ডাক্তারবাবুরা কোথাও চোট লাগলে হাড় ভেঙেছে কি না দেখার জন্য “এক্স রে” করতে বলেন, শরীরের ভিতরে কোথাও টিউমার হয়েছে কি না জানতে সেই জায়গাটার স্ক্যান করতে বলেন। শরীরের কোন একটা জায়গার এক্স রে বা স্ক্যান করা মানে, সেই জায়গায় শরীরের ভিতরের ছবি তোলা। অনেক রকমের স্ক্যানের কথা বলা হয়। তার মধ্যে কয়েকটি বহুল প্রচলিত স্ক্যান, যেগুলো ক্যান্সার সন্দেহে অনেক সময়ে করতে বলে হয়, সেগুলা হছে CT scan, PET scan ও MRI scan। অনেকের মনে হয়ত প্রশ্ন আসে কি ভাবে এই এক্স রে ও স্ক্যানগুলি কাজ করে? কেমন করে শরীরের ভিতরের ছবি তোলা হয়? এইসবের মূল নীতিগুলি পদার্থবিদ্যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। তাই নিয়েই দুই-চার কথা বলছি।
শরীরের ভিতরের ছবি তোলার মূল নীতিগুলি বোঝার জন্য পরমাণু ও বিকিরণ সংক্রান্ত কয়েকটি কথা বলা দরকার। আমাদের আশেপাশে দেখা প্রায় সব পদার্থই পরমাণু দিয়ে গঠিত। তবে পরমাণু এতই ছোট যে চোখে দেখা যায় না। লোহার একটা ছোট কণাকে যদি প্রায় ১৫০ কোটি গুণ বড়ো করে দেখা সম্ভব হত , তাহলে বোঝা যেত যে কণাটি অতি ক্ষুদ্র পরস্পর সংলগ্ন লোহার পরমাণু দিয়ে গঠিত। একটা পরমাণুকে মোটামুটিভাবে একটা গোলক ভাবলে, তার ব্যাসার্ধ আমাদের মাথার একটা চুল যত সরু তার লক্ষ ভাগের এক ভাগ মাত্র। একটা পরমাণুর মাঝখানে ধনাত্মক তড়িৎযুক্ত আঁটোসাঁটো খুব ছোট একটা কেন্দ্রক থাকে। এই কেন্দ্রক ধনাত্মক তড়িৎযুক্ত প্রোটন ও তড়িৎ-নিরপেক্ষ নিউট্রন কণা দিয়ে গঠিত। কেন্দ্রকের চারিদিকে বিভিন্ন কক্ষপথে প্রোটন বা নিউট্রনের চেয়ে প্রায় ২০০০ গুণ হালকা ঋণাত্মক তড়িৎযুক্ত ইলেকট্রনরা ঘুরতে থাকে। একটা প্রোটন ও ইলেকট্রনের বৈদ্যুতিক আধানের মান সমান, কিন্তু প্রোটন ধনাত্মক ও ইলেকট্রন ঋণাত্মক তড়িৎযুক্ত।
আরেকটা কথা হল বেতার তরঙ্গ, সাধারণ আলো, এক্স রে বা রঞ্জন রশ্মি, এই সবই তড়িৎ- চুম্বকীয় তরঙ্গ, অর্থাৎ তড়িৎ ও চুম্বক ক্ষেত্রের আন্দোলন বা দোলন। তাদের মধ্যে পার্থক্য শুধু কম্পাঙ্কের, অর্থাৎ এক সেকেন্ডে কতবার তড়িৎ বা চৌম্বক ক্ষেত্র তাদের দোলন সম্পূর্ণ করছে। বেতার তরঙ্গের চেয়ে সাধারণ আলোর কম্পাঙ্ক অনেক বেশি, আবার সাধারণ আলোর চেয়ে রঞ্জন রশ্মির কম্পাঙ্ক অনেক বেশি। সব তড়িৎ- চুম্বকীয় তরঙ্গই শূন্য মাধ্যমে এক সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে যায়। তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য তার কম্পাঙ্কের ব্যস্তানুপাতিক হয়।
এক্স রে
ডাক্তারবাবু যখন “এক্স রে” করতে বলেন, তখন তিনি রঞ্জন রশ্মির (এক্স রে) সাহায্যে শরীরের কোন জায়গার হাড়ের ছবি তুলতে বলেন। কেন রঞ্জন রশ্মি দিয়ে ছবি তুলতে বলেন? কারণ সাধারণ আলো শরীরের অধিকাংশ জায়গার ভিতরে ঢুকতে পারে না। বেতার তরঙ্গ শরীরে ঢুকতে পারলেও , তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য এত বড় হয়, যে তা দিয়ে শরীরের ভিতরের ছবি তোলা যায় না। রঞ্জন রশ্মি অনায়াসে শরীরের ভিতরে ঢুকতে পারে এবং খুব ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বলে, তা দিয়ে শরীরের