ছয় দিন আগে ঘোষ বাবুর বাজারের ব্যাগে চড়ে আসি আমি এই ‘শান্তিনীড়’ অ্যাপার্টমেন্টে, তারপর সেখান থেকে ঘোষ বাবুর ফ্ল্যাটের দরজার হাতলে। শুধু আমি না, আমার সাথে আরো কয়েকশো সার্স-কোভ-২ সেদিন স্থান নিয়েছিল এই জায়গায়। বাকিরা সেদিনই গত হয় ঘোষ গিন্নির বিষাক্ত স্প্রের আক্রমণে। অবস্থানগত একটা সুবিধা পাওয়ায় কোনোক্রমে বেঁচে যাই আমি। তারপর থেকে অপেক্ষা করেছি কখন আবার কারো হাতে চেপে কারো শরীরে ঢুকতে পারবো। কিন্তু সেই সুযোগ মনে হয় এই যাত্রায় আর হল না। মাঝে যদিওবা ঘোষ বাবু এক-দুবার গোঁ ধরেছিলেন বাজারে বেরুবেন বলে, কিন্তু ঘোষ গিন্নির কাছে সেই আবদার ধোপে টেকেনি। এমনকি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদেরও বারণ করে দিয়েছেন বাড়িতে আসতে। আমরা আবার কারোর দেহের বাইরে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারি না। তোমরা তো জানোই, আমাদের জীব ও জড়ের মাঝামাঝি বলা হয়। পোষকদেহ (host) ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারিনা বলে আমাদের জীবনের কোনো মূল্যই নেই। এই নিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ। তোমরা আমাদের কি একটা নাম দিয়েছো ‘ভাইরাস’, আসলে ল্যাটিন এই শব্দটির মানে দাঁড়ায় ‘বিষ’। আমাদের এই নামটি মোটেও পছন্দ নয়, তোমরা জগতের হর্তাকর্তা বলে যা খুশি তাই করে বেড়াও। দোষ করো তোমরা, আর নাম খারাপ হয় আমাদের। এই আমাদের কথাই ধরো, বেশ তো আমরা ছিলাম বাদুড়, বা প্যাঙ্গলীনের দেহে, ওদেরও কোনো অসুবিধে হত না আমাদের বয়ে বেড়াতে। তোমরা জঙ্গল কেটে সাফ করতে শুরু করলে, তারপর বন্য প্রাণী মেরে ধরে খাওয়া শুরু করলে, আমরা কোথায় যেতাম? আগেই বলেছি, আমরা অন্য জীবের দেহ ছাড়া বাঁচতে বা বংশ বিস্তার করতে পারি না। এদিকে তোমরা কোনো জীবকেই তো রেহাই দাওনি। তাই আমাদের এই সংকটের দিনে আমরা বোঝাপড়া করে ঠিক করলাম যে মানুষের দেহ এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সব চেয়ে নিরাপদ। কারণ, সব জীব হত্যা করে ফেললেও মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে, আর তাই একবার মানুষের দেহে ঢুকতে পারলে টিকে যাব আমরাও। আসলে পৃথিবীতে সব জীবই বাঁচতে চায়, এবং নিজের বৈশিষ্ট্য গুলিকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। যদিও তোমরা আমাদের জীবের পর্যায়ে ফেলো না, কারণ আমাদের কোনো কোষ নেই, নেই কোনো নিউক্লিয়াস। অন্যান্য জীবের মত শ্বসন, বা পরিপাক ক্রিয়াও করতে অক্ষম আমরা। কিন্তু আমাদের দেহও অনান্য সজীব বস্তুর মতো প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA বা RNA) দিয়ে তৈরি। এই নিউক্লিক অ্যাসিড আসলে জিনগত উপাদান যা সমস্ত জীবের মধ্যেই থাকে, এরা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্ট্য গুলি বহন করে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই জিনগত উপাদান