~ কলমে এলেবেলের অতিথি শুভময় ব্যানার্জী ~
হৃদরোগ এবং হৃদপিন্ডের নানা জটিলতায় মানুষের মৃত্যুর হার পৃথিবীতে সর্বাধিক। এর ঠিক পরে, দ্বিতীয় স্থানে আছে ক্যান্সার। এই ভয়াবহ এবং দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে পড়ে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ৯৬ লক্ষেরও বেশী মানুষ প্রাণ হারান। আমরা জানি, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্যান্সার হতে পারে, তার মধ্যে মস্তিষ্ক, মুখ, চোখ, গলা, ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অন্ত্র, প্রজনন অঙ্গ, হাড়, রক্ত ও ত্বকের ক্যান্সারের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রায় সব অঙ্গের নামই বলা হয়ে গেলো, তাই না? কিন্তু, আমাদের শরীরের যে বিশেষ অঙ্গটি সদাসর্বদা কাজ করে চলেছে, যার এক মুহূর্তের বিশ্রামে মানুষের মৃত্যু ঘটে যেতে পারে, তা হলো- হৃদপিন্ড। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, শরীরের সমস্ত অঙ্গ ক্যান্সার আক্রান্ত হলেও, হৃদপিন্ডের ক্যান্সার পৃথিবীর বিরলতম ক্যান্সারের মধ্যে অন্যতম।
লাখে এক
পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক লক্ষ মানুষের মধ্যে কেবল একজনের কার্ডিয়াক ক্যান্সার হতে পারে। একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যে সমস্ত হাসপাতালে কার্ডিও-অনকোলজি বিভাগ আছে, সেখানে চিকিৎসকদের কাছে সারা বছরে হয়তো মাত্র একজন বা দু’জন রোগী আসেন। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কার্ডিয়াক ক্যান্সার হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় সেকেন্ডারি কার্ডিয়াক ক্যান্সার; অর্থাৎ, শরীরে অন্য কোথাও ক্যান্সার হলে তা ছড়িয়ে পড়ে যদি হৃদপিন্ডে এসে পৌঁছয় এবং টিউমার তৈরী করে তবে সেটা সরাসরি হৃদপিন্ডের ক্যান্সার ধরা হয় না। শুধুমাত্র হৃদপিন্ডের কলাকোষ থেকে টিউমার তৈরী হলে তবেই তা প্রকৃতপক্ষে প্রাইমারি বা মূল কার্ডিয়াক ক্যান্সার।
কোষ চক্রের খেলা
তাহলে এই বিরলতম ক্যান্সারটি তৈরী হবার বৈজ্ঞানিক কারণ কি? কেনই বা হৃদপিন্ডের কোষে ক্যান্সার হওয়া প্রায় অসম্ভব? বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে সেই কথা জানতে হলে আগে জানতে হবে কাকে বলে “”কোষচক্র””? সজীব কোষের ধর্মই হলো বিভাজিত হওয়া ও সংখ্যায় বাড়া। কোষবিভাজনের মাধ্যমে জীবনের গতিশীলতা বজায় থাকে। প্রতিটি জীবের দেহে কোষবিভাজন প্রক্রিয়াটি অসম্ভব রকম নিয়ন্ত্রিত। সজীব কোষে থাকে ডিএনএ, যা বংশগতির ধারক ও বাহক। সেই ডিএনএ দ্বিগুন হয়ে পড়ে কোষবিভাজনের সময়। কোষটি বিভাজিত হবার পর অপত্য কোষে সমপরিমাণ ডিএনএ প্রবেশ করে। অর্থাৎ সদ্য বিভাজিত কোষদু’টিতে ডিএনএর পরিমান একই থাকে। বলা যায়, নিয়ন্ত্রিত কোষবিভাজনে ডিএনএর সমতা রক্ষিত হয়। প্রত্যেকবার কোষবিভাজনের সময় কোষটি নির্দিষ্ট কয়েকটি দশার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে। প্রধানত কোষবিভাজনের দু’টি দশা দেখা যায়, একটি হলো ইন্টারফেজ (I-Phase বা বিভাজন পূর্ববর্তী দশা) এবং অন্যটি মাইটোটিক ফেজ (M-Phase বা বিভাজন দশা)। আবার ইন্টারফেজের মধ্যে আছে আরো তিনটি দশা, তারা হলো G1 (গ্যাপ ফেজ-১), S (সিন্থেটিক ফেজ), G2 (গ্যাপ ফেজ-২)। এদের মধ্যে সিন্থেটিক ফেজে ডিএনএর পরিমান প্রতিলিপিকরণের মাধ্যমে দ্বিগুন হয়। এই দশাগুলি অতিক্রম করে কোষটি বিভাজনের উপযুক্ত হলে তবেই তা মাইটোটিক দশায় প্রবেশ করে ও দু’টি কোষে ভাগ হয়ে যায়। প্রত্যেকবার কোষবিভাজনের আগে এই দশাগুলির পুনরাবৃত্তি হয়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় একেই বলে “”কোষচক্র””।
মজার কথা, দেহের প্রতিটি অঙ্গের প্রতিটি কোষের কোষচক্র একই রকম শুধু হৃদপিন্ডের কোষ ছাড়া। হৃদপিন্ডের কোষকে কার্ডিয়াক মায়োসাইট বলে। এই কোষটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কারণ মাতৃগর্ভে ভ্রুন অবস্থায় যখন হৃদপিন্ড তৈরী হয় তখনো পর্যন্ত কার্ডিয়াক মায়োসাইটগুলি বিভাজনক্ষম থাকে। শিশুর জন্মের পর থেকে হৃদপিন্ডের কোষের বিভাজন ক্ষমতা চলে যায়। পরিণত বয়সে হৃদপিন্ডের কোষগুলি কেবল আকারে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে হার্ট অ্যাটাকের সময় উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদপিন্ডের প্রাচীরের কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে পুনরায় সহজে মেরামত করা যায় না। হার্ট অ্যাটাকের পরে ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলি বিভাজিত না হবার ফলে সেই স্থানটি খালি থাকে ও পরে কোলাজেন প্রোটিনের ফাইবার দিয়ে পরিপূর্ণ হয়।
সে কেমন কলা?
