~ কলমে এলেবেলে চিরশ্রী ~
১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২০। মহালয়ার ভোর। মোবাইলের এফ এম- এ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় “”আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর””। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে খাট থেকে লাফিয়ে নেমে দেওয়াল ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল পেখম – “”এটা কি হল পিপি?””
- কেন! কি হল আবার?
- “”কোথায় আশ্বিন? এই দেখো কার্ত্তিক মাসে দুর্গাপুজোর তারিখ। মা যে সেদিন বলছিল আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গা পুজোর তিথি? কার্ত্তিক মাসে আশ্বিনের শুক্লপক্ষ হয় কি করে?””
- ঘুম জড়ানো গলায় বললাম – এই আশ্বিন সেই আশ্বিন না।
- “”যাব্বাবা! এ আবার কি কথা? একটু খুলে বললে হয় না?””
- আচ্ছা বলছি তাহলে। কিন্তু আশ্বিনের রহস্য ভেদ করতে হলে আগে যে একটু ক্যালেন্ডারের হিসেবগুলো জেনে নিতে হবে?
- “”এ তো সবাই জানে! পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একপাক ঘুরলে এক বছর, আর নিজের অক্ষের উপর এক পাক খেয়ে এলে হয় এক দিন। কক্ষীয় বা বার্ষিক গতি, আর আহ্নিক গতি।””
- হুম! কিন্তু যতটা সহজে বলে ফেললি, হিসেব করাটা কিন্তু ততটা সহজ নয়। যেমন ধর, আমরা জানি যে সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে, কিন্তু কোনো একটা জায়গা থেকে চলা শুরু করে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী একবার পুরো চক্কর খেয়ে আবার সেই জায়গায় ফিরে এসেছে কিনা, তা বোঝার ঠিকঠাক উপায় কোনটা? আমরা তো আর এই ঘোরা চোখে দেখতে পাচ্ছি না!
-“”এ বাবা! এসব তো ভাবি নি কখনো ! আচ্ছা বলো তুমি, আমি শুয়ে শুয়ে শুনব।””
- তুই যেরকম বলছিলি, বছরের হিসেব করার জন্য আমরা সূর্যের চারপাশে একপাক ঘোরার সময়টাকে বোঝাই। কিন্তু সেটা মাপার অনেক রকম উপায়। একটা সহজ পরীক্ষা বলি। ধর, আমরা সামনের বাগানে একটা লাঠি পুঁতলাম। রোজ দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে লাঠিটার ছায়াটা কোন জায়গায় পড়ছে সেটা দাগ দিয়ে রাখলাম। এরকম করলে দেখতে পাবি, রোজ ছায়াটা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। আজ থেকে যদি পরীক্ষাটা শুরু করিস, দেখবি সোয়েটার কম্বলের শীত, প্যাচপ্যাচে ঘেমো গরম, ঝমঝম বৃষ্টি পেরিয়ে যখন আবার শিউলি ফুলের গন্ধ নাকে আসতে শুরু করেছে, তখন একদিন লাঠির ছায়াটা প্রথম দিন যেখানে পড়েছিল সেখানেই আবার ফিরে আসবে। এটাই হল এক বছরের মাপ, প্রায় ৩৬৫ দিনের কাছাকাছি। তবে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার হিসেবে এক বছরের সূক্ষ্ম মাপ হল ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড (৩৬৫.২৪২২ দিন)। সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে থাকা আপেক্ষিক গতি এই হিসেবের জন্য দায়ী বলে, এরকম বছরকে আমরা ‘সৌর বছর’ বলি। অন্যদিকে বহু পুরনো যুগ থেকেই মাসের হিসেব করার জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষই চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধিকেই গুরুত্ব দিত। পূর্ণিমার গোল বিস্কুটের মতন চাঁদে কামড় লাগতে লাগতে অমাবস্যায় সে একদম উধাও। আবার একফালি থেকে ধীরে ধীরে নিজের গোল স্বরূপ ফিরে পাওয়া, এই সময়কালকেই মোটামুটি এক মাস হিসেবে ধরা হত। এই সময়কালটা, অর্থাৎ এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা, বা এক অমাবস্যা থেকে আরেক অমাবস্যা পর্যন্ত সময়টার গড় দৈর্ঘ্য হল ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ সেকেন্ড (২৯.৫৩০৫৯ দিন), বা সাড়ে ঊনত্রিশ দিনের থেকে সামান্য বেশি। যেহেতু চাঁদের গতিবিধির উপর ভিত্তি করে এই মাসের গণনা, এই মাসকে বলে ‘চান্দ্রমাস’। কিন্তু দেখ, দুটো মাপ একে অপরের সাথে কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয়। একটা গণনা সূর্য ভিত্তিক, অন্যটা চন্দ্র ভিত্তিক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সভ্যতার ক্যালেন্ডার ঘাঁটলে আমরা মূলত তিন ধরণের ক্যালেন্ডারের খোঁজ পাব, এই দু’টো গণনার উপর নির্ভর করে।
- “”তিন ধরণের মানে?””
