~ এলেবেলে দেবারুন ও এলেবেলে শুভব্রত
————————————————————-
কয়েকদিন আগেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আকাশে অপরূপ সুন্দর মেরুজ্যোতি দেখা গেছে। প্রকৃতির এই আলোর রংয়ের পরিবর্তন সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু ঠিক কি কারণে এরকম দেখা যায়?
নামের উৎপত্তি
অরোরা বোরিয়ালিস শব্দটা বানিয়েছেন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি। ভোরবেলার (dawn) রোমান দেবী aurora এবং বায়ুর গ্রীক শব্দ boreas মিলে তৈরি হয় aurora borealis।
কারণ
প্রতি এগারো বছর অন্তর, সূর্যের সক্রিয়তার (activity) পরিবর্তন ঘটে, যেরকম ২০২৫ সালে এই সক্রিয়তা সর্বোচ্চ স্তর পৌঁছতে চলেছে। এই সময়ে, সূর্য তার উপরিস্থিত করোনা (corona) অংশ থেকে চার্জযুক্ত কণার (energised particle) বাতাস বেশি পরিমাণে তৈরি করে। এই কনা পৃথিবীর আয়নস্ফিয়ার (ionosphere) অংশে এসে আঘাত করে। সৌরঝড়ের তীব্রতা যতবেশি হয়, ততো এই আধানযুক্ত কণার নিঃসরণ বেশি হয়।
এবার আমাদের পৃথিবীর একটা চৌম্বকক্ষেত্র আছে। যখন সূর্য থেকে শক্তিসম্পন্ন কনা (charged particle) তীব্র বেগে (৪৫ মিলিয়ন মাইল বা ৭২ মিলিয়ন কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়) পৃথিবীতে ছুটে আসে, তখন কণাগুলো পৃথিবীর এই চৌম্বকক্ষেত্রের চৌম্বকরেখা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিচ্যুত হওয়ার পর, উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর দিকে ছুটে যায়। ফলস্বরূপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাথে এই কণাগুলোর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয় ছোটো ছোট বিস্ফোরণের যা আমাদের চোখে বিভিন্ন রকম রং হিসেবে ধরা দেয়। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে একে বলে অরোরা বরিয়ালিস (aurora borealis) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এক বলে অরোরা অস্ট্রালিস (aurora australis)। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের সাথে উপস্থিতি এবং এদের সাথে ওই উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণাদের বিক্রিয়াই হলো এই মেরুজ্যোতির উজ্জ্বল রংয়ের কারণ।
এই মেরুজ্যোতিতে বিভিন্ন রকম রং দেখা যায় যেমন লাল, নীল, সবুজ এবং বেগুনি।
আলোর এরকম নড়াচড়া এবং আকৃতির কারণ কি?
এর কারণ হলো সূর্যের উপরের অংশ থেকে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণা নিঃসরনের ক্রমাগত পরিবর্তন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপাদানের পরিবর্তন, পৃথিবীর গতি এইগুলো। অরোরা বোরিয়ালিস এর বিভিন্ন রকম আকৃতি থাকলেও পর্দা বা curtain আকৃতিই সবথেকে বেশি দেখা যায়। এছাড়াও আছে আর্ক (arc) এর মতন আকার, যেটা অরোরা শুরু হওয়ার একদম প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায় এবং প্রায় ১০০০ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত থাকে। শুধু তাই নয় ব্যান্ড (band) এবং প্যাচের (patch) মতন আকারও দেখা যায়।
অরোরা থেকে কি জানা যায়?
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক উপাদান, বায়ুর গতি, বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব এবং বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কারেন্ট সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। এদের থেকে আবার পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র, এর পরিবর্তন এবং মহাকাশে এর প্রসারণ সম্পর্কে জানতে পারা যায়। বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহকে রক্ষা করার জন্য অরোরা নিয়ে গবেষণা খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
বিভিন্ন রং
অরোরার বিভিন্ন রকম রংয়ের কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের উপস্থিতি, বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব, শক্তির পরিমাণ ইত্যাদি। যখন সৌরঝড়ের চার্জযুক্ত ইলেকট্রন এসে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন গ্যাসে আঘাত করে, তখন গোলাপী বা লালচে রং দেখা যায়, এর উচ্চতা থাকে ১০০ কিলোমিটার মতন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে । তবে অরোরাতে সবথেকে বেশি দেখা যায় সবুজ রং। ১০০-৩০০ কিলোমিটার উচ্চতায় অক্সিজেনের সাথে চার্জযুক্ত কণার সংঘর্ষের ফলে এই সবুজ রং সৃষ্টি হয়। একটু গাঢ় রং দেখা যায় যখন আধানযুক্ত কণাগুলোর অক্সিজেনের সাথে সংঘর্ষ হয়। নীল এবং বেগুনি রং তৈরি হয় বায়ুমণ্ডলে হিলিয়ামের উপস্থিতির কারণে, যদিও এই নীল এবং বেগুনি রং সবসময়ে আমাদের চোখে ধরা পড়েনা।
প্রভাব
সৌরঝড়ের ফলে আমাদের সরাসরি ক্ষতি না হলেও, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কৃত্রিম উপগ্রহের ক্ষতিসাধন হতে পারে। এছাড়াও বিদ্যুৎ সরবরাহও বিঘ্নিত হতে পারে। কারণ, সৌড়ঝড়ের ফলে আগত আধানযুক্ত কণার সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্রে একটা ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে এর চৌম্বকরেখা গুলো প্রচুর পরিমাণে তড়িৎ সৃষ্টি করে, যা আবার প্রবাহিত হয় মাটিতে পাতা বিদ্যুৎবাহী তারের মধ্য দিয়ে। এরপর এই তড়িৎ স্থানীয় পাওয়ার স্টেশনগুলোতে পৌঁছলে, সংলগ্ন ট্রান্সফরমারগুলো (transformer) এত পরিমাণে বিদ্যুতের লোড একসাথে নিতে পারেনা, ফলস্বরূপ শর্ট সার্কিট হয়।
_______________________