~ কলমে এলেবেলের অতিথি সৈকত চক্রবর্তী ঠাকুর ~
সারাদিন কালো মেঘ করে আছে। যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে। তাই আজকে বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়া হল না। তার বদলে কাঁচা পেয়াঁজ আর সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি চানাচুর মাখা নিয়ে সবাই গোল হয়ে বসেছে দাদুর কাছে গল্প শুনবে বলে। কদিন আগে বুবুন দাদুর কাছে শক্তি নিয়ে গল্প শুনে বন্ধুদের বলেছিল (মনে আছে? নাহলে একবার সেই গল্প শুনে আসুন – শক্তির উপাসনা: আদি পর্ব)। তাই আজ তারাও এসেছে। সবাই যখন এসে হাজির, দাদুকে এবার গল্প বলতেই হবে।
দাদু কোথা থেকে শুরু করবে ভাবছে। আসলে দাদুর বয়স হয়েছে তো, তাই বেশির ভাগ জিনিসই ভুলে যায়। দাদু নিজেই ভুলে গেছে যে বুবুনকে আগের দিন কি বলেছিল। তখন দাদুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। শুধু গল্প বলাই নয়, মাঝে মাঝে ছোট ছোট প্রশ্ন করলে ওরাও একসাথে গল্প আড্ডায় জড়িয়ে যাবে। গল্প আড্ডায় ওরাও যদি সঙ্গী হয়, তাহলে আরো মনোযোগ দিয়ে শুনবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ।
- বাহ্ তোমরা সবাই এসে গেছ। কি নিয়ে আজ আমাদের গল্প হবে?
বুবুন বলল “”শক্তি-র গল্প।”” - ও হ্যাঁ, শক্তির উপাসনার গল্প। তা বল তো, শক্তি কত রকম হতে পারে?
প্রায় একসাথেই সবাই বলল “”অনেক রকম: যেমন যান্ত্রিক শক্তি, রাসায়নিক শক্তি, তাপ শক্তি।””
দাদু মনে মনে একটু হাসল, কারণ আগের দিন বুবুনকে যে তিন রকম নাম বলেছিল, ওরা ঠিক সেগুলোই মুখস্থ করে নিয়েছে। ভাবল, একটু অন্য রকম করে বলতে হবে, যাতে শুধু নাম জানলেই হবে না, শক্তি নিয়ে ওরা নিজেরাই যেন ভাবনা চিন্তা করতে পারে। - আসলে জানো তো শক্তি আরও অনেক রকম হতে পারে। সেটা তোমাদের পরে একটা তালিকা করে দেব। কিন্তু শুধু নাম মুখস্থ না করে আমরা বরং ভাবি যে শক্তি বলতে আমরা কি বুঝি?
গুটুন একটু বড়, তাই অন্যদের আগেই হাত তুলে উত্তর দিল “”শক্তি মানে কাজ করার ক্ষমতা।”” - একদম ঠিক। ভাবতে পারো যে কোনও রকম কাজ করতে গেলে শক্তি ব্যবহার করতে হবে। শক্তি না থাকলে কোনও কাজই করা যায় না। এবার তোমরা একেক রকম কাজ ভাব, তাহলেই বুঝতে পারবে সেটা করতে কি রকম শক্তি দরকার পড়ছে।
“”রান্না করতে আগুন লাগে, শরীর ঠিক রাখতে খাবার খেতে হয়, টিভি চালাতে বিদ্যুৎ লাগে, ঘুড়ি ওড়াতে গেলে হাওয়ার শক্তি কাজে লাগে, গাড়ী চালাতে তেল লাগে – এই রকম?”” জিজ্ঞাসা করল গুটুন। - ঠিক। তোমরা দেখছি শক্তি নিয়ে অনেক কিছুই জানো। তাহলে আজ তোমাদের বলি শক্তির সাথে আমাদের মানব সভ্যতার কি সম্পর্ক। তোমরা কি জানো যে মানুষের ইতিহাসে যখনই কোনও বড় পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো প্রত্যেকটিই কিন্তু কোনও না কোনও নতুন ধরণের শক্তির উপর নির্ভর করে এসেছে। বা একই শক্তিকে নতুন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, কোনও নতুন প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে। আচ্ছা তোমরাই আমায় বল দেখি যে মানব সভ্যতার ইতিহাসে বড় বড় পরিবর্তনের ধাপগুলো কি কি?
