~কলমে অম্লান রায়
মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম কে না শুনেছে? তাঁর ভর-শক্তির রূপান্তরের বিখ্যাত সূত্রটি অর্থাৎ E=mc2 মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রীরাও জানে। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র নন, তাঁরাও অনেকেই এই সূত্রটির কথা শুনেছেন। E=mc2 সূত্রটি বলে, যদি m পরিমাণ ভরকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, তাহলে mc2 পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে, যেখানে c হচ্ছে শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ (এক সেকেন্ডে ৩০ কোটি মিটার)। শূন্য মাধ্যমে আলোর এই অকল্পনীয় গতিবেগের ফলে, এই সূত্র অনুযায়ী মাত্র এক গ্রাম যে কোন পদার্থকে শক্তিতে পরিণত করলে ২.৫ কোটি বৈদ্যুতিক ইউনিট (kWh) শক্তি পাওয়া যায়। তুলনা করার জন্য জানাই সমগ্র বাংলাদেশে গড়ে এক দিনে ২৭ কোটি বৈদ্যুতিক ইউনিট শক্তি ব্যবহার করা হয় এবং ভারতবর্ষে এক দিনে ৫০০ কোটি বৈদ্যুতিক ইউনিট শক্তি ব্যবহার করা হয় । অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের এক দিনের বিদ্যুতের চাহিদা যথাক্রমে মাত্র ১০ গ্রাম ও ২০০ গ্রাম মতন পদার্থকে শক্তিতে পরিণত করলেই মিটে যাবে।
তবে অবশ্য সরাসরি পদার্থকে শক্তিতে পরিণত করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায় এখনো জানা নেই। আমাদের বেশিরভাগ বিদ্যুৎ আসে কয়লা বা জ্বালানী পুড়িয়ে অথবা নদীর স্রোতকে বাঁধের সাহায্যে আটকে। কয়লা বা জ্বালানী পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আমরা রাসায়নিক শক্তিকে আংশিকভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত করি। আর জলবিদ্যুত কেন্দ্রে জলের গতিশক্তিকে আংশিকভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত করি। ভারতে ৩% মতন বৈদ্যুতিক শক্তি আসে পরমাণু চুল্লি থেকে। এই পরমাণু চুল্লির ক্ষেত্রেই E=mc2 ফর্মুলা অনুযায়ী অল্প পরিমাণ পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরের কথা সাধারণত বলা হয়। পরমাণুর কথা জানা থাকলেও অল্প একটু বলি। পরমাণু হচ্ছে একটা মৌলের ক্ষুদ্রতম কণা, যার মধ্যে সেই মৌলের সব রাসায়নিক ধর্ম থাকে। পরমাণুর ব্যাসার্ধ আমাদের মাথার একটা চুল যত সরু তারও লক্ষ ভাগের এক ভাগ মাত্র। পরমাণুর মাঝখানে থাকে আয়তনে খুব ছোট ধনাত্মক তড়িৎযুক্ত একটা নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রক, যার মধ্যে পরমাণুর প্রায় সব ভর থাকে এবং তাঁর চারদিকে বিভিন্ন কক্ষপথে থাকে অনেক কম ভরের ঋণাত্মক তড়িৎযুক্ত ইলেকট্রনেরা। নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনগুলি মিলিয়ে পরমাণু তড়িৎনিরপেক্ষ হয়। নিউক্লিয়াস ধনাত্মক তড়িৎযুক্ত প্রোটন ও তড়িৎ-নিরপেক্ষ নিউট্রন কণিকা দ্বারা গঠিত হয়। নিউক্লিয়াসের প্রোটনগুলির মধ্যে বৈদ্যুতিক বিকর্ষণ বল থাকলেও, এক প্রবল শক্তিশালী আকর্ষণী বলের প্রভাবে প্রোটন ও নিউট্রনগুলি একত্রে আবদ্ধ হয়ে পরমাণুর নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রক গঠন করে। এই প্রবল শক্তিশালী আকর্ষণী বলকে গুরু বল বলে এবং এর পাল্লা নিউক্লিয়াসের মধ্যেই (অর্থাৎ এক সেন্টিমিটারের এর লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগ মতন দূরত্ব) সীমাবদ্ধ থাকে। সেইজন্য দৈনন্দিন জীবনে আমরা এর কোন প্রভাব বুঝতে পারি না।