ভিতরের ছবি তোলা যায়। কিন্তু কেমন করে রঞ্জন রশ্মি পাওয়া যাবে? আমরা জেনেছি, যে কোন ধাতু পরমাণু দিয়ে গঠিত এবং পরমাণুতে ইলেকট্রন আছে। ধাতুর মধ্যে কিছু ইলেকট্রন প্রায় মুক্ত অবস্থায় থাকে এবং একটা ধাতুকে গরম করে তার থেকে ইলেকট্রন বের করা যায়। তারপর উচ্চ তড়িৎ বিভব (৫০,০০০-১৫০,০০০ ভোল্ট) ব্যবহার করে ইলেকট্রনগুলিকে ত্বরান্বিত করে উচ্চ শক্তির ইলেকট্রনের স্রোত পাওয়া যায়। এই ইলেকট্রনের স্রোতকে কোন ধাতব পাতের উপর ফেলে হঠাৎ থামিয়ে দিলে ইলেকট্রনের গতিশক্তির খুব অল্প অংশ (মাত্র 1%) উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎ- চুম্বকীয় তরঙ্গ বা রঞ্জন রশ্মিতে পরিণত হয়। এইভাবে সৃষ্ট রঞ্জন রশ্মি প্রধানত ইলেকট্রনের গতির অভিমুখে যায় এবং একটা রঞ্জন রশ্মির আলোক কণার গড় শক্তি প্রায় ৪০,০০০ ইলেকট্রন ভোল্ট হয়।
রঞ্জন রশ্মি মূলত পরমাণুর ইলেকট্রনের সাথে সংঘাতের ফলে শোষিত হয়। কাজেই মাধ্যমের পরমাণুর ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়লে সেই মাধ্যমে রঞ্জন রশ্মির শোষণ খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে যায়। তবে মাধ্যমের একক আয়তনে পরমাণুর সংখ্যা বেশি হলেও রঞ্জন রশ্মির শোষণ বেশি হয়। রঞ্জন রশ্মি মানুষের দেহের উপর ফেললে, শরীরের রক্ত, মাংস, চর্বি ইত্যাদি এই রশ্মি বিশেষ শোষণ করতে পারে না, কারণ ঐগুলি প্রধানত হাইড্রোজেন(ইলেকট্রনের সংখ্যা =১),অক্সিজেন(ইলেকট্রনের সংখ্যা =৮)ও কার্বন (ইলেকট্রনের সংখ্যা =৬) পরমাণু দিয়ে তৈরি। অপরদিকে শরীরের হাড় ক্যালসিয়াম পরমাণু (ইলেকট্রনের সংখ্যা =২০) দিয়ে তৈরি বলে হাড়েতে রঞ্জন রশ্মির শোষণ অনেক বেশি হয়। তাই এক্স রে প্লেটে হাড়ের জায়গাগুলি সাদা এবং মাংস ও চর্বি অপেক্ষাকৃত ধূসর দেখায়।
কম্পুউটারের সাহায্যে রঞ্জন রশ্মি দিয়ে ত্রিমাত্রিক ছবি (Computerized Tomography Scan বা CT Scan)
মানব শরীরের মাংস, চর্বি, টিস্যু ইত্যাদির রঞ্জন রশ্মি শোষণ ক্ষমতা হাড়ের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু তারাও কিছুটা শোষণ করে এবং তাদের মধ্যে দিয়ে যাবার ফলে আপতিত রঞ্জন রশ্মির প্রাবল্য অল্প হলেও কিছুটা কমে। রঞ্জন রশ্মির প্রাবল্যের এই হেরফের ফটোগ্রাফিক প্লেটে ভালভাবে ধরা যায় না। কিন্তু রঞ্জন রশ্মির প্রাবল্য মাপার সংবেদনশীল যন্ত্রে তা ধরা পড়ে। বিভিন্ন দিক থেকে শরীরের একটা কোন বিশেষ অংশে রঞ্জন রশ্মি ফেলে ও তার বিপরীতে রঞ্জন রশ্মির প্রাবল্য মাপার সংবেদনশীল যন্ত্র রেখে যে তথ্য পাওয়া যায় তা কম্পুউটারের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে ওই অংশের ত্রিমাত্রিক ছবি নির্মাণ করা হয়। এটাই হল CT Scan এর ছবি। শরীরের যেখানে টিউমার আছে সেখানে (একক আয়তনে পরমাণুর সংখ্যা আশেপাশের থেকে বেশি থাকে বলে ) রঞ্জন রশ্মির শোষণ আশেপাশের চেয়ে টিউমারের অংশে বেশি হয় এবং টিউমারটি ছবিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
পজিট্রন নিঃস্বরণ থেকে ত্রিমাত্রিক ছবি (Positron emission tomography বা PET)