হিসেবে DNA বা RNA বা উভয়ই থাকতে পারে। অন্যান্য জীবে এই নিউক্লিক অ্যাসিড নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকলেও, আমাদের ক্ষেত্রে এটি সাধারনত একটি প্রোটিনের খোলকের ভিতর সুরক্ষিত থাকে। এই প্রোটিন খোলকের প্রোটিনকে কাজে লাগিয়ে একবার পোষকদেহের ভিতর ঢুকতে পারলেই কেল্লা ফতে। পোষকদেহের কোষের ভিতর প্রোটিন ও RNA তৈরির কারখানা হস্তগত করে আমরা নিজেদের দেহ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও RNA বানিয়ে ফেলতে পারি, তারপর তা থেকেই তৈরি হয় লক্ষ লক্ষ প্রতিলিপি। যাই হোক, এই ব্যাপারে পরে আসছি। তো যেটা বলছিলাম, সবাই বাঁচতে চায়, তাই আমরা ঠিক করলাম তোমাদেরকেই বানাবো আমাদের পোষকদেহ। কিন্তু বললেই কি আর হয়, হ্যাপা তো কম নয়। আমাদের গঠন এমনই হয় যে আমরা নির্দিষ্ট পোষকদেহেই শুধুমাত্র প্রবেশ করতে এবং বেঁচে থাকতে পারি। আমাদের সমগোত্রীয় ভাইরাস ভাইয়েরা (SARS এবং MERS) বেশ কয়েক বছর আগে এই কাজটাই করেছিল। সমগোত্রীয় হওয়ায় গঠনগত ও কার্যগত বেশ কিছুটা মিল আছে আমাদের মধ্যে। সেসব ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে উপলব্ধি করলাম খানিকটা পরিবর্তন করতে হবে আমাদের গঠন। পৃথিবীতে প্রতিটি জীব নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত নিজেদের পরিবর্তন করে চলেছে। এই খাপ খাইয়ে নেওয়ার পদ্ধতির নামই অভিযোজন। খুব সময় সাপেক্ষ কিন্তু ক্রম পরিবর্তনশীল এই পদ্ধতি। বংশপরম্পরায় জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে অভিযোজিত হওয়ার ফলে একসময়ে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে, তখন তাকে বলে অভিব্যক্তি বা বিবর্তন । স্তন্যপায়ী প্রাণী হয়েও বাদুড়ের আকাশে উড়তে পারা, বা বাঁদর থেকে আজকের মানুষ হওয়া, সবটাই এই অভিযোজন-অভিব্যক্তির খেলা। এই পরিবর্তন হতে লক্ষাধিক বছরও লেগে যেতে পারে। আমাদের যেমন জিনগত উপাদান স্বরূপ রয়েছে RNA, তেমনই উন্নত জীবকুলের মধ্যে থাকে DNA, কিছু অণুজীবের মধ্যে আবার DNA এবং RNA দুইই উপস্থিত। ধীরে ধীরে, বংশানুক্রমে জিনগত উপাদানের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে আমরা নিজেদেরকে মনুষ্য দেহোপযুক্ত করে তুললাম। এই পরিবর্তনগুলিকে বলা হয় পরিব্যক্তি বা মিউটেশন। নিজেদের এই পরিবর্তন করার ক্ষমতা আবার আমাদের একটু বেশী, তার মূল কারণ জিনগত উপাদানের পরিমাণ বা জিনোম সাইজ যেটা আমাদের খুবই কম। সহজ করে বোঝাই, এক গ্লাস জলে তুমি এক চিমটে নুন ফেললেই নোনতা ভাব অনুভব করতে পারবে, কিন্তু এক বালতি জলে না। আমাদের জিনোম সাইজ প্রায় ৩০,০০০ বেস পেয়ার (বেস পেয়ার হল DNA বা RNA’র একক), সেখানে মানুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা প্রায় ৬৪০ কোটি। ঠিক এই কারণেই আমরা খুব দ্রুত নিজেদের অভিযোজন সম্পন্ন করতে পারি, এবং নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটাতে