানেন না? আপনি তো বলেছিলেন মিসিং ডাইরি করতে। কিন্তু, এটা আপনার নিজের করা উচিত ছিল। ফালতু ফালতু একটা স্টুডেন্টের নাম জড়ালেন। বাদ দিন। এখানে আসুন। এসব জিনিসে দেরী করা ঠিক নয়। নবারুণ ভটচাজের ‘মাইকেল’ পড়েছেন তো? কে কখন বোমা ফাটাবে কেউ বলতে পারে না। এটা জানতে পেরেছি। বোমা ফাটতে দেবো না।
- মাইকেল না, হারবার্ট।
- ঐ হল। আসুন আপনি।
- আমি আসছি। কিন্তু, এখনো, মানে, কিছু বুঝতে…
ফোনটা কেটে গেলো।
কপালে ভাঁজ প্রতি সেকেন্ডে গভীর হয়ে যাচ্ছে। ফোনটা আবার তুলে নিলেন।
কপালে ভাঁজ প্রতি সেকেন্ডে গভীর হয়ে যাচ্ছে। ফোনটা আবার তুলে নিলেন। ফোন করলেন আরেক বরিষ্ঠ সহকর্মী মণিশঙ্করকে।
- এই মণি, কলেজে একটা কাণ্ড হয়ে গেছে। আমি তো বুঝতেই পারছি না কি করব।
- মানে? প্রমথেশদা, আমাকে বলুন না কি হয়েছে?
সব বলা হল। তবে গুছিয়ে নয়। প্রমথেশের মানসিক অবস্থা মনিশঙ্কর ভালই বুঝতে পারছিলেন। কলেজের ভেতরে এরকম একটা ঘটনা হলে ওনার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে, তার থেকে বেশীও হতে পারে।
মণি বললেন, “প্রমথেশদা, যেতে যখন বলেছে তখন যেতে তো হবেই। ১৫ মিনিটে টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে মিট করি? আমিও যাবো আপনার সাথে।””
এই মনিশঙ্কর হচ্ছেন প্রমথেশের থেকে বয়সে একটু ছোট। এবং, চরিত্রের দিক থেকে প্রমথেশের ঠিক উল্টো। বাচাল, ফক্কড়। ছাত্রদের সাথে মজা করেন হরদম। তাঁর দেওয়া বিভিন্ন বাণী নিয়ে ছাত্ররা ফেসবুকে একটা পেজ খুলেছে। বেশ মজাদার লোক। কিন্তু, মাথা একদম ঠাণ্ডা। সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সে ফ্যাকাল্টি মীটিংএর জটিল প্রস্তাব হোক, বা পদার্থবিদ্যার অঙ্ক। ১৫ মিনিট পরে টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে আসার আগেই উনি বুঝে গেলেন পুরো ব্যাপারটা। এ ব্যাটা সৌম্যর কাজ। - এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, মণি।
- আপনার পুরো ঝামেলাটা বুঝে গেছি। সৌম্য মস্তানের কীর্তি নির্ঘাত। ওর ল্যাবমেটকে বলেছিলেন আজ মিসিং ডাইরি করো। ঐ ব্যাটা করেছে। আমি বলছি, মিলিয়ে নেবেন, ঐ ডাইরি করেছে। দিয়ে এমন করে লিখেছে যে পুলিস ভেবেছে সিরিয়াস কিছু।
– কিন্তু, বড়বাবুকে বেশ চিন্তিত লাগলো।
