~ কলমে এলেবেলে দেবদীপ ~
‘”কণা পদার্থবিদ্যা” (particle physics) হল পদার্থবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা যা পদার্থ ও বিকিরণের মৌলিক উপাদান এবং তাদের মধ্যেকার ইন্টারঅ্যাকশন নিয়ে গবেষণা করে। এই শাখার একটি নির্দিষ্ট অংশ “হাই এনার্জি ফিজিক্স” নামেও পরিচিত। কণা পদার্থবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্রে, গবেষণালব্ধ নতুন নতুন কণার আবিষ্কার আমাদের মহাবিশ্বের বর্তমান ধারণাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে দিতে পারে বৈকি! আমাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১২ সালে হিগস বোসনের আবিষ্কারের মাধ্যমে CERN-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC) বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। সম্প্রতি, সার্নের বিজ্ঞানীরা এমন কিছু অসঙ্গতি (anomaly) লক্ষ্য করেছেন যা নতুন এক ‘বোসন’ কণার সম্ভাব্য অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়, আর এটা প্রকৃতির মৌলিক শক্তিগুলির (Fundamental Laws/Forces of Nature) ওপর নতুনভাবে আলোকপাত করতে পারে।
“স্ট্যান্ডার্ড মডেল” ও এর সীমাবদ্ধতা:
‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ দীর্ঘদিন ধরে কণা পদার্থবিদ্যার মূল ভিত্তি স্বরূপ উপ-পারমাণবিক কণাসমূহের (subatomic particles) গঠন এবং তাদের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশন ব্যাখ্যা করে আসছে। সামগ্রিকভাবে এটি আমাদের প্রকৃতির বল/শক্তি এবং চেনা-অচেনা পদার্থ সম্পর্কে এক সাধারণ অথচ গুরত্বপূর্ণ ধারণা প্রদান করে। এমনকি এই মডেল কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতেও সক্ষম। তবে, কিছু সীমাবদ্ধতা স্বরূপ এটি মহাবিশ্বের সবকিছুও ব্যাখ্যা করতে সমর্থ নয়! যেমন- স্ট্যান্ডার্ড মডেল ব্যাখ্যা করতে পারেনা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে, ফলে এটি সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (General Theory of Relativity)-র সাথে বেমানান; স্ট্যান্ডার্ড মডেল বর্তমানে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ- কেন কণাদের ভর তার উপাদানগুলির ভরের যোগফলের চেয়ে অনেক গুণ বেশি; স্ট্যান্ডার্ড মডেল ‘ম্যাটার’ এবং ‘অ্যান্টি-ম্যাটারের’ মধ্যে বৈষম্য ব্যাখ্যা করে না; স্ট্যান্ডার্ড মডেল আমাদেরকে ‘ডার্ক ম্যাটারের’ (যা দিয়ে অধিকাংশ মহাবিশ্ব তৈরি) গঠন সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারেনা। এরকম কোনো কোনো মহাজাগতিক রহস্যের সমাধান করতে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে নতুন বোসনগুলির আবিষ্কার হতে পারে সেই চাবিকাঠি।
বোসন (Bosons) কী?
তো, এই বোসন কণারা কারা? ‘বোসন’ হল এক প্রকার প্রাথমিক কণা (elementary particles), যা মহাবিশ্বের মৌলিক শক্তিগুলির বাহক (carrier) হিসেবে কাজ করে অন্যান্য কণাকে ভর প্রদান করে থাকে। মোদ্দা কথা- বোসন হল এক খুবই সামাজিক কণা, যারা না থাকলে এই ব্রম্ভাণ্ডে সবকিছুই খুব নিস্তেজ আর ছাড়াছাড়া হয়ে থাকত। বোসন নাম বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামাঙ্কিত, যিনি বিংশ শতাব্দির বিশের দশকে আমাদের সবার পরিচিত বোসন কণা – ফোটন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন। আরেক বহুল পরিচিত বোসন হল যা ২০১২ সালে আবিষ্কৃত ‘হিগস বোসন’ কণা।
সার্ন-এ পর্যবেক্ষিত অস্বাভাবিকতা:
সার্নের “লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার” (এলএইচসি) বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী কণা ত্বরক (accelerator) এবং একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপারকন্ডাক্টিং চুম্বকের রিং, যা ক্ষুদ্রতম কণাগুলি অন্বেষণ করতে পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়। এর বৃত্তাকার টানেল ১৭ মাইল (২৭ কিলোমিটার) ব্যাসার্ধ এবং মাটির ৫০-১৭৫ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। বিজ্ঞানীরা এলএইচসি ব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ওই অজানা প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে সচেষ্ট । (এলএইচসি সম্পর্কে বিশদে জানতে আমার পুরোনো এই লেখাটি পড়তে পারেন।)
