~ কলমে এলেবেলে প্রত্যয় ~

এই পর্বের ভূমিকা জানতে হলে আপনাকে পড়তেই হবে ‘এমি আসছে: পর্ব ১।’
এবার দ্বিতীয় এমির কথা, সেই যাঁকে নিয়ে প্রফেসার হিলবার্ট সভা কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। যে সময়ে গল্প শুরু হচ্ছে ততদিনে এমিলি ডু সাটেলের প্রস্তাবিত শক্তির সংরক্ষণ সূত্র সুপ্রতিষ্ঠিত (এমি আসছে: পর্ব ১ দ্রষ্টব্য)। আইনস্টাইন ইতিমধ্যে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব নিয়ে হাজির। উনি বলে দিয়েছেন ভর আর শক্তি মোটামুটি একই জিনিস। ভর শক্তিতে আর শক্তি ভরে রূপান্তরিত হতে পারে। এবং, ভর ও শক্তি একত্রিতভাবে সংরক্ষিত। সেটা ১৯০৫ নাগাদ। এরপর উনি কাজ আরও আগে বাড়ালেন, শেষে ১৯১৫ নাগাদ উনি এনে হাজির করলেন ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব।’ আর এটা এনেই উনি পড়লেন এক মস্ত বিপাকে। বিজ্ঞানী মহল মানতে নারাজ। আর তার একটা বড় কারণ হল ভর-শক্তির সংরক্ষণ সূত্র খাটছে না। ব্যাপারটা চাইলেই আপনি গভীর অঙ্ক কষে দেখতে পারেন, কিন্তু আমি সাধারণ পাঠকের স্বার্থে একটু সোজা করে বলবো। সমস্যাটি মূলত এই রকম: আইনস্টাইন বলছেন এই মহাবিশ্ব আসলে স্থানকালের চাদর দিয়ে তৈরি (আরও জানতে পড়ুন মহাবিশ্বের মহাগাথা)। তার যেই খানে ভর বা শক্তি (যাই হোক না কেন) থাকবে, সেখানেই চাদর একটু দেবে যাবে। ভালো কথা। কিন্তু, মজা হচ্ছে যে স্থানকালের নিজেরই শক্তি আছে। তার মানে, স্থানকালের নিজের শক্তিই স্থানকালের চাদরে বিকৃতি ঘটাতে পারবে। অতএব স্থানকাল নিজেই নিজের বিকৃতির কারণ। আর এখানেই লঙ্ঘিত হচ্ছে ভর-শক্তির সংরক্ষণ সূত্র। আইন্সটাইন হিলবার্টের দ্বারস্থ হলেন। হিলবার্ট, আইন্সটাইন মিলে অনেক কসরত করলেন। গলদঘর্ম হলেন, কিন্তু গলদ ধরা পড়ল না। দলে নিলেন সহকর্মী ক্লাইনকে। তাতেও হল না। এই সময়ে হিলবার্টের নজর গেলো ক্লাইনের সহকর্মী এরলাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমির প্রতি। পুরো নাম অ্যামেলিয়া এমি নয়দার। সবাই ওঁকে এমি নয়দার নামেই চেনে। ক্লাইনের সাথে মিলে এমি, হিলবার্টের একটি কাজের উপর ভিত্তি করে নিজেদের একটি কাজ প্রকাশ করেন। হিলবার্টের নজরে আসে সেটি। অতএব একগুঁয়েমির শুরু, এমিকে লাগবে। ক্লাইন দিলেন মদত। তাতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি প্রফেসারদের গায়ে লাগে তো বয়ে গেলো। এমিকে এখুনি চাই গয়েটিংগেনে। হিলবার্টদের জেদের কাছে সবাই চুপ। গাঁইগুঁই করে তাঁরা শেষ অব্দি যা মেনে নিলেন, তবে মাইনে দেওয়া যাবে না। আর, ওনাকে ক্লাস নিতে দেওয়া যাবে না। উঁহ, মাইনে দেখাচ্ছে! দিবি না তো দিবি না। ও মেয়ে এলে তোরা বর্তে যাবি। এমি চলে এলো। বিনা মাইনের প্রফেসার, ক্লাস নেন, কিন্তু হিলবার্টের নামে। এবার প্রশ্ন হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য সফল হবে কিনা। সমস্যার সমাধান কি হল?