চিন্তারই বিষয়।বড়বাবু নিজেও বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। B.Sc.। ইদানীং ফেসবুকের দৌলতে আবার অল্প অল্প বিজ্ঞানবিষয়ক জিনিসের প্রতি আগ্রহও বাড়ছে। ‘এলেবেলে’-র ‘তাই নাকি!’ ওনার ফেবারিট। এটা পাঠকদের অনেকে জানেন না, ফিজিক্সের ল্যাবে অনেক তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকে। সেগুলো হারিয়ে গেলে, বা চুরি গেলে সত্বর পুলিসে খবর দিতে হয়। তদন্ত হয়। বড়বাবু সেটি জানতেন। কিন্তু, ‘মেলটিং পয়েন্ট’-র মিসিং ডাইরি দেখে কোন ভাবে ওনার মনে হয় যে হতে পারে এটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ রিলেটেড কিছু। হয়ত, পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলেছে কেউ। এই তো সেদিন ইন্টারনেটে দেখলেন এক স্কুল ছাত্রী পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে। “”উঃ, এটা একটা ল অ্যান্ড অর্ডার প্রবলেম হয়ে যাবে। সামনে আবার ভোট। নাশকতার চেষ্টা। আর ভাবতে পারছি না। আমার এরিয়াতেই এই।”” উনি এটা জানতেন না যে এই ল্যাবের তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো খুব একটা বেশী তেজস্ক্রিয় হয় না। এবং এমন নয় যে সেগুলো দিয়ে পারমাণবিক বোমা বানানো যায়। কিন্তু, সতর্কতা হিসেবে এটা সরকারি নিয়ম। অতএব, উনি বেশ উত্তেজিতই ছিলেন।
হঠাৎ, চোখ তুলে দেখেন এক হাবিলদার বিড়ি ধরিয়েছে।
“”এই বিড়ি ফ্যাল, বিড়ি ফ্যাল। আরে, আবার না নিভিয়ে ফেললি কেন?” দৌড়ে গিয়ে বুট দিয়ে বিড়ি নিভিয়ে দিলেন। “”ভেতরে হয়তো অ্যাটম বোম রয়েছে। ফেটে গেলে যে সব সুদ্ধ উড়ে যাবো।””
ভেতরে হয়তো অ্যাটম বোম রয়েছে। ফেটে গেলে যে সব সুদ্ধ উড়ে যাবো।
এই ওভার-রিয়েকশনটা ওনার বরাবরের স্বভাব। প্রমথেশ আর মণি ততক্ষণে চলে এসেছেন। বড়বাবুর কথা শুনে মণি বললেন, “”আপনার কি মনে হয় অ্যাটম বোমের একটা সলতে থাকে? তাতে আগুন দিয়ে ছুঁড়ে দিলে বোম ফাটে?”
- তা নয়?
- না, মোটেই তা নয়। এবার বলুন কি হয়েছে? ডাইরিটার কপি দেখান। তুমি বিড়ি খাও ভাই। বোমা ফাটবে না। কিন্তু, তোমার ফুসফুসের কটা বাজে ভাই?
৫০ পয়সার বিড়ি খুইয়ে আর প্রফেসারের জ্ঞান শুনে ব্যাজার মুখে হাবিলদারটা আবার একটা বিড়ি ধরাল।
ডাইরির কপি দেখে প্রমথেশ আর মণি নিশ্চিন্ত হলেন। - বলেছিলাম, প্রমথেশদা? সৌম্যর কীর্তি।
বড়বাবু অ্যাটম বোমের অপমানটা এখনো হজম করে উঠতে পারেন নি। একটু জোরেই বললেন “”মিসিং বলছে কেন তবে?”
মণি সকালের ঘটনা খুলে বললেন।
বড়বাবু বললেন, “”তাহলে কি বলছেন? সেরকম কিছু না।”” প্রমথেশ আর মণিশঙ্করের মুখের নিশ্চিন্ত ভাবটাই উত্তরটা দিয়ে দিল। এবার বেশ উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন, “কিন্তু, ঐ শয়তান ছোকরা সৌম্যকে সরকারি সময় নষ্ট করার দায়ে আমি কেস দিচ্ছি। আপনারা ভাববেন না।””
প্রমথেশ বললেন, “”না, কেস দিলে আমাকে দিন। আমি বলেছিলাম বলেই না করেছে। ওর কি দোষ?” - না, মানে, থানায় ডেকে একটু কড়কে দিলে ভাল হতো না?
