কলমে এলেবেলে দেবদীপ

কল্পবিজ্ঞানের গল্পে আমরা প্রায়ই শুনি প্লাজমা রশ্মি, আয়ন ক্যানন কিংবা অত্যাধুনিক শক্তি প্রযুক্তির কথা। কিন্তু বাস্তবে প্লাজমা প্রযুক্তি আজ আর শুধুমাত্র কল্পনা নয়, এটি আমাদের চিকিৎসা, পরিবেশ এবং দৈনন্দিন জীবনে বিপ্লব আনতে শুরু করেছেইতিমধ্যেই! বিশেষত প্লাজমা ত্বরণ (Plasma Acceleration) প্রযুক্তি এমন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে যা একইসাথে বিজ্ঞানসম্মত এবং মানবকল্যাণমুখীও বটে ।
প্লাজমা ত্বরণ কী?
প্রথমে বুঝে নেওয়া যাক প্লাজমা কী? ছোটবেলার ভৌতবিজ্ঞানের বই থেকে আমরা জানি পদার্থের মূলতঃ তিনটি অবস্থা: কঠিন, তরল ও গ্যাস। তাই তো? আর প্লাজমা হলো চতুর্থ অবস্থা, যেখানে গ্যাসের পরমাণুগুলো এতটাই উত্তপ্ত বা শক্তিপ্রাপ্ত হয় যে তাদের ইলেকট্রন আলাদা হয়ে যায়। ফলে তৈরি হয় আয়নিত গ্যাসের সমুদ্র – যাকে আমরা প্লাজমা বলি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মহাবিশ্বের ৯৯% পদার্থই আসলে প্লাজমা অবস্থায় আছে; সূর্য, তারা সবই প্লাজমার তৈরি। আর সেই কিনা আমাদের কাছে এত কম পরিচিত!
সহজ কথায়- প্লাজমা ত্বরণ প্রযুক্তিতে এই আয়নিত গ্যাসকে ব্যবহার করে অত্যন্ত শক্তিশালী তরঙ্গ তৈরি করা হয়, যার ওপর চড়ে কণাগুলো (ইলেক্ট্রন, প্রোটন, আয়ন ইত্যাদি) দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে পারে – অনেকটা যেন সার্ফিং স্পোর্টস যেখানে একটি বোর্ড ব্যবহার করে সার্ফাররা সমুদ্রের ঢেউয়ে চড়ে এগিয়ে আসে। কণাদের উচ্চ পর্যায়ে ত্বরান্বিত করতে প্রচলিত পার্টিকেল এক্সিলারেটরগুলো যেখানে কিলোমিটার স্কেলে দীর্ঘ হয়, সেখানে প্লাজমা এক্সিলারেটর মাত্র কয়েক মিটারেই একই শক্তি অর্জন করতে পারে। এর কারণ হলো প্লাজমা তরঙ্গের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব:
ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন আশা
ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। কিন্তু বর্তমানে যেসব পার্টিকেল এক্সিলারেটর ব্যবহার করা হয়, সেগুলো বিশাল, ব্যয়বহুল এবং শুধুমাত্র বড় শহরের মুষ্টিমেয় দু-একটা হাসপাতালেই থাকে। প্লাজমা ত্বরণ প্রযুক্তি এই চিত্র পাল্টে দিতে আগামীদিনে সক্ষম । কম্প্যাক্ট প্লাজমা-ভিত্তিক রেডিয়েশন সিস্টেম ছোট হাসপাতালেও স্থাপন করা যাবে। যার অর্থ – দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষও অনেক কম খরচে অত্যাধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসা পাবেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রযুক্তিতে রশ্মির নির্ভুলতা এতটাই বেশি যে সুস্থ কোষের ক্ষতি কমিয়ে শুধু টিউমার কোষগুলোকে লক্ষ্য করা যায়।
এছাড়া প্লাজমা এক্সিলারেটর থেকে উৎপন্ন রশ্মি এবং ইমেজিং সিস্টেম অনেক দ্রুত এবং স্পষ্ট ছবি তৈরি করতে পারে। এর ফলে যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া কিংবা হৃদরোগ নির্ণয় হতে চলেছে আরও নিখুঁত এবং দ্রুত।
জীবাণুমুক্তকরণ
হাসপাতালে সংক্রমণ আরেকটি বড় সমস্যা। প্লাজমা প্রযুক্তি দিয়ে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি, ড্রেসিং সামগ্রী এমনকি ক্ষত পর্যন্ত অনেক বেশি দক্ষতার সাথে জীবাণুমুক্ত করা যায়, আর তাও কোনো ক্ষতিকারক রাসায়নিক বা বিকিরণ (irradiation) ছাড়াই। এটি বিশেষভাবে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ।
পরিবেশ রক্ষায় প্লাজমার ভূমিকা:
শক্তি সাশ্রয়
যেমন বলা হয়েছে ওপরে, প্লাজমা এক্সিলারেটরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর আকার এবং শক্তি খরচ। একটি প্রচলিত পার্টিকেল এক্সিলারেটর সচল রাখতে যেখানে বিশাল বিদ্যুৎ খরচ হয় (উদাহরণস্বরূপ- ইউরোপের বিখ্যাত সার্ন ফেসিলিটির দৈনিক বিদ্যুৎ খরচ প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমতুল্য), একটি প্লাজমা সিস্টেম তার ১/১০০০ ভাগ আকারে একই কাজ করতে পারে বিপুল বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে । আর সঙ্গে বলাই বাহুল্য- কম/ছোট পরিকাঠামো মানে কম নির্মাণ সামগ্রী, কম কার্বন নিঃসরণ।
বর্জ্য পরিশোধন
শিল্প এবং হাসপাতাল থেকে নির্গত বিপজ্জনক রাসায়নিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই অসুবিধে নিয়ে কম বেশি নাস্তানাবুদ না হতে হওয়া পুরসভার সন্ধান পাওয়া গোটা বিশ্বেই দুস্কর। প্লাজমা প্রযুক্তি এসব বর্জ্যকে আণবিক স্তরে ভেঙে ফেলতে সক্ষম , ফলে তারা আর ক্ষতিকর থাকে না। এমনকি প্ল্যাস্টিক বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্যও প্লাজমা টর্চ দিয়ে নিরাপদভাবে পরিশোধন করা যায় অনেকাংশেই ।