– প্রথমটা হল ‘সৌর ক্যালেন্ডার’। এই ক্যালেন্ডার থেকে চাঁদের পূর্ণিমা, অমাবস্যার গল্প কিন্তু আমরা জানতে পারি না। এই ক্যালেন্ডারে ১২ টা মাস আছে বটে, কিন্তু সেই মাসগুলো তৈরিতে চাঁদের কোনো হাত নেই। আমরা গোটা পৃথিবীর লোকজন যে ক্যালেন্ডার দেখে স্কুল, অফিস যাই, দিন-ক্ষণ মাপজোক করি, সেই গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার কিন্তু একটা সৌর ক্যালেন্ডার।
- “”মানে ইংরেজি ক্যালেন্ডার তো?””
- এই তো ভুল করলি! ইংরেজরা দেশ শাসনের সময় ভারতে এই ক্যালেন্ডার এনেছিল বটে, কিন্তু দূর-দূরান্ত অব্দি ইংরেজদের সাথে এই ক্যালেন্ডারের যোগ নেই। বরং ইংরেজরা বহুদিন এই ক্যালেন্ডারকে স্বীকার পর্যন্ত করে নি। তবে সে গল্প এখন করলে আসল গল্প আর এগোবে না। তাই আবার ফিরে যাই আজকের গল্পে। জানিস কি, ১২ টা চান্দ্রমাস নিয়েও কিন্তু ক্যালেন্ডার তৈরি হয়! একে বলে ‘চান্দ্র ক্যালেন্ডার’। এক একটা চান্দ্র মাসের গড় মাপ সাড়ে ঊনত্রিশ দিনের মত। তাই একটা চান্দ্র বছরের মাপ ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন। বুঝতেই পারছিস, এই ক্যালেন্ডারের এক বছর সৌর ক্যালেন্ডারের এক বছরের থেকে কম। তাই এই ক্যালেন্ডারে ঋতুচক্র পুরো গুবলেট হয়ে যায়। ধর, কোনো ডিসেম্বরের শুরুতে, হালকা শীতে, একটা চান্দ্র বছর শুরু হল। তাহলে পরের ডিসেম্বর আসার ১০-১১ দিন আগেই নভেম্বরে চান্দ্র বছরটা শেষ হয়ে যাবে। এই ভাবে চলতে থাকলে বেশ কিছু বছর পরে আমরা দেখবো গরম কালে জুন জুলাই নাগাদ চান্দ্র বছরটা শুরু হচ্ছে। সভ্যতার শুরুর দিকে বহু দেশে এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন ছিল, কিন্তু এই ঋতুচক্রের গণনায় সমস্যা হওয়ায় এই ক্যালেন্ডার প্রায় বিলুপ্তির পথে হাঁটা দেয়। একমাত্র ব্যতিক্রমী হিসেবে আমরা দেখতে পাই ইসলামী ক্যালেন্ডারকে, যেখানে এখনো বছর গণনা হয় ১২ টি চান্দ্রমাস দিয়ে। ইসলাম ধর্মের সব উৎসব হয় এই চান্দ্র ক্যালেন্ডার মেনে। তাই যদি কখনো দেখতে পাস, কোনো বছর জানুয়ারির শুরুতে কোনো পরব হচ্ছে, একই বছরে (গ্রেগোরিয়ান) ডিসেম্বরের শেষেও সেই পরবে কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারবি, কারণ চান্দ্র ক্যালেন্ডারের হিসেবে সেটা আলাদা দু’টো বছর। তোর জন্মের আগে একবার, ২০০০ সালে ঈদ-উল-ফিতর হয়েছিল দু’বার : ৯ই জানুয়ারী এবং ২৮শে ডিসেম্বরে।
তবে সৌর এবং চান্দ্র ক্যালেন্ডার ছাড়াও বিভিন্ন দেশে আরেক রকম মিশেল ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। এটি হল চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডারে মাসের দৈর্ঘ্য হয় চান্দ্র মাসের মত, কিন্তু সৌর বছরের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য মাস থাকে কখনো ১২ টা, কখনো বা ১৩ টা। ব্যাপারটা হল, চান্দ্রমাস ধরলে যে ১০-১১ দিন কম হয়, সেই দিনগুলো দু-তিন বছর অন্তর একটা বাড়তি মাসের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়। যে বছরে এই নতুন বাড়তি মাসটা ঢোকানো হয়, তাকে বলে অধিবছর। ইহুদি, চৈনিক প্রভৃতি বহু সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক ক্যালেন্ডার এই প্রকৃতির।