নিউট্রন কণিকার আঘাতে একটা ইউরেনিয়াম মৌলের নিউক্লিয়াস মোটামুটি সমান ভরের অন্য দুটি মৌলে বিভাজিত হয়ে যায়। এই বিভাজনের ফলে পাওয়া মৌল দুটির নিউক্লিয়াসের মোট ভর ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের ভরের চেয়ে ০.১% কম হয় এবং এই ০.১% ভর শক্তিতে পরিণত হয়। পরমাণু চুল্লিতে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসের এই বিভাজন ঘটিয়ে E=mc2 ফর্মুলা অনুযায়ী (০.১% ভর শক্তিতে রূপান্তরের ফলে) যে তাপশক্তি পাওয়া যায়, তাকে আংশিকভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত করা হয়। বড় নিউক্লিয়াসের বিভাজন না ঘটিয়ে, হালকা নিউক্লিয়াসদের (যেমন হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস) সংযোজিত করে নিউক্লিয়াসের প্রায় ১% ভরকে শক্তিতে পরিণত করা যায়। এই ভাবে হাইড্রোজেন সংযোজিত হয়ে হিলিয়ামে পরিণত হলে, যে ১% ভর শক্তিতে পরিণত হয়, তা সূর্যের শক্তির উৎস হিসাবে কাজ করে।
পরমাণু শক্তির ক্ষেত্রে যে E=mc2 ফর্মুলা অনুযায়ী কিছু পরিমাণ ভর শক্তিতে পরিণত হয়, তাতো আজকাল স্কুলেও পড়ানো হয়। কিন্তু রাসায়নিক শক্তি, তাপ শক্তি, আলোক শক্তি, যান্ত্রিক শক্তি, এই সব ক্ষেত্রেও কি অল্প পরিমাণ ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে? এই প্রশ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের মনে আসতেই পারে এবং তা নিয়েই আলোচনা করছি। এক কথায় উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, সব রকম শক্তির উৎসই এই E=mc2 ফর্মুলা, তবে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক কালে।
প্রথমে E=mc2 ফর্মুলাটা এল কি করে, তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে (১৯০০ সালে), পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের বলবিদ্যা এবং ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। নিউটনের বলবিদ্যাকে ব্যবহার করে নদীর উপর ব্রিজ বানানো থেকে শুরু করে কামানের গোলার পাল্লা ও যাত্রাপথ সঠিকভাবে গণনা করা যেত। অপরদিকে কুলম্ব, অ্যাম্পিয়ার, ফ্যারাডের পরীক্ষামূলক কাজ থেকে বিদ্যুৎ ও চুম্বকের নানান ধর্মের কথা জানা ছিল। ম্যাক্সওয়েল এই সব পরীক্ষালব্ধ তথ্যকে একটা সুসংহত গাণিতিক রূপ দেন এবং তাদের অসম্পূর্ণতা লক্ষ করেন। অসামান্য দূরদর্শয়িতায় ম্যাক্সওয়েল এই অসম্পূর্ণ সমীকরণগুলিকে সম্পূর্ণ করেন এবং তাদের থেকে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের কথা বলেন। এই কথাও জানা যায় যে আলো হচ্ছে উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ এবং আরও অসংখ্য কম্পাঙ্কের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আছে। এই আবিষ্কারগুলির ভিত্তিতে বৈদ্যুতিক আলো, পাখা, ডায়নামো, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এই সব নিয়ে এক বিরাট বৈদ্যুতিক শিল্প গড়ে উঠেছিল। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হল। কলকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজে জগদীশচন্দ্র বসু এবং ইটালিতে Marconi তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে বেতারে সংবাদ পাঠালেন।