জল ও বায়ু বিশুদ্ধকরণ
প্লাজমার আরেকটি বায়োলজিক্যাল উপকারিতা স্বরূপ বলা যায় প্লাজমা-ভিত্তিক জল বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থার কথা, যা কোনো রাসায়নিক যোগ না করেই ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক অপসারণ করতে পারে। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর্সেনিক এবং ভারী ধাতব দূষণ-অধ্যুষিত এলাকায়। একইভাবে, কারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিশোধনেও প্লাজমা ফিল্টার ব্যবহার শুরু হয়েছে ।
খাদ্য সংরক্ষণ
আধুনিক দ্রুত গতির দৈনন্দিন রুটিনে খাদ্য-পণ্যে রাসায়নিক প্রিজারভেটিভ ব্যবহারের প্রকোপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আদতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্লাজমা দিয়ে খাদ্য প্যাকেজিং জীবাণুমুক্ত করা যায় এমনকি খাবারের পচন কিছু সময়ের জন্য ঠেকানো যায়, আর তাও কোনো রাসায়নিক ছাড়াই; ফল স্বরূপ খাবার যেমন বেশিদিন সতেজ ও জীবাণুমুক্ত থাকে তেমনই খাদ্য অপচয়ও কমানো যায়
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: ফিউশন শক্তি
সম্ভবত প্লাজমা প্রযুক্তির আগামীদিনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর প্রয়োগ হলো ফিউশন শক্তি উৎপাদনে। সূর্যে যেভাবে হাইড্রোজেনের পরমাণু মিলিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে শক্তি উৎপন্ন হয়, সেই একই প্রক্রিয়া পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে করা গেলে আমরা পেতে পারব অসীম, পরিচ্ছন্ন শক্তি। সেই লক্ষ্য অর্জনে ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, জাপান, ইউকে, স্পেনের মতো দেশ ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট ফিউশন, প্লাসমা ফিজিক্স, এনার্জি এফিসিয়েন্সি, ম্যাটেরিয়ালস সাইন্স-সম্পর্কিত গবেষণায় লিপ্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সামনের পথ:
তবে যে কোনো নতুন প্রযুক্তিরই যেমন কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে, প্লাজমা ত্বরণও অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নয়। কিছু কিছু নজির ও সীমিত ব্যবহার বাদ দিলে প্লাজমা ত্বরণ প্রযুক্তি এখনো গবেষণাগার থেকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে যাওয়ার পথে। প্লাজমার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা তথা তার ওপর নিয়ন্ত্রণ, দীর্ঘ সময় ধরে একই মানের রশ্মি উৎপাদন ও বজায় রাখা এবং ব্যয় আরও কমানো – এসব ক্ষেত্রে গবেষণা চলছে বিশ্বব্যাপী।
প্লাজমা ত্বরণ এখন তাই আর শুধু একটি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়, এটি আমাদের চিকিৎসা, পরিবেশ এবং শক্তি সংকট সমাধানের একটি বাস্তব হাতিয়ার হয়ে উঠছে । যে প্রযুক্তি একসময় শুধু পদার্থবিজ্ঞানীদের স্বপ্ন ছিল, তা আজ হাসপাতাল, কারখানা এবং জল শোধনাগার, বিমানবন্দর নিরাপত্তায় প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগামী দশকের জন্য আমরা আশা রাখতে পারি যে হয়তো দেখতে পাব – প্রতিটি জেলা সদরে কম্পাক্ট প্লাজমা-ভিত্তিক ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র, ছোট শহরাঞ্চলে প্লাজমা দ্বারা জল বিশুদ্ধকরণ ইউনিট, পরিচ্ছন্ন, নবায়নযোগ্য শক্তি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ছোট গবেষণাগারেও কম্প্যাক্ট টেবিল-টপ এক্সিলারেটরে কর্মরত ছাত্র ছাত্রী… ইত্যাদি ইত্যাদি ।
বৈজ্ঞানিক এডওয়ার্ড টেলার বলেছিলেন- “আজকের বিজ্ঞান আগামীকালের প্রযুক্তি”। বা আমাদের প্রিয় এ. পি. জে. আব্দুল কালাম বিজ্ঞানকে “মানবতার জন্য একটি সুন্দর উপহার” হিসেবে বর্ণনা করে গেছেন । সত্যি ই তো, বিজ্ঞান যখন মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে, তখনই তার প্রকৃত সার্থকতা। প্লাজমা ত্বরণ ঠিক সেই পথেই এগিয়ে চলেছে – পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষাগার থেকে সাধারণ মানুষের জীবনে।
কৃতজ্ঞতা:
Milestone 10-GeV Experiment Shines Light on Laser-Plasma Interactions
Milestone in plasma acceleration | ScienceDaily
Plasma-based accelerators articles within Nature Communications
Disinfection and Sterilization Using Plasma Technology: a Biological Applications