এতক্ষন বাদে একটু বিরক্ত হয়েই পেখম বলে উঠল – “” সে সব তো বুঝলাম, কিন্তু দুর্গা পুজোর ব্যাপারটা কখন বলবে?””
- আসব আসব! কিন্তু তার জন্য আমাদের এবার জানতে হবে বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন ক্যালেন্ডার সম্পর্কে। আমাদের বাংলার ক্যালেন্ডার কিন্তু গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতই একটা সৌর ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডারে পূর্ণিমা-অমাবস্যার হিসেব নেই। আমাদের দেশে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা উৎকর্ষতা লাভ করে, যার ফলস্বরূপ লেখা হয় ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’। এই গ্রন্থকে অনুসরণ করেই বাংলার পঞ্জিকাকারেরা তৈরি করেন বাংলার সৌর ক্যালেন্ডার। জানিস ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ -এর সময়ে দিন ক্ষণের হিসেব কি করে রাখা হত? বিভিন্ন তারার অবস্থান দেখে। রাতের আকাশের দিকে তাকালে বুঝতে পারবি, ঋতু বদলের সাথে সাথে আকাশের তারাদের অবস্থানও একটু একটু করে বদলে যায়। এখন যদিও আমরা জানি যে, তারারা কেউই স্থির নয়, তবুও আকাশে তারাদের এই বছরভর স্থান পরিবর্তনের কারণ কিন্তু পৃথিবীর কক্ষীয় গতি। পৃথিবীর কক্ষীয় গতি না থাকলে আকাশে তারাগুলোর অবস্থানের সামান্য পরিবর্তন বুঝতেই কয়েক হাজার বছর লেগে যেত। ছবিটা একটু মন দিয়ে দেখ। পৃথিবীর ‘ক’ অবস্থার জন্য সূর্যের দিক বরাবর কিছু তারা আঁকলাম। এবার চেনার সুবিধার জন্য তারাগুলোকে জুড়ে একটা অবয়ব কল্পনা করে নিতে পারি। আবার পৃথিবীর ‘খ’ অবস্থানে একই ভাবে কিছু তারা চিনে রাখলাম। এরকম ভাবে ১২ মাসের জন্য ১২ টা তারা মন্ডলের আকৃতিকে চিনে রাখতে পারলেই, আকাশে এদের অবস্থান দেখে একটা পুরো বছরের হিসেবে রাখা সম্ভব। এই ১২ মাসের ১২ টা তারা মন্ডল হল ১২ টি রাশি: এই রাশিগুলোকে প্রদক্ষিণ করা থেকেই ‘রাশিচক্র’ কথাটির উৎপত্তি। তবে একটু লক্ষ্য করলেই দেখবি, বাংলা ক্যালেন্ডারের মাসগুলোর দৈর্ঘ্য গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের মাসগুলোর মত নয়। শীতের মাসগুলো, যেমন পৌষ, মাঘ মাসের দৈর্ঘ্য আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি গরমের মাসগুলোর থেকে কম হয়। এটা বুঝতে গেলে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী যে উপবৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করে, সেই পথটার দিকে একবার তাকাতে হবে। এই পথ ধরে পুরো এক চক্কর দেওয়া মানে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে আসা। এইবার আমরা এই কক্ষপথের উপবৃত্তটাকে পিজ্জার মতন করে ১২ টা ভাগে কেটে ফেলব, যাতে প্রত্যেকটা ভাগের বরাতে থাকে ৩০ ডিগ্রী কোণের এক একটা ফালি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল কক্ষপথে প্রত্যেকটা ফালিতে পৃথিবী একই সময় কাটাবে না। পৃথিবী