পাশের বাড়ির দুই বোন টুনা আর মুনা খুব মন দিয়ে শুনছিল। ওদের মা ইতিহাসের অধ্যাপক, কাজেই ওদের বাড়িতে ইতিহাস নিয়ে অনেক বই আছে। তাছাড়া, পাড়ার লাইব্রেরিতে ওদের সদস্যপদ আছে। পাড়ায় সবাই জানে যে বয়স আন্দাজে টুনা আর মুনা দুজনেই সাধারণ জ্ঞানে অনেক এগিয়ে। মুনা বলল “”আগুন-এর আবিষ্কার, জন্তুদেরকে পোষ মানান, কৃষি কাজের আবিষ্কার, শহর ভিত্তিক সভ্যতা, রেনেসাঁ আর শিল্প বিপ্লব।””
মুনার উত্তরে দাদু একদম মুগ্ধ। এতো গুছিয়ে বলল মুনা।
- বাহ্ একদম ঠিক। এবার তোমরা সবাই ভেবে দেখো যে প্রত্যেকটা ঘটনার সাথে কোনও না কোনও শক্তি এবং শক্তি উৎস কেমন করে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে। এবং সত্যিই যদি ভালো করে ভাবি, তাহলে দেখবো যে তাপ শক্তির বলেই পৃথিবী চলে। সেই আদিম যুগ থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত আমরা তাপ শক্তির বিভিন্ন প্রকার ব্যবহারকে কেমন করে আমাদের কাজে লাগিয়ে চলেছি।
মনুষ্য জাতির বিবর্তনের প্রথম দিকের মানুষেরা আবিষ্কার করেছিল কীভাবে আগুন তৈরি এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
- প্রথম ধাপ হলো আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করা। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে মানুষের কাছাকাছি অন্যান্য যত প্রাণী ছিল যেমন শিম্পান্জী (chimpanzee), গরিলা (gorilla), বোনোবো (bonobo) ইত্যাদি-দের থেকে আদিম যুগের মানুষকে আলাদা করে দেয় এই আগুনকে বাগে আনার ঘটনাটা। মনুষ্য জাতির বিবর্তনের প্রথম দিকের মানুষেরা যখন আবিষ্কার করেছিল কীভাবে আগুন তৈরি এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাদের জীবন অনেক ক্ষেত্রেই অনেক সহজ হয়েছিল। উষ্ণতা, আলো এবং সুরক্ষার জন্য তারা আগুনকে কাজে লাগত। তাছাড়া যে খাবার কাঁচা অবস্থায় চিবানো এবং হজম করা কঠিন, সেটা আগুন দিয়ে রান্না করতে পারলে, কাঁচা খাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টি দেয়। ইদানীং নৃতত্ত্ববিদ-রা (anthropologists) ভাবেন যে হয়তো আগুন দিয়ে রান্না করে খেতে পারাটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ জন্তু থেকে মানুষ প্রজাতি হয়ে ওঠার জন্যে। আগুন দিয়ে রান্না করলে অনেক সহজেই মাংস জাতীয় খাবার হজম করা যায়। মাংস জাতীয় খাবারে বেশি পরিমান প্রোটিন থাকে। তাই রান্না করে খাওয়া এবং ভালো করে হজম করতে পারাটা তৎকালীন মানুষের মস্তিষ্ক-এর আয়তন বৃদ্ধি পেতেও সাহায্য করে। যেটা ছাড়া মানব সভ্যতা এগনো একদম সম্ভব ছিল না। তাই সেভাবে দেখলে, আগুন থেকে পাওয়া তাপ শক্তিই আমাদের মানুষ করে তোলে। এবার তোমরা ভেবে বল দেখি আমরা কি কি ভাবে রান্না-র জন্যে আগুন তৈরী করি?