কিন্তু একটা তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দিল। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে দেখা গেল শূন্য মাধ্যমে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতিবেগ সর্বদাই অপরিবর্তিত থাকে (সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কোটি মিটার)। নিউটনের বলবিদ্যা থেকে তো আমরা জানি যে কোন কিছুর গতিবেগ কারুর সাপেক্ষে বলতে হয়। যেমন আমার সাপেক্ষে একটা ট্রেনের গতিবেগ হয়ত ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার, কিন্তু সমান্তরাল পথে একই দিকে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার বেগে চলমান একটা বাসের সাপেক্ষে ওই ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার মাত্র। শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রেও তাই হয়। শব্দের চেয়ে দ্রুত গতিতে ছুটলে শব্দ তরঙ্গ পিছিয়ে পড়ে। তাহলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে কি বলছে? প্রথমে ভাবা হয়েছিল ইথার নামে এক অদৃশ্য সর্বব্যাপী মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ যায় এবং এই ইথার মাধ্যমের সাপেক্ষেই ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ সত্য। কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষাগুলোয় অনেক চেষ্টা করেও ইথারের কোন সন্ধান পাওয়া গেল না এবং দেখা গেল যে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর গতির (সেকেন্ডে প্রায় ৩০ হাজার মিটার) সমান্তরাল দিকে ও তার বিপরীতে আলোর গতিবেগ একই থাকে। এর ভিত্তিতে আইনস্টাইন বলেন, বিভিন্ন পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আপেক্ষিক বেগ থাকলেও, তারা সবাই শূন্য মাধ্যমে যে কোন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের একই গতিবেগ (সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কোটি মিটার) দেখবে। অর্থাৎ আমি স্থির থাকি বা আলোক রশ্মির সমান্তরাল দিকে সেকেন্ডে ১৫ কোটি মিটার বেগে দৌড়াই, আমার সাপেক্ষে আলোর বেগ সর্বদাই সেকেন্ডে ৩০ কোটি মিটারই থাকবে। এর ভিত্তিতে আপেক্ষিক বেগ গণনার প্রচলিত সূত্রটির তিনি পরিবর্তন করেন এবং আপেক্ষিক বেগের এই পরিবর্তিত সূত্র ব্যবহার করলে দেখা যায় যে কোন বস্তুর গতিবেগ শূন্য মাধ্যমে আলোর বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতিবেগের (সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কোটি মিটার) চেয়ে বেশি হতে পারে না।
আপেক্ষিক বেগের এই নতুন ধারণার ফল সুদূর-প্রসারী হল। এর থেকেই ভরের আপেক্ষিকতার ধারণা আসে। একটা বস্তুর ভর বলতে আমরা বুঝি, বস্তুর মধ্যে কতটা পদার্থ আছে এবং তা আপাত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ বলেই মনে হয়। কিন্তু আমাদের বিচার করতে হবে কি ভাবে একটা বস্তুর ভরের পরিমাপ করা যায়? কোন বস্তুকে একটা নির্দিষ্ট বেগে গতিশীল করতে কতটা শক্তি লাগে, অর্থাৎ তার গতিশক্তি থেকে বস্তুটির ভরের হিসাব করা যায়। আমরা জেনেছি যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী কোন বস্তুর গতিবেগ শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না। অর্থাৎ একটা বস্তুর গতিবেগকে বাড়িয়ে শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগের কাছে পৌঁছতে হলে, তার গতিশক্তি অসীমের (infinity) কাছে হতে হবে, তাই আর গতিবেগ বাড়ানো যায় না। শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ (সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কোটি মিটার) অনেক বেশী হলেও, অসীম নয়। কিন্তু গতিশক্তি অসীম হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং অবশ্যই বস্তুর গতিবেগ বৃদ্ধির সাথে তার ভর বাড়ছে এবং শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির কাছাকাছি গতিবেগ হলে, ভর প্রায় অসীম হয়ে যায়। অর্থাৎ একটা বস্তু আমার সাপেক্ষে স্থির থাকলে তার যা ভর মাপবো, বস্তুটি গতিশীল হলে তার বেশী ভর মাপবো। তবে বস্তুটির গতিবেগ শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগের কাছাকাছি না এলে, এই ভর বৃদ্ধি খুবই সামান্য হয়। বস্তুর ভর ও গতিশক্তির এই সম্পর্ক থেকেই আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত E=mc2 ফর্মুলা পান।
কাজেই E=mc2 ফর্মুলার সাথে পরমাণু শক্তির কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই। একটা বস্তুকে গরম করলে তার অণু-পরমাণুর গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী, তার অণু-পরমাণুর ভর বেড়ে যায়। এই বর্ধিত ভর কে c2 দিয়ে গুণ করলে, বর্ধিত তাপশক্তি পাওয়া যায়। এই হিসাবে এক লিটার (১ কিলোগ্রাম) জলের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ালে, তার ভর এক শতাংশের হাজার কোটি ভাগের কয়েক ভাগ মাত্র বাড়বে এবং এই বর্ধিত ভরই তার তাপশক্তি। অন্যদিকে পরমাণু শক্তির ক্ষেত্রে ০.১% -১% পর্যন্ত ভর শক্তিতে পরিণত হয়। তাই পরমাণু শক্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া সহজ এবং সেখানেই প্রথম E=mc2 ফর্মুলার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।
অতএব বোঝা গেল যে গতিশক্তি ও তাপশক্তির ক্ষেত্রেও আমরা শক্তি বৃদ্ধিকে E=mc2 ফর্মুলার সাহায্যে বুঝতে পারি। এখন রাসায়নিক শক্তির কথায় আসা যাক। একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রন তাদের তড়িৎক্ষেত্রের আকর্ষণী বলের দ্বারা যুক্ত হয়ে একটা হাইড্রোজেনের পরমাণু গঠন করে। এর বন্ধন শক্তি অর্থাৎ ইলেকট্রনকে পরমাণু থেকে আলাদা করতে ১৩.৬ ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি লাগে। ব্যবহারিক এককে একটা পরমাণুর বন্ধন শক্তি একেবারেই নগণ্য, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এক গ্রাম হাইড্রোজেনে বিপুল সংখ্যক হাইড্রোজেনের পরমাণু আছে। পরমাণুর এই বন্ধন শক্তিই হল রাসায়নিক শক্তি এবং এর মূলে আছে বৈদ্যুতিক আকর্ষণ। E=mc2 ফর্মুলার সাহায্যে কি আমরা এই রাসায়নিক বন্ধন শক্তি বুঝতে পারি? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ পারি। একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর একটা প্রোটন ও ইলেকট্রনের মিলিত ভরের চেয়ে খুব সামান্য কম হয় এবং এই ভরের পার্থক্যকে c2 দিয়ে গুণ করলে হাইড্রোজেন পরমাণুর বন্ধন শক্তি পাওয়া যায়। তবে এর জন্য প্রোটন, ইলেকট্রন ও হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর খুব সূক্ষ্মভাবে জানা প্রয়োজন এবং তা সাম্প্রতিক কালেই সম্ভব হয়েছে।
Penning Trap নামে একটা যন্ত্র বানিয়েছিলেন আমেরিকার সিয়াটেল শহরে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক Hans Georg Dehmelt। একটা শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ও দুর্বল তড়িৎক্ষেত্রের সাহায্যে এই যন্ত্রে একটা প্রোটন বা ইলেকট্রন বা যে কোন তড়িৎযুক্ত আয়নকে ফাঁদে ফেলে আটকানো যায়। ফাঁদে পড়া কণাটি জটিল কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। এই কক্ষপথে কণাটির বৃত্তাকার গতি থাকে এবং তার সাথে থাকে পেন্ডুলামের মত