যখন সূর্যের খুব কাছে থাকবে, তার গতিবেগ বেশি থাকবে। ফলে সে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে সেই অংশটা পার করে যাবে। তাই পৃথিবী যখন সূর্যের কাছের অবস্থানে থাকে, সেই সব মাসের দৈর্ঘ্য একটু কম হয়। একই কারণে, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব যখন বেশি থাকে, ৩০ ডিগ্রী কক্ষপথের ফালি পেরোতে তার অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগে। কেপলারের সূত্র থেকে আমরা এই গতিবেগের হিসেবটা মাপতে পারি।
– “”এই দাঁড়াও দাঁড়াও! সবথেকে ছোট মাস পৌষ তো শীতকালেই! তার মানে তুমি বলছ শীতকালে পৃথিবী সূর্যের বেশি কাছে থাকে? মানে অনুসূর বিন্দুর দিকে? আমি স্কুলে পড়েছি, পৃথিবী যখন সূর্যের সবথেকে কাছে থাকে, সেটাকে বলে অনুসূর বিন্দু। আর কক্ষপথের সবথেকে দূরের বিন্দুটা হল অপসূর বিন্দু।””
- একদমই তাই। মজাটা হল, পৃথিবীর ঋতু পরিবর্তনের জন্য অনুসূর অপসূর অবস্থানগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে জিনিসটা দায়ী, তা হল পৃথিবীর অক্ষরেখা। পৃথিবীর কক্ষপথটা যে সমতলে, পৃথিবীর অক্ষরেখাটা সেই তলের উপর পুরোপুরি লম্বভাবে থাকে না, খাড়া অবস্থান থেকে প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রী হেলে থাকে এই অক্ষটা। এই কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে সূর্য থেকে সরাসরি আলো ও তাপ পায়। উত্তর গোলার্ধ যখন সূর্যের সরাসরি দাক্ষিণ্য পায়, তখন কিন্তু উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সে দূরবর্তী অবস্থানে। উত্তর গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল। তাহলে বুঝতেই পারছিস, আমরা অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধের বাসিন্দারা সূর্যের বেশি কাছাকাছি থাকি শীতকালে। সে যাই হোক, এবার মূল গল্পে ফিরি। মোদ্দা কথা হল, বাংলায় ব্যবহৃত ক্যালেন্ডারে কোনো চাঁদের গল্পই নেই , তাহলে শুক্লপক্ষ আসবে কোথা থেকে?
- “”তাই তো ! তাহলে?””
- এইখানেই তো গোলমাল! এই যে আশ্বিনের কথা বলছিস, এটা বাংলা সৌর ক্যালেন্ডারের আশ্বিনই নয়। এটা মূলত উত্তর পশ্চিম ভারতে প্রচলিত চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারের আশ্বিন মাস, যেটা একটা চান্দ্র মাস। হিন্দু ধর্মের বেশিরভাগ উৎসবই হয় এই চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারের হিসেব মেনে। এবারে দুর্গা পুজো বাংলার সৌর ক্যালেন্ডারের কার্ত্তিক মাসে হলেও, চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারের নির্ঘন্ট অনুযায়ী দুর্গাপুজোর বোধন কিন্তু আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতেই। সমস্যাটা হল, সৌর ক্যালেন্ডার এবং চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারের মাসগুলোর নাম একই, তাই এই ভুল বোঝাবুঝি। এখন থেকে নিজেদের বোঝার সুবিধার জন্য মাসগুলোকে আমরা সৌর-আশ্বিন, চান্দ্র-আশ্বিন বলে ডাকব।
– “”সে তো হল! কিন্তু মহালয়ার এক মাস পরে দুর্গাপুজো কেন?””