পারি। যদিও এই অভিযোজন বা পরিব্যক্তির হার নির্ভর করে আরো অনেকগুলো বিষয়ের উপর, তাই সেগুলো নিয়ে আর জটিলতা বাড়াচ্ছি না। তো যাই হোক, নতুন এই পরিবর্তিত রূপের তোমরা নাম দিলে এন কোভ-সার্স-২। তা কি এমন পরিবর্তন করলাম আমরা, যাতে করে মানুষকে পোষকদেহ হিসেবে ব্যবহার করতে পারলাম? আসছি এবার সেই গল্পে, পোষকদেহের কোষে ঢুকতে গেলে আমাদের সেই কোষের কোষপর্দায় থাকা গ্রাহক প্রোটিনে চড়ে বসতে হবে, তবেই মিলবে কোষে নামক কারখানায় প্রবেশের অনুমতি। এই গ্রাহক মহাশয় কিন্তু বেজায় পক্ষপাতদুষ্ট। নির্দিষ্ট গঠন না থাকলে উনি মোটেও চড়ে বসতে দেন না।
আমরা মানবদেহের একখানা গ্রাহক প্রোটিন বাছলাম, যার নাম ACE2। এটি মূলত পাওয়া যায় মানব দেহের ফুসফুসে, এছাড়া পাওয়া যায় হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক ও ক্ষুদ্রান্ত্র কোষের কোষপর্দায়। আমাদের গায়ের উপর যে প্রোটিনের আবরণী আছে, ওখানে কিছু প্রোটিন থাকে যারা কাঁটার মত বেরিয়ে থাকে বাইরের দিকে, নাম স্পাইক প্রোটিন বা কাঁটা প্রোটিন। এই কাঁটা প্রোটিন ঠিক এমনভাবে তৈরি করা, যেমনটি ওই গ্রাহক বাবু চান।
দেহের ভিতর ঢুকে এই কোষ অবধি পৌঁছানোর পথ মোটেও সুবিধের হয় না, প্রতিনিয়ত লড়তে হয় অনাক্রম্যতা প্রদানকারী কোষ গুলোর সাথে, তাদের হাত থেকে কিভাবে বেঁচে যাই আমরা সেও আরেক গল্প, সেটা না হয় তোলা থাক। আসি পরের গল্পে, কোষের ভিতর ঢুকে তো গেলাম, এরপরই তো আসল কাজ। তোমাদের দেহের কোষগুলো এক একটা বিশাল কারখানা, কি হয়না তার মধ্যে! DNA এর প্রতিলিপি গঠন থেকে শুরু করে DNA থেকে RNA তৈরি, RNA থেকে প্রোটিন। আবার এই নানারকম প্রোটিন গুলোকে তাদের কাজের জায়গায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি, সব হয় এই কারখানায়। আমাদের এই RNA এর মধ্যে থাকে আমাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রোটিনের সংকেত। তাই পোষক কোষে ঢুকে প্রথমেই আমাদের RNA কে ছেড়ে দিই কোষের ভিতর। তারপর, তোমাদেরই কারখানার একজন দক্ষ কর্মচারী, যে RNA থেকে প্রোটিন বানাতে সিদ্ধহস্ত, সেই রাইবোজোমকে ধরে বানিয়ে নিই আমাদের প্রয়োজনীয় প্রোটিন গুলো। কিছু প্রোটিন RNAএর প্রতিলিপি তৈরিতে এবং অন্যান্য কাজে সাহায্য করে, আবার কিছু প্রোটিন প্রদান করে আমাদের গঠনগত উপাদান। এই প্রোটিন দের কাজে লাগিয়েই একটা RNA অণু থেকে তৈরি হয় অনেক গুলো RNA অণু। এই নতুন তৈরি প্রোটিন এবং RNA অণুগুলোকে একত্রিত করতেও আবার পাকড়াও করি তোমাদের কোষ নামক কারখানার আর এক কর্মচারী: এন্ডোপ্লাসমিক রেটিকুলাম – গলগি বডিকে। তারাই বানিয়ে দেয় পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস। তারপর এক কোষ থেকে অন্য কোষ এইভাবে চলতে থাকে আমাদের আগ্রাসন। কিন্তু আমরা এতই বোকা, যে নিজেরাই ভুলে যাই কি জন্য আমরা এই নতুন পোষকদেহে