- সে আমরা কাল ওকে ভাল করে বকে দেবো। এমনিতে ছেলেটা ভাল। বুদ্ধি আছে। একটু দুষ্টু প্রকৃতির, এই যা।
বড়বাবু একটু গাঁইগুঁই করলেন বটে, কিন্তু এবার প্রমথেশ বেশ গম্ভীর আর স্পষ্ট গলায় শেষ সিধান্ত জানালেন, “আপনাকে তো বললাম, হয় ভুল বোঝাবুঝি বলে মিটিয়ে নিন, নয় আমাকে কেস দিন। এর অন্যথা হবে না। ওই ছেলে অনেক দূর যাবে জীবনে। থানা পুলিস হলে ওর জীবনে একটা দাগ পড়ে যাবে। সে আমি হতে দেবো না।”” এর ওপর আর কথা চলে না।
বড়বাবু বেশ দমে গেলেন, “”বেশ, আপনি যখন বলছেন তখন আর বাড়াবো না। শুধু শুধু হ্যারাসমেন্ট। আপনারা বাড়ি ফিরবেন তো? একটা ট্যাক্সি ডেকে দি?” বড়বাবু হাঁক দিয়ে ডাকলেন বিড়িখোর হাবিলদারকে।
সে একটু দুরে ছিল। আঁচ করেছিল যে ব্যাপারটা মিটে গেছে। কে জানে কি ভাবল। এসে বলে, “”স্যার, মেডিকেল কলেজের পেছনটায় এই সময় কাঁচকলার বড়া ভাজে। যাবেন নাকি?” বড়বাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, “”আপনারাও চলুন। বড়া খাব, চা খাব। ওখান থেকে ট্যাক্সি পেতেও সুবিধে হবে।””
জিপে উঠেই বড়বাবুর মনের বিজ্ঞানী আবার জেগে উঠল । “”কিসব দিন এলো? আমারা করতাম এক্সপেরিমেন্ট। একবার কি একটা ধ্রুবক বের করতে দিয়েছিল, নাম মনে নেই, একদম এক্সজ্যাকট চার এনে দিয়েছিলাম। আর এরা একটা মেলটিং পয়েন্ট বের করতে পারে না? হা হা হা। দেখেছো সুবিমল?”” ছোটবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন।
মণি বললেন, “”আরে ধুর মশাই, আপনি হলে আপনিও পারতেন না। শুধু আপনি তো কি কেউ পারে না। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় কাঁচের মেলটিং পয়েন্ট হয় না।””
বড়বাবু অবাক। “”কি বলছেন, স্যার? একটা কঠিন জিনিসকে গরম করলে গলে যাবে এটা তো বাচ্চাও জানে। ঐ তো বাচ্চাবেলায় পড়েছি বরফ শূন্য ডিগ্রীতে গলে জল হয়।”” - হ্যাঁ, জলে যা হয়, কাঁচে তা হয় না। আর আপনি কোথায় পড়েছেন যে কাঁচ কঠিন? দেখতে ওরকম লাগে, বাস্তবটা আলাদা।
- অ্যাঁ, তাই নাকি! আরে দাঁড়ান দাঁড়ান। সেদিন এলেবেলের ফেসবুক পেজে পড়লাম। কাঁচ নাকি তরল। এটাও কি ঐ রিলেটেড নাকি?
- হ্যাঁ। একদমই তাই। ওরা ঠিকই বলেছে। কাঁচ আসলে না কঠিন, না একদম তরল। আপনার দেখার ওপর নির্ভর করছে। আপনি বুঝবেন?
- হ্যাঁ। আপনি বলুন। আমার, বুঝলেন কিনা, ঐ কিউরিওসিটি জিনিসটা খুব বেশী। পুলিশে আছি তো? আপনি বলুন।
- জল ঠাণ্ডা করলে দুম করে জমে বরফ হয়ে যায়। কেন? কারণ ঠাণ্ডা করলে ওর যে অণুগুলো আছে তারা একসময় একটা নির্দিষ্ট, দৃঢ় সজ্জায় সজ্জিত হয়ে যায়। আর এটা হয় একসাথে। সব অণুগুলোই একসাথে ঐ সজ্জা নিয়ে নেয়। এটাকেই আমরা বলি বরফ। এবার আসা যাক কাঁচের কথায়। কাঁচ অনেক রকমের হয়, তবে মোটামুটি ধরুন ১০০০-১৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে কাঁচ সাধারণ তরলের মতো হয়। কিন্তু, খুব সান্দ্র।
- সান্দ্র মানে?