এবার ছোট বোন টুনা বলল “”আমরা তো রান্না ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করি। “”
বুবুন তো আগেই ভেবে রেখেছে “”আর পিকনিক করার সময় কাঠ পুড়িয়ে রান্না হয়। “”
যোগ দিল মুনা “”বেথুয়াডহরী-তে কাকুর বাড়িতে কয়লা আর ঘুঁটে দিয়ে উনুন জ্বালাতে দেখেছি। আর কাকী আগে থেকেই কয়লা-র গুড়ো জোগাড় করে গুল দিয়ে রাখত। তাছাড়া মনে হয় কাঠকয়লাও দিত।””
দাদু তো শুনে খুব খুশি। - একদম ঠিক। এই প্রত্যেক ক্ষেত্রে জ্বালানির মধ্যে জমে থাকা রাসায়নিক শক্তি প্রথমে তাপ শক্তিতে পরিণত হচ্ছে আর তা দিয়ে আমরা রান্না করছি, যেটা কিনা আবার আমাদের শক্তি দেবে, যা দিয়ে আমরা আমাদের গায়ের জোর বাড়াবো আর অনেক কাজ করতে পারবো। এরকম ভাবে শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিণত হতে থাকে।
রাসায়নিক শক্তি প্রথমে তাপ শক্তিতে পরিণত হচ্ছে আর তা দিয়ে আমরা রান্না করছি।
মুনা সবসময় স্বাধীন চিন্তা ধারা বজায় রাখে। ও একটা নতুন কথা তুলল “”কিন্তু জানো দাদু, কয়লার উনুন-এর ধোঁয়ায় আমার খুব কষ্ট হয়েছিল নিঃশ্বাস নিতে। তাই বাবা বলছিল যে এবার কাকুদের গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে নেওয়া উচিত। মনে হয় সবার তাই করা উচিত, তাহলে পৃথিবী থেকে অনেক দূষণ কমবে।””
- একদম ঠিক বলেছ মুনা। তুমি এত সহজে বুঝতে পারছ, কিন্তু সত্যিই খুব দুঃখের কথা যে বৈজ্ঞানিক ভাবে আমাদের এত প্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, এখনও ভারতবর্ষে প্রায় ৫০% লোকজন (মানে প্রায় ৬৫ কোটি লোকজন) কাঠ, ঘুঁটে বা কাঠকয়লা দিয়ে রান্না করে। আর সারা পৃথিবীতে সেই সংখ্যাটা প্রায় ২০০ কোটি। পৃথিবীর জন সংখ্যা প্রায় ৭৮০ কোটি। তাহলে দেখ, প্রতি ৪ জন মানুষের মধ্যে ১ জন কাঠ জ্বালিয়ে রান্না করে। এবার ভাব, যদি এদের সবাইকে গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত এবং তা কি করে ব্যবহার করতে হয়, সেটা শেখানো যেত, তাহলে পৃথিবীতে দূষণ কতটা কমতে পারতো। জানো তো, বিভিন্ন জায়গায় এই নিয়েও গবেষণা চলছে যে কোনও নতুন ধরণের উনুন বানানো যায় কিনা, যেটা কাঠ দিয়েই চলবে কিন্তু অনেক কম ধোয়া বের হবে। সেই গবেষণা সফল হলেও অনেক মানুষের অনেক ভালো হবে।
সবাই চুপ করে শুনছে আর ভাবছে – সত্যি তো। এটা আগে ভাবিনি। কারণ পাড়ায় সবার ঘরেই গ্যাস সিলিন্ডার আছে। এবং তা থেকে এতো কম ধোয়া হয়, যে সবাই শুধু ভাবত বাস বা ট্যাক্সি থেকেই কেবল দূষণ হয়। রান্নার জ্বালানি থেকে দূষণের কথা কারো মাথায় আসেনি কোনদিন। - শুধু রান্নায় নয়, আগুন যদি ভালো উচ্চ মানের পাথরের উনুন, যাকে আমরা ভাঁটি বা চুল্লি বলে থাকি, এর মধ্যে ধরে রাখা যায় এবং তার তাপমাত্রা যথেষ্ট পরিমানে বাড়ানো যায়, তা দিয়ে বিভিন্ন রকম ধাতু, যেমন তামা বা লোহা গলানো যায়। তা দিয়ে তখন অস্ত্র, বাসন, মূর্তি যা ইচ্ছে বানানো যায়। এর উপরে ভরসা করে বড় বড় সব সভ্যতা গড়ে ওঠে। তাছাড়া তোমরা কখনো ইঁট ভাঁটা দেখেছ? ওখানেও দেখবে যে কাঁচা মাটির ইঁট কেমন করে চুল্লিতে পুড়িয়ে শক্ত ইঁট বানানো হয়।
তাই কি আমরা দেখতে পাই যে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে তাম্র, ব্রোঞ্জ, লৌহ এই সব যুগ গুলো এসেছিল?
