~ কলমে এলেবেলের অতিথি অভিজিৎ চক্রবর্তী ~
সত্যজিৎ রায়ের ‘বঙ্কু বাবুর বন্ধু’ গল্পে ক্রেনিয়াস গ্রহের বাসিন্দা অ্যাং নিজেদের মানুষের চেয়ে এক উচ্চস্তরের প্রাণী বলেছে এবং তার একটি কারণ হিসেবে বেশ কয়েকশো বছর আগে তাদের জানোয়ার খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা উল্লেখ করেছে। আ্যং খুব সম্ভবতঃ চেতনা ও নৈতিক স্তরের বিকাশকেই উচ্চতর প্রাণীর প্রমাণ মনে করেছে (মাহাকাশযানে আন্তঃ-গ্রহীয় চলাচলের ব্যাপারটা আ্যং উন্নততর প্রাণীর প্রমাণ হিসাবে দাখিল করেনি, তাই আমিও ওই আলোচনায় যাবো না)। বঙ্কু বাবু কিছুদিন আগেই কালীপূজোয় পাঠাঁর মাংস খাওয়ায় বলতে ভুলে গেছিলেন যে ভারতর্ষেই এমন অনেক মানুষ আছেন যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কয়েকশ’ বছর কিম্বা আরো বেশী বছর ধরে নিরামিষাশী। আর সেটি যদি মাপকাঠি হয়,তাহলে তারা আ্যং প্রজাতির সমতুল বা তার চেয়ে উচ্চস্তরের প্রাণী।
নিরামিষ-আমিষ এই দ্বন্দ্ব সমাসের সমস্যা ভারতে অপরিচিত নয়। তবে এই দ্বন্দ্বের বাঁ দিক না ডান দিক ভালো, সেটা নিয়েও এ লেখা নয়। মূল বিষয়ে ঢোকার আগে, একটি যুগোপযোগী সতর্কীকরণ দিয়ে রাখা ভালো – ‘বিবর্তনবাদের প্রমাণ আমাদের চারিপাশে অদৃশ্য রূপে সবসময় বিরাজমান। শুধু সঠিক উপায় ও উদ্দেশ্য (আবার নৈতিকতা চলে এল) নিয়ে কাজ করলেই কেল্লাফতে।
আমাদের দেহের প্রতিটি কোষ একটি আস্তরণ দিয়ে ঘেরা, চলিত ভাষায় একে কোষপর্দা বা plasma membrane বলে। এই আস্তরণটি বিভিন্ন প্রকারের স্নেহ পদার্থ বা লিপিড দিয়ে তৈরি হয়, যার মধ্যে একটি বিশেষ প্রকার হল LCPUFA, কোষে এর পরিমাণের তারতম্যের ফলে নানাবিধ উপদ্রব দেখা দেয়, তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।
আমাদের কোষগুলো এই LCPUFA কোথা থেকে পায়? দু’ভাবে। ১) সরাসরি ও প্রধানতঃ প্রাণীজাত খাদ্য থেকে, যেমন মাছ ও মাংস; ২) কোষের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা। এবার একটু চাহিদা ও যোগানের কথা মাথায় রাখলে, LCPUFA যদি শুধু প্রাণিজাতখাদ্য থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়, তাহলে কোষে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তা তৈরির দরকারই হয় না। যেমন, বেড়াল মাংসাশী প্রাণী, তার যেটুকু LCPUFA দরকার দেহের জন্য, সেটা আহার থেকেই পেয়ে যায় বলে, বেড়ালের ওই রাসায়নিক বিক্রিয়া পথটাই অনুপস্থিত। তাই বেড়াল নিরামিষাশী হলে মার্জারকুল অচিরেই ধ্বংস হবে LCPUFA-র অভাবে। এবার যারা নিরামিষ, আমিষ দুই খায় (যেমন বেশির ভাগ বঙ্গ সন্তান) তাদের বিকল্পটা একটু বেশী, যোগান নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। রইলো বাকি নিরামিষাশীরা, এদের কোষকে একটু বেশি খাটনি পোয়াতে হয়, কারণ এদের পুরো LCPUFA গুলো আসে রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে। বিক্রিয়া বন্ধ হলেই যোগান কম হবে, আর যোগান কম হলেই চরম সঙ্কট। বিবর্তন প্রক্রিয়া পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে আমাদের জেনেটিক বা বংশগতির উপাদানগুলোকে পরিবর্তন করে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) এই বির্বতনকে চালনা করে। প্রাকৃতিক নির্বাচন কিন্তু উদ্দেশ্যহীন ভাবে কাজ করে না, এর একমাত্র লক্ষ্য হলো পরিবেশের উপযুক্ত পরিবর্তিত বংশগতির উপাদানগুলোকে গ্রহণ করা। এর ফলে অপ্রয়োজনীয় জেনেটিক উপাদানগুলি কালের গভীরে হারিয়ে যায়। প্রসঙ্গতঃ, অর্থনীতি, সমাজনীতির ক্ষেত্রে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদের কোন সম্পর্ক না থাকলেও, হার্বাট স্পেনসারের ‘সারভাইভ্যাল অফ দ্যা ফিটেস্ট’ কথাটাকে ধরে ডারউইনিজিমের নামে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে অনেক ভ্রান্ত ও অপব্যাখ্যা প্রচার করা হয়েছে, সে ব্যাপারে সাধু সাবধান! ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ তো হল অনেক।