আমরা ইলেকট্রনের কথা জেনেছি। কিন্তু পজিট্রন কি? পজিট্রন হচ্ছে ইলেকট্রনের বিপরীত কণিকা অর্থাৎ ইলেকট্রনের সমভর, কিন্তু ধনাত্মক তড়িৎযুক্ত। ইলেকট্রন ও পজিট্রনের তড়িৎ আধানের মান সমান, কিন্তু তারা বিপরীত তড়িৎযুক্ত। প্রথম কথা হচ্ছে পজিট্রন পাব কি করে? পজিট্রন কেমন করে পাব বুঝতে গেলে একটু তেজস্ক্রিয়তার খবর নিতে হবে। সাধারণ হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ইত্যাদি অনেক পরমাণুর কেন্দ্রক স্থায়ী হলেও, অধিকাংশ পরমাণুর কেন্দ্রক স্থায়ী নয়। অর্থাৎ অধিকাংশ মৌল স্থায়ী নয়। এই অস্থায়ী মৌলগুলি হচ্ছে তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং তাদের একটা আয়ুষ্কাল থাকে। তেজস্ক্রিয় পদার্থের কেন্দ্রক স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙ্গে গিয়ে তার থেকে ইলেকট্রন কণা বা পজিট্রন কণা বা হিলিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রক নির্গত হয়। কাজেই কিছু বিশেষ তেজস্ক্রিয় পদার্থ হছে পজিট্রনের উৎস।
পজিট্রন দিয়ে ছবি তোলা হবে কি করে? একটা পজিট্রন ও ইলেকট্রন পরস্পরের সংযোগে এলে, তারা দুজনেই ধ্বংস হয়ে যায়। তার ফলে তাদের ভর শক্তিতে পরিণত হয়ে একই উচ্চ কম্পাঙ্কের দুটি তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের (গামা রশ্মি) সৃষ্টি করে এবং তারা পরস্পরের বিপরীত দিকে যায়। কাজেই পজিট্রন নিঃস্বরণকারি এবং খুব অল্প গড় আয়ুষ্কালের (গড় আয়ুষ্কাল ১৫-৩০ মিনিট বা আরও কম) তেজস্ক্রিয় পদার্থকে গ্লুকোজ বা চিনি জাতীয় রাসায়নিকের সাথে যুক্ত করে রুগীর শরীরে ঢোকানো হয়। ক্যান্সারের কোষ সাধারণ কোষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি নেয় বলে শক্তিদায়ি গ্লুকোজ প্রধানত সেখানে যায় এবং টিউমারের সাথে যুক্ত হয়। তখন টিউমার থেকে পজিট্রন বেরোতে থাকে। এই পজিট্রন আশেপাশের ইলেকট্রনের সংযোগে দুটি সমান কম্পাঙ্কের গামা রশ্মির তরঙ্গে পরিণত হয়। গামা রশ্মিদুটি টিউমার থেকে পরস্পরের বিপরীত দিকে যায় ও রুগীর শরীর থেকে বেরিয়ে এসে রুগীর শরীরের চারিদিকে রাখা গামা নির্দেশক যন্ত্রে ধরা পড়ে। প্রধানত টিউমার থেকেই শুধু সমান কম্পাঙ্কের গামা রশ্মি বিপরীতদিকে বেরোয়। কাজেই রুগীর শরীরের চারিদিকে রাখা গামা নির্দেশক যন্ত্র থেকে পাওয়া তথ্যের জ্যামিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে টিউমারের অবস্থান যথেষ্ট সূক্ষ্মতায় নির্ণয় করা যায়।
পরমাণু কেন্দ্রকের চৌম্বক অনুনাদের সাহায্যে ছবি (Nuclear Magnetic Resonance Imaging বা MRI)
এতক্ষণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে ছবি তোলার কথা বললাম। উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ শরীরের কোষের কিছু ক্ষতি করে, যদিও তা খুবই সামান্য। পরমাণু কেন্দ্রক বিজ্ঞান আমাদের হাতে আরেক অভিনব উপায় দিয়েছে, যাতে উচ্চ শক্তির কোন তরঙ্গ ব্যবহার না করেও শরীরের অভ্যন্তরের উচ্চ মানের ছবি পাওয়া যায়।