ঢুকেছি। আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু এই পৃথিবীর সমস্ত জীব কুলের মতই নিজেদের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখা, এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আমাদের জিনগত উপাদান সঞ্চারিত করা। আবার পোষকদেহই যদি না থাকে তাহলে আমাদেরও মৃত্যু নিশ্চিত, কারণ আমরা পোষকদেহ ছাড়া বাঁচতে অক্ষম। আমরা ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে তো পড়লাম, কিন্তু তোমাদের শরীরের এতটাই ক্ষতি করতে শুরু করলাম যে মানুষ মারা যেতে শুরু করল। এভাবেই যদি গোটা বিশ্বের মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাহলে তাদের সাথে আমরাও অবলুপ্ত হব, আমাদের তো সেটা উদ্দেশ্য ছিলনা। শুধু আমরা কেনো, কোনো পরজীবীই চায় না তাদের পোষকদেহের মৃত্যু ঘটুক। তাই আবার আমরা অভিযোজিত হব, ধীরে ধীরে একটু একটু করে নিজেদের পরিবর্তন করবো যাতে পোষকদেহের ক্ষতির সম্ভবনা কমিয়ে আনা যায়, সেই সাথে আমাদের ভবিষ্যতও সুনিশ্চিত হয়। ঠিক কত সময় লাগবে আমাদের এই পরিবর্তন আনতে জানিনা, বিজ্ঞানীরাও অংক কষে চেষ্টা করছেন সেই সময়ের হদিস পাওয়ার। এটা আসলে লড়াই, তোমরাও বাঁচার তাগিদে ভ্যাক্সিন বানাও, আর আমরা নিজেদের বাঁচাতে পরিবর্তন করে চলি নতুন নতুন। তোমরা শুধু শুধুই আমাদেরকে খারাপ ভাব, তোমরা যত পশুপাখি মেরে তাদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেবে, তত তাদের মধ্যে থাকা ভাইরাসেরা নিজেদের পরিবর্তিত করে মারণ রূপ ধারণ করবে। শুধু তাই নয়, এই যে যথেচ্ছ ভাবে তোমরা পরিবেশের ক্ষতি করছো, এত দূষণ ছড়াচ্ছ, এতে করে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, গলতে শুরু করেছে হিমবাহ। সেই হিমবাহের বরফের নিচে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা সব ভাইরাসেরাও মুক্ত হচ্ছে পরিবেশে। তোমরা নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জীব মনে কর, তাই চেষ্টা কর প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে নিজেদের মতন করে। কিন্তু প্রকৃতিও নিজের সমস্ত জীবকুলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সদা তত্পর । রাসায়নিক বিক্রিয়া যেমন সাম্যাবস্থার দিকে থাকতে চায়, ঠিক তেমনই পরিবেশও নিজের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে চায়, আর এই বজায় রাখতে চাওয়ার যে শক্তি, সেইটা আমাদের কে সাহায্য করে দ্রুত অভিযোজিত হতে। এই শক্তির প্রভাবেই পৃথিবীর প্রতিটা জীব পরিবর্তিত হচ্ছে, একটু একটু করে। মুঠো ফোনের ব্যবহারের সুবিধের জন্য আজ থেকে হাজার বছর পরে হয়তো তোমাদের হাতের বুড়ো আঙ্গুল গুলোই লম্বা হয়ে গেল, অবলুপ্ত হল বাকি আঙ্গুলগুলো। এটা আমার অনুমান, কিন্তু হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় একেবারেই।
~ কলমে এলেবেলে অর্চিষ্মান ~
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
“