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিচারে, ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় আবরণী কলায়। কিন্তু হৃদপিন্ড যোগকলা দিয়ে তৈরী, ফলে সেখানে ক্যান্সারের সম্ভাবনা স্বভাবতই খুব কম। আমরা জানি অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন ক্যান্সারের কারণ। কিন্তু কার্ডিয়াক মায়োসাইটগুলি পরিণত অবস্থায় বিভাজিত হতে পারে না, ফলে সেখানে টিউমার তৈরী হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে যায়।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের সুবিধা
বিবর্তনবাদ নিয়ে যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেন, তাঁদের মত হলো, প্রাকৃতিক নির্বাচন বা ন্যাচারাল সিলেকশন হৃদপিন্ডকে ক্যান্সার হওয়া থেকে রক্ষা করে। দেখা গেছে, মানুষের শরীরে যে সমস্ত অঙ্গগুলি একজোড়া করে থাকে যেমন, ফুসফুস, বৃক্ক ইত্যাদি তাদের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা বেশী। মানুষের হৃদপিন্ড একটি, সেটি স্তব্ধ হলে কাজ চালানোর দ্বিতীয় কোন অঙ্গ নেই, তাই তাতে ক্যান্সার সহজে হয় না।
নাকি মিউটেশন?
আবার জেনেটিকস বা বংশগতিবিদ্যা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের মতে কার্ডিয়াক মায়োসাইটে পরিব্যাপ্তি বা মিউটেশনের হার খুব কম। ক্রমাগত মিউটেশন ক্যান্সারের প্রধান কারণ, তাই ভীষণ কম মিউটেশনের জন্যে হৃদপিন্ডের কোষে ক্যান্সার হয় না।
আবার অ্যানাটমি?
মানুষের অ্যানাটমি দেখলে আর একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে তা হলো হৃদপিন্ডের বিশেষ অবস্থান। ত্বক নানা বিকিরণ, আলট্রা-ভায়োলেট রে, মিউটাজেন (মিউটেশনের জন্যে দায়ী বস্তু), কারসিনোজেন (বিভিন্ন বস্তু যা ক্যান্সারের কারণ) ইত্যাদির সংস্পর্শে আসে, পৌষ্টিকতন্ত্রের সাথে যুক্ত সমস্ত অঙ্গেও সহজে খাদ্যের সাথে কারসিনোজেন পৌঁছতে পারে। কিন্তু হৃদপিন্ডের অবস্থান একদম স্বতন্ত্র, ফলে পরিবেশের ঘাত-প্রতিঘাত, কারসিনোজেন, মিউটাজেন কিছুই সেখানে সহজে পৌঁছয় না, ফলে হৃদপিন্ড সুরক্ষিত থাকে ও সহজে ক্যান্সার হয় না।
এতগুলো কারণ দিয়ে আপাতত বিরলতম কার্ডিয়াক ক্যান্সারের রহস্যভেদ করা গেলো!
তথ্যসূত্রঃ
Ahuja P, Sdek P, MacLellan WR. Cardiac myocyte cell cycle control in development, disease, and regeneration. Physiol Rev. 2007;87(2):521-544. doi:10.1152/physrev.00032.2006
Siddiqi S, Sussman MA. The heart: mostly postmitotic or mostly premitotic? Myocyte cell cycle, senescence, and quiescence. Can J Cardiol. 2014;30(11):1270-1278. doi:10.1016/j.cjca.2014.08.014
Xia P, Liu Y, Chen J, Cheng Z. Cell Cycle Proteins as Key Regulators of Postmitotic Cell Death. Yale J Biol Med. 2019;92(4):641-650. Published 2019 Dec 20.
Nakamura M, Sadoshima J. Mechanisms of physiological and pathological cardiac hypertrophy. Nat Rev Cardiol. 2018;15(7):387-407. doi:10.1038/s41569-018-0007-y
Ren DY, Fuller ND, Gilbert SAB, Zhang Y. Cardiac Tumors: Clinical Perspective and Therapeutic Considerations. Curr Drug Targets. 2017;18(15):1805-1809.
doi:10.2174/1389450117666160703162111
Tzani A, Doulamis IP, Mylonas KS, Avgerinos DV, Nasioudis D. Cardiac Tumors in Pediatric Patients: A Systematic Review. World J Pediatr Congenit Heart Surg. 2017;8(5):624-632. doi:10.1177/2150135117723904
Yuan X, Braun T. Multimodal Regulation of Cardiac Myocyte Proliferation. Circ Res. 2017;121(3):293-309. doi:10.1161/CIRCRESAHA.117.308428
Leal-Esteban LC, Fajas L. Cell cycle regulators in cancer cell metabolism. Biochim Biophys Acta Mol Basis Dis. 2020;1866(5):165715. doi:10.1016/j.bbadis.2020.165715
Phan TG, Croucher PI. The dormant cancer cell life cycle. Nat Rev Cancer. 2020;20(7):398-411. doi:10.1038/s41568-020-0263-0
শুভময় দিল্লির অ্যামিটি ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজি এবং ইমিউনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।