মানুষের দেহের একটা প্রধান উপাদান জল এবং জল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দিয়ে গঠিত। হাইড্রোজেন হচ্ছে সরলতম পরমাণু এবং হাইড্রোজেনের কেন্দ্রক একটি মাত্র প্রোটন দিয়ে তৈরি। শরীরের কোথাও টিউমার হলে সেখানে একক আয়তনে দেহের কোষের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। ফলে সেখানে একক আয়তনে হাইড্রোজেনের পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। কাজেই শরীরের কোথায় হাইড্রোজেনের ঘনত্ব কত তা জানলে, অর্থাৎ হাইড্রোজেনের ছবি তুলতে পারলে, শরীরে টিউমারের অবস্থান জানা যাবে। হাইড্রোজেনের ছবি তোলার এই কাজটাই করা হয় পরমাণু কেন্দ্রকের চৌম্বক অনুনাদকে ব্যবহার করে।
এখন তাহলে প্রথমে জানতে হয় পরমাণু কেন্দ্রকের চৌম্বক অনুনাদ ব্যপারটা কি? অনুনাদ ব্যপারটা ছোটবেলায় পড়েছি। একটা দোলনায় কাউকে চাপিয়ে দোল দিলে দেখা যায় যে একটা বিশেষ সময় অন্তর দোলনাকে ঠেলা দিলে দোলনা সবচেয়ে উঁচুতে উঠে। অর্থাৎ দোলনাটিকে একটা বিশেষ কম্পাঙ্কে দোল দিলে তাকে সবচেয়ে বেশি শক্তি দেওয়া যায় ও সবচেয়ে উঁচুতে তোলা যায়। একেই বলে দোলকের অনুনাদ। একইভাবে পরমাণুর কেন্দ্রককে একটা নির্দিষ্ট চৌম্বক ক্ষেত্রে রাখলে, সে একটা বিশেষ কম্পাঙ্কের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ থেকেই শুধু শক্তি নিয়ে তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এই হল পরমাণু কেন্দ্রকের চৌম্বক অনুনাদ।
তবে এই কাজটা এমন একটা পরমাণুর কেন্দ্রক নিয়ে করতে হবে, তা যেন অবশ্যই মানুষের শরীরের একটা প্রধান উপাদান হয়। তা নইলে শরীরের ভিতরের ছবি পাওয়া যাবে কি করে? একই সাথে কেন্দ্রকটিকে হাল্কা এবং সরল হতে হবে। একটি মাত্র প্রোটন দিয়ে গঠিত হাইড্রোজেনের কেন্দ্রক হচ্ছে সেই আদর্শ কেন্দ্রক।
হাইড্রোজেনের কেন্দ্রক বা প্রোটনের সাহায্যে ছবিটা তোলা হবে কি করে জানতে গেলে প্রোটনের একটা ধর্ম জানতে হবে। প্রোটন স্থির নেই। প্রোটন তার অক্ষের চারিদিকে ঘুরছে এবং সে তড়িৎযুক্ত। যে কোন ঘূর্ণায়মান তড়িৎযুক্ত বস্তু দণ্ড চুম্বকের মতো আচরণ করে, সুতরাং প্রোটনকে আমরা খুব ছোট দণ্ড চুম্বক বলে ভাবতে পারি। দণ্ড চুম্বককে একটা বাইরের চৌম্বক ক্ষেত্রে রাখলে, দণ্ড চুম্বকটি একটা বিশেষ অভিমুখে থাকতে চায়। ঐ বিশেষ অভিমুখ বাইরের চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক নির্দেশ করে। যেমন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে কম্পাসের কাঁটা ( যা একটা দণ্ড চুম্বক) উত্তর-দক্ষিণ বরাবর মুখ করে থাকে।
হাইড্রোজেনের কেন্দ্রক বা প্রোটন খুবই দুর্বল চুম্বক এবং তাপমাত্রার প্রভাবে সর্বদা উল্টে-পাল্টে যাচ্ছে। একটা শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের (সাধারণত ১০,০০০ গাউস এর বেশি, যেখানে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র মাত্র ০.৪ গাউস) মধ্যে প্রোটনকে রাখলে প্রোটনের দুর্বল দণ্ড চুম্বক তাপমাত্রার প্রভাবকে অতিক্রম করে চৌম্বক ক্ষেত্রের অভিমুখ বরাবর অবস্থান করে।