- সান্দ্র মানে সে খুব ধীরে বয়। যেমন, জলের থেকে বেশী সান্দ্র হচ্ছে মধু। কারণ, মধু জলের থেকে ধীরে প্রবাহিত হয়। মধু জলের থেকে প্রায় দশ হাজার গুণ সান্দ্র। সেরকমই উচ্চ উষ্ণতায় কাঁচ মধুর মতোই সান্দ্র তরলের মতো হয়।
সুবিমল হঠাৎ বলে উঠল, “”ভিসকসিটি?””
এবার প্রমথেশ মুখ খুললেন, “”সে আপনি ভিসকসিটি বলুন বা সান্দ্রতা, আপনার বড়বাবু তো কোনটাই বুঝবেন না। ওনাকে সেটার সংজ্ঞা দেওয়া বেশী দরকার। নয়তো উনি আবার অ্যাটম বোমের সলতেতে কাঁচ ঢেলে তাকে নিষ্ক্রিয় করতে যাবেন হয়তো।””
মণি আবার শুরু করলেন, “”এবার আপনি যখন খুব গরম তরল কাঁচকে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা করছেন তখন আপনি বুঝতেই পারবেন না কখন তরল কাঁচটা, আপনার ভাষায় কঠিন হয়ে গেলো। জল-বরফের মতো ব্যাপারটা দুম করে হবে না। হবে অনেক আস্তে আস্তে। প্রথমটায় মনে হবে তরল কাঁচের সান্দ্রতা বাড়ছে, সান্দ্রতা যত বাড়বে দেখবেন তরলের প্রবাহ তত ধীর হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই চলতে চলতে কখন যে ওটার প্রবাহ একদম ধীর হয়ে যাবে, আপনি ধরতে পারবেন না।”” সেই সাথে হাতটা তুলে এই শেষ বক্তব্যের সাথে জনপ্রিয় ভঙ্গিও করে দেখলেন। “”যে কাঁচ আপনি দেখছেন তার সান্দ্রতা জলের প্রায় ১এর পিঠে ১৫টা শূন্য দিলে যা হয়, তত গুণ।””
“”ও, তার মানে মারাত্মক সান্দ্র তো। বুঝে গেছি। মানে, এতোটাই ধীরে বইছে যে বুঝতেই পারি না।”” বড়বাবু বেশ একটা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেন।
মণি বললেন, “”আরও গল্প আছে। শুনবেন তো বলি।”” - বলুন, শুনি।
- এই যে আপনি কাঁচ ঠাণ্ডা করছেন এতে যে পুরো কাঁচটাই তরল রয়ে গেলো তা কিন্তু না। ওর বেশ কিছু অণু কিন্তু কঠিন হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা বেশ খান কুড়িক জন মিলে একটা সুন্দর দৃঢ় আইকসহেড্রন বানাচ্ছে।
সুবিমল আবার ফুট কাটে, “”মানে ঐ ত্রিভুজ দিয়ে বানানো একটা গোলক। তাই তো?”