এখানেই লঙ্ঘিত হচ্ছে ভর-শক্তির সংরক্ষণ সূত্র।
হ্যাঁ, হল। জটিল গণনার পর এমি জানালেন সব ঠিকঠাক আছে। আগেই জানা ছিল যে শক্তির আসলে অনেকগুলি উপাংশ রয়েছে। এমি দেখালেন যে শক্তির যে উপাংশগুলি স্থানকালের চাদরে বিকৃতি ঘটাতে সক্ষম, স্থানকালের নিজের শক্তিতে সেই উপাংশগুলি বিদ্যমান নয়। আর তাই, স্থানকাল নিজে নিজের বিকৃতি ঘটাতে পারবে না। ব্যাস, আপেক্ষিকতাবাদের আবার গড়গড় করে এগিয়ে যেতে কোন বাধা থাকলও না। ভর-শক্তি আবার সংরক্ষিত হল। আইন্সটাইন, হিলবার্ট তো মহা খুশি। নিজেদের মধ্যে চিঠি চালাচালি করে সে কি এমির প্রশংসা। এদিকে এমিকে তখন অন্য নেশা পেয়ে বসেছে। উনি তো গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ যাতে খুশি, গণিতজ্ঞ তাতে খুশি নন। স্থানকালের সমস্যা মেটাতে গিয়ে এমি দেখলেন যে ভর-শক্তির সংরক্ষণ হচ্ছে একটা বিশেষ প্রতিসাম্যের কারণে। প্রতিসাম্য মানে ইংরেজিতে যাকে বলে সিমিট্রি। প্রতিসাম্য কাকে বলে সেটা বোঝানো দরকার। ধরুন আপনাকে আমি একটি জিনিস দেখালাম। দিয়ে আপনার চোখ বেঁধে দিয়ে সেই বস্তুর ওপর কিছু একটা করলাম। এবার আপনার চোখ খুলে আপনাকে জিনিসটা আবার দেখালাম। আপনি যদি তফাত বুঝতে না পারেন, তবে আমি যা করেছি, সেটা ঐ জিনিসটার একটা প্রতিসাম্য। মানে যেমন ধরুন, একটা পাতায় লিখলাম ৪। আপনি দেখলেন। এবার আপনার চোখ বেঁধে পাতাটাকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে দিলাম। আপনি চোখ খুলে বুঝতেই পারলেন না আমি কি কাণ্ডটি ঘটিয়েছি। এই ১৮০ ডিগ্রী ঘোরানোটি হল ‘৪’-এর প্রতিসাম্য। শক্তির সংরক্ষণে কিরকম প্রতিসাম্য? উনি বললেন সময় চলন প্রতিসাম্য। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে পদার্থবিদ্যার যেসব নিয়ম খাটে, সে নিউটনের গতিবিদ্যা হোক, বা তড়িৎচুম্বকের নিয়ম হোক, বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা হোক, আজ থেকে দুশো বছর আগেও তা খাটত, আজ থেকে দুহাজার বছর পরেও তা খাটবে। মানে, আমি যদি আজ একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করি, আর আগে পরে যে কোন সময় ঐ একই পরীক্ষা করি, তবে তাদের ফলাফল এক হতে বাধ্য। সময় সরণটা আরও ভালো করে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিই। ধরুন আদর্শ গ্যাস; তার সব অণু অভিন্ন, এবং ভরবেগ ও গতিশক্তি (অর্থাৎ শক্তি) সংরক্ষিত হয়। এবার ধরুন আমি একটা বিরাট মাপের ঘরে আদর্শ গ্যাস দিয়ে ভরে রেখেছি। এবার আমি কি করলাম? ঘরের ভেতরের অণুগুলোর দুটো ছবি নিয়ে এলাম আপনার