যাই হোক ফিরি আমিষ নিরামিষে। নিরামিষাশীরা যেহেতু সরাসরি LCPUFA গ্রহণ করে না, তাই তাদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় কোষের রাসায়নিক বিক্রিয়ার উপর। এই বিক্রিয়ার প্রধান ও পূর্বসূরি উপাদান হচ্ছে ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো প্রধানতঃ প্রাণিজাত খাদ্যেই বেশী পাওয়া যায়, তবে এর উদ্ভিদ জাত উৎসও আছে। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোকে LCPUFA-তে পরিবর্তিত করার বিক্রিয়াতে দুটো প্রোটিন বা উৎসেচক FADS2 ও FADS1 সাহায্য করে। যেহেতু, নিরামিষাশীদের দেহে LCPUFA চাহিদা অনুযায়ী যোগান কম, সেখানেই শুরু বিবর্তনের খেল। বির্বতনতত্ত্ব আমাদের বলে দেয় যে, এই রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী জেনেটিক উপাদান দুটোর মধ্যে, অর্থাৎ FADS2/1 জিন গুলোতে কিছু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাপ পাওয়া যাবে। সবার ওপর বিবর্তন সত্য, তাই যেমন কথা তেমন কাজ। এই জৈবিক রাসায়নিক বিক্রিয়া পথে মূলতঃ দুটো উপাদান পুরো বিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হয়, উৎসেচক (FADS1/2) ও উৎসেচকের প্রাথমিক উপাদান (ওমেগা-৩/৬)। যেহেতু চাহিদা বেশি, এবং ওমেগা-৩/৬ পরিমাণও সীমিত, তাই উৎসেচকের উপরেই আরো দক্ষতার সাথে কাজ করে দেখাবার চাপ থাকবে (Selection pressure)। ২০১৬ সালে Cornell University-র গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ভারতীয় (পূর্ব এশিয়ান, সাথে আফ্রিকানরাও) বংশগত নিরামিষাশীদের এই FADS1/2 জিন গুলোতে জেনেটিক পরিবর্তন ঘটেছে, LCPUFA-র চাহিদা মেটাবার জন্য এই উৎসেচকগুলো ইউরোপ এবং গ্রীনল্যান্ড নিবাসীদের তুলনায় অনেকটাই বেশী কার্যকর। অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় যে, নিরামিষাশীদের উপর এক প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপ আছে LCPUFA-র চাহিদা কমানোর জন্য।
কিভাবে এই জেনেটিক পরিবর্তন ঘটলো সেটার ব্যাখ্যা হয়তো অন্য কোনো একদিন জানা যাবে, আপাততঃ এই পরীক্ষা থেকে আমরা এইটুকুই জানতে পারি যে LCPUFA আমাদের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং তার গুরুত্ব এতোটাই যে এখনো আমাদের দেহের জেনেটিক উপাদানগুলোর ডারউইনিয়ান নির্বাচন-এর (Positive selection pressure) কাজ করে চলেছে। হয়তো এই LCPUFA তৈরীর রাসায়নিক বিক্রিয়া সরাসরি উপায়ে LCPUFA পাওয়ার পরিমান থেকে অনেকাংশে কম, তাই চাহিদা পূরণের জন্য বির্বতনবাদের এত কাণ্ডকারখানা। হয়তো মানুষের শারীরিক ভাবে এখনো প্রাণিজাত খাদ্যের চাহিদাই বেশী, অন্তত LCPUFA-র জন্য। কিন্তু যারা বংশগত এবং কঠোরভাবে নিরামিষাশী তাদেরকেও প্রকৃতি নিরাশ করেনি, তাদের জন্যেও বিকল্প পথ খুলে রেখেছে। শেষ কথা হিসেবে, এই ধরণের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতে ক’জন এবং কোন কোন জায়গা থেকে মানুষের তথ্য নিয়ে কাজ করা হয়েছে তার একটা বিশাল প্রভাব থাকে, তাই ভবিষ্যতে আরো বেশি সংখ্যক অংশগ্রহণকারী নিয়ে কাজটি করলে আমরা এদের উপসংহার নিয়ে আরো নিঃসংশয় হতে পারব।
উৎস : Kothapalli KS et al. Positive Selection on a Regulatory Insertion-Deletion Polymorphism in FADS2 Influences Apparent Endogenous Synthesis of Arachidonic Acid. Mol Biol Evol. 2016 Jul;33(7):1726-39. doi: 10.1093/molbev/msw049.
গাণিতিক জীববিজ্ঞানী অভিজিৎ Indian Institute of Chemical Biology, কোলকাতা থেকে Ph.D। বর্তমানে La Jolla Institute for Immunology, San Diego, USA গবেষক বিজ্ঞানী।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।