মণি একটু চমকে গিয়ে বললেন, “”আপনি কি করে জানলেন?” - “”ওই, স্যার, আমার এক ভাইপো ওরেগনে থাকে। অঙ্ক নিয়ে গবেষণা করে। একটা পার্কের ছবি দিয়েছিল। তাতে ছিল স্যার ওটা। জানতে চাইলাম, তো বলল।””
- বাঃ। হ্যাঁ, তো ঐ আইকসহেড্রন এদিক ওদিকে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু, অনেকটা অংশ আবার তরলের মতো বোয়ে যাচ্ছে। তারাও যে কঠিন হওয়ার চেষ্টা করছে না তা নয়। তারা ঐ চার-পাঁচটা মিলে হয়তো প্রিজমমতো বানাল। কিন্তু, খুব শক্ত-পোক্ত নয়। এই গড়ে, তো এই ভাঙ্গে। জল বরফের সাথে তফাতটা বুঝছেন তো বড়বাবু? বরফে কিন্তু এরকম অর্ধেক এরকম, আর অর্ধেক ওরকম, এটা হয় না। সবটাই একই।
বড়বাবুর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়া পেয়ে মণি আবার শুরু করলেন, “”এবার এরকমও নয় যে যা একবার কঠিন হয়ে গেলো তা একদম ওরকমই রয়ে গেলো। মানে, ডাইনামিক ব্যাপার। এখন যা কঠিন তা একটু পরে তরল, আবার এখন যা তরল তা একটু পরে আবার কঠিন। মানে একদম মিলে মিশে আছে। সময়ের সাথে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে।”” একটু থেমে গিয়ে আবার শুরু করলেন, “আসলে, প্রত্যেক অণু তার আশপাশের প্রতিবেশীদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে সবসময়। ট্রাফিকের মতো। এই রাস্তা খালি, তো ঐ রাস্তায় জ্যাম। আবার এখন এই রাস্তা খালি, তো ২ ঘণ্টা পরে জ্যাম। কখন যে কোন রাস্তায় জ্যাম লাগবে তা ‘দেবা না জানন্তি।’ সেরকমই এদের স্বভাবটাও খুব জটিল। সহজে ধরা যায় না। তরল কাঁচ যখন ঠাণ্ডা করছেন, তখন এই কঠিনের পরিমাণটা ধীরে ধীরে বাড়ছে, তরলটা কমছে। যতো সময় যাবে ততো কঠিন বাড়বে, আর একদিন আপনি সত্যি সত্যি কঠিন কাঁচ পাবেন।””
এবার বড়বাবু একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “”আরে মশাই, তার মানে তো যে কাঁচ আমরা দেখছি, সেটা কঠিনই আপনি খামোকা কিসব কষের হাণ্ডি না কি বলে কনফিউজ করে দিলেন।”” - আইকসহেড্রন। আর, এটা এতো সোজা নয়। লোকে অনেক গবেষণা করেছে। তরল কাঁচ পুরোপুরি ভাবে ঠাণ্ডা হতে কতো বছর লাগে তার আইডিয়া আছে? কোটি কোটি বছর। আর আপনার দেখা কাঁচ কবে তৈরি হয়েছে। খুব বেশী হলে ২০০ বছর। মানুষ কাঁচ তৈরি করাই শুরু করেছে ৫০০০ বছর আগে।
প্রমথেশ পাশ থেকে জানালেন, “”এই মহাবিশ্ব তার কড়ে আঙ্গুলের নখের বয়সী। মণি, কনটিনিউ।”” - অতএব, প্রমথেশদা যা বললেন। বুঝতেই পারছেন, যে কাঁচ আপনি দেখছেন তাকে আর যাই হোক কঠিন বলা চলে না। বুঝলেন?
বড়বাবু একটু যেন সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রশ্নটা শুনে একটু চমকে উঠে বললেন, “”একেবারে, বুঝলেন কিনা, অ্যামেজিং ব্যাপার। কি? হ্যাঁ, সুবিমল। দারুণ না।””
একেবারে, বুঝলেন কিনা, অ্যামেজিং ব্যাপার।
সুবিমল সেদিকে পাত্তা দিল না। মণিকে প্রশ্ন করল, “আমি যদি খুব ঠাণ্ডা করি তাহলেও হবে না?”