কাছে, দুটো ছবি ধরুন ১০ বছরের তফাতে তোলা। আপনি কি বলতে পারবেন কোনটা আগের ছবি, কোনটা পরের ছবি? পারবেন না। এটাই হচ্ছে সময় সরণ প্রতিসাম্য। প্রতিসাম্য মানেই হল একটি ঘটনা যা আমি ঘটাচ্ছি, বা প্রকৃতির নিয়মে ঘটছে, যার শুরু আর শেষ দেখে আপনি ফারাক করতে পারবেন না। যদি পারতেন তাহলে বলে দিতে পারতেন, কোনটা আগের ছবি, কোনটা পরের ছবি। নয়দারের কথা অনুসারে এই সময় সরণ প্রতিসাম্য আছে বলেই, এখানে শক্তি সংরক্ষিত।
আপনি যা দেখবেন সংরক্ষিত, জানবেন তার সংশ্লিষ্ট একটি অবিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য আছেই আছে।
এটা একটা বিশেষ বক্তব্য। এতে পদার্থবিদের মন পাওয়া গেলো, কিন্তু গণিতবিদ সহজে ভুলবার নয়। তাঁর দরকার আরও একটা বক্তব্য যেটা আরও অনেক বেশী সর্বজনীন। সোজা কথায় উদাহরণ দিলে এমন দাঁড়ায়: চালের দাম যদি ৫০ টাকা কিলো হয়, তো ২ কিলো চালের দাম ১০০ টাকা। পদার্থবিদ এতেই খুশি। কিন্তু, গণিতবিদ বলবেন, যদি কোন সামগ্রীর x একক পরিমাণ y একক মুল্যে পাওয়া যায়, তবে ঐ সামগ্রীর z একক কিনতে zy/x একক মূল্য লাগবে। এমিও ঠিক তাই করলেন। উনি আরও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, যে জিনিসকেই আমরা সংরক্ষিত বলে দেখি, তার সবার পেছনে আছে একটা প্রতিসাম্য। ভর-শক্তির সংরক্ষণের পেছনে যে সময় সরণ প্রতিসাম্য রয়েছে, এটা ওনার এই সার্বজনীন বক্তব্যের একটা উদাহরণ মাত্র। এরকম আরও উদাহরণ আছে, হাগেন্সের বল ঠোকাঠুকি পরীক্ষায় যে ভরবেগের সংরক্ষণ হচ্ছিল, তার পেছনে আছে স্থান সরণ প্রতিসাম্য। অর্থাৎ, পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যার নিয়ম যা, চাঁদেও তাই, ২ আলোকবর্ষ দুরেও তাই। আবার সেই আগের আদর্শ গ্যাসের ঘরে ফিরে যাই। আমি এবার আপনাকে একই সময়ে তোলা দুটো ছবি এনে দিলাম, দুটো ছবি তোলা হয়েছে এমন দুটো জায়গায় যাদের দূরত্ব মনে করুন এক আলোকবর্ষ। আপনাকে বলতে হবে কোনটা কোথায় তোলা। এটাও আপনি বলতে পারবেন না। এটাই হচ্ছে স্থান সরণ প্রতিসাম্য। স্থান সরণ প্রতিসাম্য আছে, তাই ভরবেগ সংরক্ষিত। কিন্তু, নিউটন যে বললেন, বল প্রয়োগ করলে ভরবেগ বাড়ে কমে? তারও সমাধান আছে, যে জিনিসটা বল প্রয়োগ করছে তাকে হিসেবে ধরো, দিলেই সমস্যা মিটে যাবে। আবার একটা উদাহরণ দিই। একটা বলকে ওপর থেকে ফেলে দিলে নিচে পড়ার সময় তার বেগ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তাহলে ভরবেগের সংরক্ষণ কি ভাবে হচ্ছে? একটু ভেবে দেখুন। আপনি পৃথিবীকে একটি স্থির বস্তু হিসেবে ধরে, শুধু খুব