একটা কম্পাসের কাঁটাকে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দিলে, অর্থাৎ তাকে বাইরে থেকে শক্তি দিলে, সে সাময়িকভাবে তার অবস্থান পরিবর্তন করে, কিন্তু আবার তার আগের অবস্থানে অর্থাৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক বরাবর অভিমুখে ফিরে আসে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের এক অভিনব নিয়ম অনুযায়ী চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে থাকা একটা অতি ক্ষুদ্র প্রোটনকে বাইরে থেকে শক্তি দিলে, সে যে কোন পরিমাণ শক্তি নিতে পারে না বা যে কোন অভিমুখ বরাবর থাকতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে প্রোটন চুম্বক প্রযুক্ত চৌম্বক ক্ষেত্রের অভিমুখ বরাবর অবস্থান করে এবং বাইরে থেকে শক্তি নিয়ে কেবলমাত্র তার অভিমুখ উল্টে যেতে পারে। মাঝামাঝি কিছু সম্ভব নয়। তার মানে একটা নির্দিষ্ট চৌম্বক ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রক বা প্রোটন কেবলমাত্র একটা বিশেষ কম্পাঙ্গের তরঙ্গ শোষণ করেই উল্টে যেতে পারে, আবার একটু বাদে ঐ একই কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ছেড়ে দিয়ে অর্থাৎ বিকিরণ করে তার স্বাভাবিক অবস্থায় অর্থাৎ আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। সুতরাং চৌম্বক ক্ষেত্রের মানের উপর নির্ভর করে প্রোটন চুম্বক একটা বিশেষ কম্পাঙ্কের তড়িৎ- চুম্বকীয় তরঙ্গ শোষণ ও বিকিরণ করবে, অর্থাৎ একটা বিশেষ কম্পাঙ্কে প্রোটন চুম্বকের অনুনাদ হবে।
এই অনুনাদি কম্পাঙ্কের তরঙ্গগুলি বেতার তরঙ্গের পাল্লার (range) মধ্যে পড়ে বলে তাদের বেতার কম্পাঙ্ক(radiofrequency) বলে। বেতার তরঙ্গ দেহের কোষের কোন ক্ষতি করে না এবং শরীরে প্রবেশ করতে পারে। MRI যন্ত্রে একটা মানুষকে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দেহ বরাবর বিভিন্ন জায়গায় চৌম্বক ক্ষেত্রের মানের অল্প তারতম্য রাখা হয়। তারপর বেতার তরঙ্গের ঝলক নির্দিষ্ট সময় অন্তর রুগীর দেহে পাঠানো হয় এবং রুগীর দেহ থেকে বিকিরিত বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্কের বিশ্লেষণ করা হয়। চৌম্বক ক্ষেত্র আলাদা বলে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কম্পাঙ্কের বেতার তরঙ্গ অনুনাদ সৃষ্টি করে ও শরীরের বিভিন্ন অংশকে নির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করা যায়। অতএব শরীরের যেখানে হাইড্রোজেনের ঘনত্ব বেশি আছে, সেখান থেকে অবশ্যই অনুনাদি বেতার তরঙ্গ আরও বেশি পরিমাণে বিকিরিত হবে। সুতরাং রুগীর শরীর থেকে বিকিরিত বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক এবং তার পরিমাণের পরিমাপ থেকে শরীরের কোথায় হাইড্রোজেনের ঘনত্ব কত তা জানা যায়। এই হাইড্রোজেনের ছবিই হল শরীরের অভ্যন্তরের ছবি। যদি শরীরে কোথাও টিউমার থাকে, তবে সেখানে হাইড্রোজেনের ঘনত্ব আশেপাশের থেকে বেশি হবে। সুতরাং এই ছবি দেখে দেহের ভিতরে কোথায় টিউমার আছে তা জানা যায়। আমরা এখানে সরলতম MRI পদ্ধতির বর্ণনা দিলাম। MRI ছবিতে টিউমারের সাথে আশেপাশের বৈসাদৃশ্য বাড়ানোর জন্য ও ছবির পটভূমিকে বাস্তবসম্মত রাখার জন্য নানা রকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে সে আলোচনা আরেকদিন করব।