সম্প্রতি, এখানে কোনো কোনো পরীক্ষা এমন কিছু অসঙ্গতি সনাক্ত করেছে যা কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পূর্বাভাসের সাথে মেলে না। বিজ্ঞানীদের অনুমান সত্যি হলে- এই অস্বাভাবিকতাগুলি আসলে এমন নতুন কোনো বোসনের উপস্থিতির ইঙ্গিত, যা এখনও পর্যবেক্ষণ করা যায়নি । কিছু সময় আগে “এলএইচসি-বি” কোলাবোরেশনের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন- তিনটি নতুন অনাবিষ্কৃত উপ-পারমাণবিক কণার সন্ধান পাওয়ার কথা: একটি নতুন ধরনের “পেন্টাকোয়ার্ক” এবং একজোড়া “টেট্রাকোয়ার্ক” । কোয়ার্ক হল এক মৌলিক উপকণিকা, যা প্রোটন, নিউট্রনের মতো কণাগুলি গঠন করে। কোয়ার্কগুলির ছয়টি ধরন বা “ফ্লেভার” রয়েছে: আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ এবং বটম। কোয়ার্কগুলি শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে ‘গ্লুয়ন’ নামক আরেক উপকণিকার দ্বারা । কোয়ার্ক স্ট্যান্ডার্ড মডেলের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
নতুন বোসনের প্রভাব-
নতুন বোসনের আবিষ্কার শুধু একটি বৈজ্ঞানিক সাফল্য হিসেবেই ধরা হবেনা, এটি আমাদের মহাবিশ্বের ধারণার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন:
● বিয়ন্ড স্ট্যান্ডার্ড মডেল: যেমন আগে বলা হয়েছে- স্ট্যান্ডার্ড মডেল কয়েক দশক ধরে কণা পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হয়ে এসে থাকলেও, এর সীমাবদ্ধতাগুলো মডেলটিকে সম্পূর্ণ হতে দেয়নি । নতুন বোসন এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরে বেরিয়ে উপরোক্ত ধাঁধার অনুপস্থিত অংশগুলো প্রদান করতে পারে, যা ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির মতো ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য হয়তো এক নতুন দিশা দেবে।
● শক্তির/বলের ঐক্যবন্ধন: পদার্থবিজ্ঞানের একটি লক্ষ্য হল চারটি মৌলিক শক্তি/বল (মাধ্যাকর্ষণ বল, তড়িৎচৌম্বকত্ব বল, দুর্বল পারমাণবিক বল এবং শক্তিশালী পারমাণবিক বল)-কে একটি একক তত্ত্বে একীভূত করা (Theory of Everything)। নতুন বোসন এই একীকরণে ভূমিকা পালন করতে পারে, সঙ্গে উচ্চ শক্তির উপস্থিতিতে এই বলগুলির ইন্টারঅ্যাকশন সম্পর্কে সূত্র প্রদান করতে পারে।
● প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: বিগত কয়েক দশক ধরে আমরা সাক্ষী থেকেছি যে, কণা পদার্থবিজ্ঞানে আবিষ্কার প্রায়ই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দিকে নিয়ে যায়। সার্নে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (www.) বিকাশ এর একটি প্রধান উদাহরণ। নতুন বোসন-সংক্রান্ত গবেষণা আগামীদিনে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং মেটেরিয়াল সাইন্স-র মতো ক্ষেত্রে অগ্রগতিকে অনুপ্রাণিত করবে বলে অনুমান।
ভবিষ্যতের পথ: চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
তবে বলাই বাহুল্য- নতুন বোসনের সম্ভাব্য আবিষ্কার কেবল হিমশৈলের চূড়া মাত্র, সামনে অনেক পথ চলা বাকি। তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে এবং তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি বোঝার জন্য আরও পরীক্ষা এবং তথ্য বিশ্লেষণ (data analysis) প্রয়োজন। এই গবেষণাটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে নতুন পথ উন্মুক্ত করতে পারে বৈকি এবং মহাবিশ্বের রহস্য অন্বেষণ করতে ভবিষ্যত প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবে।
পরিশেষে বলা যায়-, সার্নে পর্যবেক্ষিত অসঙ্গতি/অস্বাভাবিকতাগুলি একটি আকর্ষণীয় ইঙ্গিত যে আমাদের জানা ও অজানা মহাবিশ্বের (known and unknown universe) মৌলিক উপাদান সম্পর্কে আরও অনেক কিছু শেখার আছে। কণা পদার্থবিজ্ঞানের গভীরতায় ডুব দিয়ে অধিকতর অনুসন্ধান তথা এই নতুন বোসনের আবিষ্কার আমাদের মহাবিশ্বের ধারণাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে পারে এবং আগামীদিনে যুগান্তকারী উদ্ভাবনের পথ প্রশস্ত করবে।
——————————-
দেবদীপ বর্তমানে ইংল্যাণ্ডে অ্যাক্সিলারেটর ও বিম-ডায়গনস্টিক সংক্রান্ত আর-এণ্ড-ডি গবেষক।