- ওই যে বলেছিলাম না, ঋতুচক্রের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য দু-তিন বছর অন্তর একটা করে আস্ত মাস গুঁজে দিতে হয় বছরের মধ্যে, এই পদ্ধতিকে বলে নিবেশন। কিন্তু ভারতীয় চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারে এই নিবেশিত বা অতিরিক্ত মাসের কোনো নাম নেই। বৈশাখের আগে মাসটা যোগ করা হলে একে বলে ‘অধিক বৈশাখ’, জ্যৈষ্ঠের আগে যোগ করলে বলে ‘অধিক জৈষ্ঠ্য’ ইত্যাদি। এবারে জিজ্ঞেস করতে পারিস, বছরের যে কোনো জায়গায় কি এই অতিরিক্ত মাসকে গোঁজা যায়? ভারতীয় চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রে কিন্তু এই নিবেশনের কিছু নিয়ম আছে। আমরা যদি ৩৬৫.২৪২২ দিনে এক বছর ধরি, একটা সৌর মাসের গড় ব্যাপ্তি হবে ৩০.৪৩৬৮ দিন। আবার আমরা জানি, একটি চান্দ্র মাসের দৈর্ঘ্য একটি সৌর মাসের থেকে খানিকটা কম, প্রায় ২৯.৫৩০৫৯ দিনের মত। ফলে কখনো এরকম সম্ভাবনা আসতেই পারে যে, একটা সৌর মাস শুরু হবার পরে একটা চান্দ্র মাস শুরু হল, কিন্তু সৌর মাসটা শেষ হবার আগেই চান্দ্র মাসটা শেষ হয়ে নতুন চান্দ্র মাস আরম্ভ হয়ে গেল। অর্থাৎ একটা সৌর মাসের ভেতরেই একটা গোটা চান্দ্র মাস ঢুকে থাকলো। এই রকম মাসকে বাংলায় বলে ‘মলমাস’। ভারতীয় চান্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারে এটাকেই অধিক মাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এবছর এই ‘মলমাস’টি ঢুকেছে চান্দ্র-আশ্বিনের আগে, ‘অধিক আশ্বিন’ হিসেবে। ফলে চান্দ্র-আশ্বিন পিছিয়ে এসে পড়েছে সৌর-কার্ত্তিকে। তবে হিন্দুদের সব ধর্মীয় উৎসব যে সৌর-চান্দ্র মাসের হিসেবে হয়, তা না। বিশ্বকর্মা পুজো হয় বাংলা ক্যালেন্ডারের সৌর-ভাদ্র মাসের শেষ দিনে। তাই দুর্গা পুজো এগোক বা পিছোক, বিশ্বকর্মার কোনো হেলদোল নেই , সে ঠিক সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ নাগাদ হাজির হবে।
- “”এবার বুঝেছি। কিন্তু এই গণনাগুলো কতটা সঠিক?””