দোলন গতি। এই দোলনের কম্পাঙ্কের সাথে কণাটির ভরের সম্পর্ক আছে এবং দোলনের কম্পাঙ্ক খুব নির্ভুলভাবে মাপা যায়। তার ফলে কণাটির ভর খুব নির্ভুলভাবে জানা যায়। এই কাজের জন্য Hans Georg Dehmelt ১৯৮৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে অতি উচ্চ সূক্ষ্মতায় ইলেকট্রন ও প্রোটনের ভর মাপা হয়েছে। এই পরিমাপ থেকে জানা যায় যে একটা ইলেকট্রন ও প্রোটনের মোট ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরেরে চেয়ে ১৩.৬ ইলেকট্রন ভোল্ট বেশী হয় (শক্তি এককে)। একইভাবে কয়লা পুড়িয়ে যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি পাওয়া যায়, সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। কয়লা পোড়ানোর প্রাথমিক রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে C+O2 CO2 +তাপ। এখানেও কার্বন পরমাণু ও অক্সিজেন অণুর মোট ভর কার্বনডাইঅক্সাইড অণুর ভরের চেয়ে সামান্য বেশী হয় এবং এই অতিরিক্ত ভরকে c2 দিয়ে গুণ করে রাসায়নিক তাপশক্তি পাওয়া যায়।
জলের স্রোতের শক্তিও জলের অণুগুলির মোট ভর বৃদ্ধিকে (স্থির জলের তুলনায়) c2 দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যায়। একটা যান্ত্রিক ঘড়িতে দম দিলেও, তার ভর বাড়ার কথা। কারণ দম দেবার ফলে ঘড়ির উপাদানের অণুগুলোর শক্তি বাড়ে। একটা মোবাইল ফোনকে চার্জ দিলেও তার ভর বাড়বে, কারণ সে শক্তি পাচ্ছে। তবে এই ভরবৃদ্ধিগুলো এতোই সামান্য যে এখনো মাপা সম্ভব হয় নি। তবে ২০২০ সালে জার্মানির Max Planck Institute of Nuclear Physics (Heidelberg) এ তে Klaus Blaum ও তাঁর সহযোগীরা Penning trap যন্ত্রের সাহায্যে মেপে দেখেন যে একটা পরমাণু বিকিরণ শোষণ করলে তার ভর বেড়ে যায়, ঠিক যেমন আইনস্টাইনের E=mc2 ফর্মুলা থেকে আশা করা হয়। কাজেই আমরা বলতে পারি সব শক্তির মূলেই রয়েছে আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc2 সূত্রটি।
একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে এই E=mc2 সূত্রটি কতদূর সূক্ষ্মতায় সত্য? এর কি কোন সীমাবদ্ধতা আছে, যা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বেরও সীমাবদ্ধতা হয়ে যায়? ২০০৫ সালে বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় আমেরিকার Massachusetts Institute of Technology এর গবেষক Simon Rainville ও তাঁর সহযোগীরা মিলে এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সালফারের একটি আইসোটোপ (32S) একটা নিউট্রন কণিকা শোষণ করে 33S হয়ে যায় ও একটা গামা রশ্মির কণিকা বা ফোটন ছেড়ে দেয়। সমীকরণের আকারে লিখলে হয় n+32S33S + গামা ফোটন । Penning trap ও অন্যান্য যন্ত্রের সাহায্যে তাঁরা খুব উচ্চ সূক্ষ্মতায় নিউট্রন, 32S ও 33S এর ভর নির্ণয় করলেন। তারপর নির্গত গামা রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব উচ্চ সূক্ষ্মতায় মাপলেন ও তার থেকে একটা গামা রশ্মির কণিকা বা ফোটনের শক্তি বলা যায়। E=mc2 সূত্রটি সত্য হলে নিউট্রন ও 32S এর ভরের যোগফল থেকে 33S এর ভরের বিয়োগফলকে c2 দিয়ে গুণ করলে তা গামা ফোটনের শক্তির সমান হবে। পরীক্ষায় দেখা গেল যে তাই হয় এবং অন্তত এক কোটি ভাগের চার ভাগ সূক্ষ্মতায় (০.০০০০৪% সূক্ষ্মতায়) E=mc2 সূত্রটি সত্য। আরও উচ্চ সূক্ষ্মতায় E=mc2 সূত্রটির সত্যতা পরীক্ষার চেষ্টা চলছে। দেখা যাক E=mc2 সূত্রের কোন সীমাবদ্ধতা পাওয়া যায় কি না?