এসব শুনে সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। আগুন থেকে তৈরী তাপ শক্তি দিয়ে যে এত কিছু করা যায় সেটা কেউ আগে ভাবেনি। একমাত্র মুনা চিন্তিত ভাবে ভুরু কুঁচকে বলল “”ও আচ্ছা, তাই কি আমরা দেখতে পাই যে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে তাম্র, ব্রোঞ্জ, লৌহ এই সব যুগ গুলো এসেছিল?””
- একদম ঠিক। এখনও আমরা ধাতু নিয়ে অনেক পড়াশোনা এবং গবেষণা করি, যাকে বলে ধাতুবিদ্যা (metallurgy), এবং শুধু তাই নয়, যদি কয়লা জ্বালিয়ে জল গরম করে তাকে বাষ্পে পরিণত করা যায়, আর ঠিক করে ব্যবহার করা যায়, তা দিয়ে তখন বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বানানো যায়। তা থেকেই তো প্রথম রেল গাড়ি, প্রথম উন্নত মানের বাষ্প চালিত জাহাজ ইত্যাদি তৈরী হয়। এমনও একটা সময় ছিল যে ঘোড়ার গাড়ি আর বাষ্প চালিত রেল গাড়ির মধ্যে লড়াই হতো কে জিতবে। আর ঘোড়ার শক্তির সাথে তুলনা করেই তো শক্তিকে মাপা হয় অশ্বশক্তি(Horse –power) দিয়ে। সেটা দু ভাবে ভাবতে পারো। ২৫০ কেজি ওজন যদি ১ সেকেন্ড-এ ১ ফুট উপরে তোলা যায়, বা ৭৫ কেজি ওজন যদি ১ সেকেন্ড-এ ১ মিটার উপরে তোলা যায়, তাহলে যে পরিমান শক্তি লাগে সেটাকে ১ অশ্বশক্তি বলা হয়।
দাদু আর কিছু বলার আগেই ফোন বেজে উঠল। টুনা, মুনা-র মা ফোন করেছে। বিকেল কখন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। সবাই মন দিয়ে দাদুর কাছে তাপ শক্তির গল্প শুনতে ব্যস্ত ছিল। - আজ তাহলে এখানেই শেষ করছি। পরের বার তোমাদের বলব কয়লা বা তেল-এর ইতিহাস। বা ধরো শক্তির উপর নির্ভর করে কি করে শিল্প বিপ্লব এলো। কিংবা তার রেশ ধরে আমরা এখন কি কি উপায়ে শক্তি উৎপাদন করি। তার ভালো মন্দ দুই আছে। দুই দিকটাই আমরা দেখবো।
“”The Hunting Apes: Meat Eating and the Origins of Human Behavior, by Prof. Craig Stanford, University of Southern California””
“Catching Fire: How Cooking Made Us Human, by Prof. Richard Wrangham, Harvard University”
এই দুটি বইয়ের পর্যালোচনা করা আছে এখানে: https://core.ac.uk/download/pdf/18586161.pdf
সৈকত সান দিয়াগোতে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ার (UCSD) সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ-এ (CER) কর্মরত বিজ্ঞানী।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
এলেবেলে – Elebele