সংকীর্ণ ভাবে বস্তুটিকে দেখছেন। পৃথিবী বলটাকে টানছে বলেই না বলটা পড়ছে। অতএব, একটু দূরে সরে যান, এবার পৃথিবী আর বস্তুটিকে একসাথে দেখুন। দেখবেন বস্তুর ভরবেগ পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যেমন বাড়ছে, পৃথিবীর ভরবেগও ঠিক উল্টো দিকে সমপরিমাণে বাড়ছে; পৃথিবীর ভরটি খুব বেশী বলে ব্যাপারটা আমাদের গায়ে লাগছে না, এই যা। তাহলে মোট ভরবেগ কেটে কুটে সব শূন্য হয়ে যায়। ভরবেগ সংরক্ষিত হয়। এরকমই আপনি যা দেখবেন সংরক্ষিত, জানবেন তার সংশ্লিষ্ট একটি অবিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য আছেই আছে। খুব আশ্চর্য লাগলেও, পদার্থবিজ্ঞানে রাশির থেকেও প্রতিসাম্য অনেক বেশী মৌলিক। তাই নয়দারের উপপাদ্য থেকে পালাবার পথ নাই। আধুনিক পদার্থবিদ্যার এটা একটা মূল স্তম্ভ বললে খুব কম বলা হবে। নিউটন, আইন্সটাইন থেকে শুরু করে হকিন্স, পেনরোস, হিগস্, সব্বাই এই উপপাদ্যের আওতায়।
এমি এখানেই থেমে যাননি। ওনার ৫৩ বছরের জীবনে উনি অসামান্য সব কাজ করেছেন বিমূর্ত বীজগণিতে। ওনার হাত ধরেই এসেছে বীজগণিতিক আকৃতিবিদ্যা। অথচ, কাজ করার সময় উনি যা পেয়েছেন তা এমন কিছু বেশী না। একে তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রফেসারের যোগ্য সম্মান আদায় করা, বিনা পারিশ্রমিকে গবেষণা করা, ছাত্র পড়ানো। সেই থেকে আর্থিক দুরবস্থা, শারীরিক ক্ষতি। আর সব শেষে এসে দাঁড়াল নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি হওয়া। চাকরি চলে গেলো। আইন্সটাইন খবর পেলেন। উনি ততদিনে আমেরিকায়। করলেন চাকরির ব্যবস্থা। এমিকে ডেকে পাঠালেন। উনি গেলেনও। কিন্তু, শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে বেশিদিন বাঁচতে দিল না। ১৯৩৫ এই উনি মারা গেলেন। বিবাহ উনি কোনদিন করেননি, তাই পৃথিবীতে শুধু রেখে গেলেন অভাবনীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ, আর জনা পনেরো প্রতিভাবান ছাত্র, লোকে বলতো, ‘দ্যা নয়দার বয়েজ।’ পৃথিবীতে এরকম এমিরা বারেবারেই আসে। যখন নিউটন, লাইবনিৎস, আইন্সটাইন, হিলবার্টরা সবাই ফেল, তখন দরকার পড়ে এমিদের। তাদের স্বার্থ থাকে না, তাদের পারিশ্রমিক থাকে না, জীবনের কাছে কোন চাহিদাও থাকে না, থাকে শুধু একটা সমস্যা, আর সেটা সমাধান করার অদম্য খিদে। কে জানে আবার হয়তো কোন দিন কোন বিরাট সমস্যা এসে দাঁড়াবে, সবাই হেরে যাবে, লড়াই করতে এগিয়ে যাবে শুধু এমিরা।
(সমাপ্ত)
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
এলেবেলে – Elebele