মণি বললেন, “”না ভাই, তাতেও হবে না। মানে ধরো যে জিনিসটা খুব দ্রুত ছুটছে, তাকে যদি তুমি খুব ঠাণ্ডা করো তার বেগের পরিবর্তনটা তুমি বুঝতে পারবে। কিন্তু যে জিনিস এমনিতেই এতো ধীর, তাকে ঠাণ্ডা করে তুমি কি করতে পারবে? যার কঠিন হতে কোটি কোটি বছর লাগে, তাকে খুব ঠাণ্ডা করলেও কি বিশেষ লাভ হবে? ওই সমুদ্রে এক ঘটি জল ঢালার মতো ব্যাপার দাঁড়াবে।”” ছাত্রসুলভ জিজ্ঞাসা পেয়ে মণি কখন যে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এসেছেন, খেয়ালই করেননি। সুবিমলও বয়স আর মর্যাদার খাতিরে কিছু মনে না করেই বলল, “আরেকটা প্রশ্ন। ঐ জানালার কাঁচের নিচের দিক মোটা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা।””
- ওটা ভুল ধারনা। আগে জানালার কাঁচ যেভাবে বানানো হতো তাতে একদিক পুরু আর এক দিক পাতলা হাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। জানালায় লাগাবার সময় লোকে মোটা দিকটাই নিচের দিকে লাগাত। যদিও প্রথম দিকে এটা থেকেই বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন যে কাঁচ হয়তো তরল। তাই, অনেকদিন রেখে দিলে বয়ে নিচের দিকে জমা হচ্ছে। পরে বোঝা যায় এটা ঠিক নয়। এরকম ঘটনা ঘটতে সময় লাগবে প্রায় ১এর পিঠে ৩২টা শূন্য লাগালে যত হবে তত বছর। অতএব, আমি আপনি এসব জিনিস দেখতে পাবো না। ঐ যে প্রমথেশদা বলছিলেন মহাবিশ্ব, তারই বয়স মোটে ১এর পিঠে ১০টা শূন্য বছর। আপনাদের যে এতক্ষণ ধরে ‘কোটি কোটি’ বলছিলাম সেটা শুধু কথার কথা ছিল। আসলে সেটা আরও কতো বড় সেটা এবার ভেবে দেখুন।
এবার বড়বাবু বললেন, “তাই বেটাচ্ছেলে মেলটিং পয়েন্ট পায়নি। মেলটিং পয়েন্ট হয় না তো পাবি কি করে?”
প্রমথেশ বললেন, “”একদম যে কোন পয়েন্ট নেই তা নয়। একটা আছে গ্লাস ট্রানজিশন পয়েন্ট। কিন্তু, সেটা বের করা অতো সহজ নয়। এছাড়া শুধু কাঁচ নয়, অনেক পলিমারও আছে যেগুলো ঠিক মণি যেরকম বলল, ঐ রকম আচরণ করে। অনেকে এটাও বলেন যে কাঁচের যে অবস্থা সেটা পদার্থের সম্পূর্ণ একটা নতুন অবস্থা। না কঠিন, না তরল। এই গ্লাস ট্রানজিশন কিভাবে হয়, কেন হয়, কেউ সঠিক জানে না। আমাদের মহলে কথা আছে “”গ্লাস ট্রানজিশনের থিওরির সংখ্যা, এক্সপার্টের সংখ্যার থেকে বেশি।””
মণি বলে উঠলেন, “”নানা মুনির নানা, প্লাস ওয়ান, মত। বুঝলেন?””
পৌঁছে গেছেন সবাই এবার চায়ের দোকানে। চা-বড়া সব খেয়ে প্রমথেশ আর মণি বেরিয়ে গেলেন একটা ট্যাক্সি নিয়ে। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে এবার তাঁরা প্ল্যান করা শুরু করলেন সৌম্যকে কাল কি বলা হবে। সে ব্যাটা খুব চালাক। বেশ কায়দা করে না বললে সব বুঝে যাবে।
এদিকে সুবিমল বড়বাবুকে বলল, “”স্যার, আমি তো আপনার ফেসবুকে আছি, আমাকে ঐ এলেবেলের পেজটায় ইনভাইট করুন না। ইনভাইট ফ্রেন্ডে ক্লিক করে সবাইকে ইনভাইট করে দিন। এসব জিনিস সকলের জানা দারকার।””
বড়বাবু একটু ঝাঁঝাল গলাতেই বললেন, “”তুমি তো বাংলার স্টুডেন্ট। তোমার আবার এতো ইন্টারেস্ট কিসের?” - স্যার, আমি বাংলা পড়েছি বলে কি বিজ্ঞান ভাল লাগতে পারে না?
(এই কাহিনীর কিছু চরিত্র, আর কিছু ঘটনা বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত। তবে বেশিরভাগটাই কাল্পনিক। )
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
লেখাটি পঠিত হয়েছে বার
এলেবেলে – Elebele