- সত্যি বলতে কি, এতে অনেক ভুল আছে। আগেই বলেছিলাম, বাংলার ক্যালেন্ডারের ভিত্তি ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-র গণনা। ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-র হিসেব ধরলে বছরের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৩৬৫.২৫৮৭৬৫ দিন মত, যা প্রকৃত বছরের চেয়ে প্রতি বছরে ২৩ মিনিট ৫০.৫ সেকেন্ড (২৩.৮ মিনিট) বেশি। এর মূল কারণ হচ্ছে পৃথিবীর অক্ষরেখার গতি। পৃথিবীর আহ্নিক এবং বার্ষিক গতি ছাড়াও আরো একটি গতি আছে। পৃথিবীর হেলে থাকা অক্ষরেখাটিও কিন্তু স্থির নয়। একটা লাট্টু নিজের অক্ষে বাঁইবাঁই করে পাক খাবার সময় লাট্টুর আলটাও যেমন পাক খায়, অনেকটা সেই রকমই। তবে এই গতিটি খুবই ধীর। প্রায় ২৫,৮০০ বছর লেগে যায় এক পাক খেতে এই অক্ষরেখার। এই গতির নাম ‘অয়ন গতি’। অয়ন গতিকে না ধরে যে বছরের গণনা হয়, তার নাম ‘নিরয়ণ বর্ষ’। গ্রীক জ্যোতির্বিদ হিপ্পারকোস ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-এর বহু আগেই (১৯০-১২০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দ) এই অয়ন গতির কথা প্রথম জানান। এই গতির হিসেব করে বানানো বছরকে বলে ‘সায়ন বর্ষ’। কিন্তু ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-র হিসেবে মাপজোকের অন্যান্য ত্রুটি ছাড়াও যেটা মুখ্য সমস্যা ছিল, তা হল অয়ন গতির উপেক্ষা এবং নিরয়ণ বর্ষের গণনা। হয়তো অয়ন গতির কথা ভারতীয় জোতির্বিদেরা তখনো জানতে পারেননি। এই ভুলের প্রভাব জানার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যাক। জানিস কি, আমাদের আজকে যে নববর্ষ ১৪ বা ১৫ই এপ্রিল নাগাদ হয়, সূর্যসিদ্ধান্তের সময়কালে, মানে আনুমানিক ১৪০০ বছর আগে, ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা তার জন্য ধার্য করেছিলেন মহাবিষুব সংক্রান্তি বা বাসন্তী বিষুবের দিনকে, যেদিন পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে দিন এবং রাতের দৈঘ্য সমান হয়। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালে বুঝতে পারবি, এই দিনটি ২১শে মার্চ নাগাদ আসে। অর্থাৎ ১৪০০ বছরে বাংলার সৌর বছরের ২৩.৮ মিনিটের ছোট্ট তফাৎ জমা হতে হতে নববর্ষ ২৩ দিন মত পিছিয়ে গেছে।
-“”কিন্তু এখন তো এই হিসেবগুলো আমরা জানি। তাহলে কেউ ভুলগুলো শুধরে দেয় নি?””
- কই আর হলো রে ! ১৮৯০ সাল নাগাদ বাংলা ক্যালেন্ডারে কিছু সংশোধন করা হয়েছিল বটে, এখন যাকে ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’ মত বলে, সেখানেও কিন্তু অয়ন গতির ব্যাপারটা ধরাই হল না। এই ক্যালেন্ডারের সঙ্গেও তাই সায়ন বছরের গণনার তফাৎ প্রায় ২০ মিনিট ২৩.৪ সেকেন্ডের। এমনকি, নতুন এই ক্যালেন্ডারটির সঙ্গে পুরনো ক্যালেন্ডারটিও পাশাপাশি চলছে, সেটাও খারিজ হয় নি। এই দুই ক্যালেন্ডারের হিসেবের তফাতের জন্য ১৯৮৪ সালে দু’বার করে দুর্গা ও কালী পুজোর তিথি পড়েছিল বলে শুনেছি। অথচ, বহু আগেই ১৯৫৫ সাল নাগাদ পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি দল নিযুক্ত হয়েছিল। সেই সময়ে পৃথিবীর অয়ন গতির গণনা ঢুকিয়ে শোধরানো হয় ভারতীয় ক্যালেন্ডারের গোলমেলে হিসেব। বিজ্ঞান সম্মত ভাবে একটা ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকা’ তৈরি করে আগের ভুল পঞ্জিকাগুলো বাতিল করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু আমরা নতুন জিনিস এত সহজে মেনে নেব কেন? বাংলার পঞ্জিকা তাই এখনো ‘নিরয়ণ বর্ষ’ নিয়েই মেতে আছে।
- “”কি বাজে ব্যাপার ! আমরা কি কোনোদিন ঠিক হিসেবগুলো দিয়ে ঠিকঠাক পঞ্জিকা বানাবো না?””
– বিজ্ঞানীরা সে রকম প্রস্তাব দিয়েই থাকেন। কিন্তু তোকে বলেছিলাম না, গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার মানতে ইংরেজদেরই প্রায় ১৭০ বছর সময় লেগে গেছিল, আমাদেরও হয়তো সে রকম আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে!
- “”সেই গল্পটা বলবে? গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার কি পুরোপুরি সঠিক?””
- সে আরেক গল্প। ওটা বরং ক্রিসমাসের কেক খেতে খেতে বলব, কেমন?
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।