~ কলমে জ্যোতির্ময় পাল
জানুয়ারী মাসের শেষ বেলায় পশ্চিম ভারতের দিকে তখন বেজায় ঠান্ডা। সকালের ব্রেকফাস্ট করে, একটা গরম কফি নিয়ে বসেছিলাম হিন্দুস্তান কপার লিমিটেডের গেস্ট হাউসের ব্যালকনিতে। ঘন কুয়াশার মধ্যে আবছা দেখা যাচ্ছে চারদিকের ছোট ছোট পাহাড় আর টিলা। সূর্য উঠে গেছে বোধ হয় ঘন্টা খানেক আগে, তাও কুয়াশার প্রাচীর টপকে তার আলো এসে পৌঁছায়নি এখনো। গেস্ট হাউসের উঠোনে একটা ময়ূর তার সঙ্গিনীর সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চিত্র ১: চাঁদমারি খোলামুখ তামার খনি। এখন আর খনিজ উত্তোলন হয় না, সেই জায়গায় তৈরি করা হয়েছে এক বিশাল জলাশয়।
আমরা চারজন কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব গাড়ি ধরে। চারজন বলতে আমি, আমার সহপাঠী, আমার একজন সিনিয়র এবং আমাদের প্রফেসর। সকালের দিকে যত ঠান্ডা থাকে, কুয়াশার আড়াল কেটে গেলেই সূর্যের তাপ ভীষণ ভাবে বাড়তে থাকে। আমরা যে কাজ করি, তাতে এই বেলা হবার আগে সূর্যের নরম আলোয় কাজ করাটাই সেরা সময়।
ওহ, আমাদের কাজ হল মাঠে ঘাটে চড়ে বেড়ানো, পাথর খুঁজে বেড়ানো, সেই সব পাথরের মাপজোক করা, পাথর ভেঙে ব্যাগে ভরা। গত তিনদিনে প্রায় ২০–৩০ কেজি পাথর আনা হয়ে গেছে। এখানে আরো দিন দশেক থাকার কথা। তাতে প্রায় ১০০ –১৫০ কেজি পাথর হয়ে যাবার কথা। সূর্যের তাপ বাড়তে থাকলে, রোদের মধ্যে পাথর দেখে বেড়ানো একটু কষ্টকর হয়।
কুয়াশার ঘোর একটু কাটতেই গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম। যেখানে যাচ্ছি, সেই জায়গার নাম চাঁদমারি। রাজস্থানের উত্তর ক্ষেত্রীর মধ্যে অবস্থিত একটা খোলামুখ তামার খনি। এখন আর এখানে তামা নিষ্কাশন হয় না। তামার খনির জায়গায় এক বিশাল গর্ত হয়ে রয়েছে। তাতে এখন তৈরি হয়েছে জলাশয়। গভীর নীল জল, জলাশয়ের গা বেয়ে উঠে গেছে পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপর এক ভাঙাচোরা দুর্গ।
চিত্র-২: চাঁদমারির ডোরাকাটা পাথর। (বাঁ দিকে) একটু দূর থেকে তোলা ছবিতে সমগ্র পাথরের বিস্তৃতি বোঝা যাচ্ছে। (ডান দিকে) কাছ থেকে তোলা ছবিতে সাদা কালো সমান্তরাল দাগগুলো দেখা যাচ্ছে।
চাঁদমারি পৌঁছতেই তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যেমন আকর্ষণ করেছিল, তেমনি তার ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য আমাদের অবাক করেছিল। এই রকম পাথর আগে কখনো দেখিনি। সাদা কালো ডোরাকাটা পাথরের স্তুপ। সেই ডোরাকাটা বৈচিত্র্য কিলোমিটারের পর কিলোমিটার চলেছে সমান্তরাল ভাবে। কখনো কোনাকুনি ভাবে একটা কালো শিরার মতো নকশা এই সমান্তরাল সাদাকালো দাগগুলোকে কেটে চলে গেছে। কখনো তৈরি হয়েছে গোল গোল কালো রঙের চাকার মত দাগ। এই সাদাকালো পাথরের গায়ে ছোপ ছোপ ভাবে লেগে আছে। এই কালো দাগগুলোকে আরো কাছ থেকে লেন্সের মধ্যে দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এরা ঠিক কালো না। কালচে সবুজ বা নীল। এই মিনারেলগুলোর নাম এম্ফিবোল (amphibole)। যে সমস্ত কালো শিরা সমান্তরাল নকশাকে কেটে গেছে, তাদের ভিতরে হলুদ চকচকে কিছু লেগে আছে। একই রকম চকচকে হলুদ গুঁড়ো লেগে আছে গোল গোল চাকতিগুলোরে মধ্যেও। বুঝতে অসুবিধা নেই, এইগুলোতেই আছে তামা সোনার গুঁড়ো। চাঁদমারি থেকে এইটুকু পর্যবেক্ষণ করে, পাথর সংগ্রহ করে নিলাম। গাড়িতে পাথরের ব্যাগ বোঝাই করে আরাবল্লীর ভাঁজে ভাঁজে চক্কর দিয়ে চললাম।
বিকেলে সূর্য ডুবতেই জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ে। রাতে বিশেষ কিছু করার নেই। কুয়াশা জমছে, চাঁদের মুখে কাপড়। রাস্তায় বিশেষ আলো নেই। আমাদের গেস্টহাউসের টিমটিমে আলোতে রাস্তা দেখা যাচ্ছে।
পরের কয়েকদিন গেলাম অন্যান্য খনিতে। এবার আর খোলা মুখ খনি না, আন্ডারগ্রউন্ডে। এই খনির নাম কলিহান। খনির নিচে নামার আগে আমাদের আগে মাথায় হেলমেট, পায়ে গামবুট, টর্চ সব পরে নেওয়া হল। হ্যাঁ, টর্চও পরতে হয়। খনিতে নামার সময় দুটো হাত ফাঁকা থাকা দরকার, তাই সেফটি ল্যাম্প সব সময় মাথার হেলমেটের সাথেই পরে নিতে হয়। প্রায় ১ কিলোমিটারের মত গভীর খনিতে নামতে গেলে সাধারণত লিফ্ট ফ্রি-ফল করে, কিন্তু আমরা অভ্যস্ত নয় বলে আস্তে আস্তেই নামতে লাগলো লিফ্ট। তাও প্রায় মিনিট দশেক লিফ্ট চলার পর লিফ্ট বন্ধ হল। খনির ভিতর খুব ভালো করে ভেন্টিলেশন করা থাকে। লিফ্ট থেকে নেমেই হাওয়ার দমক বুঝতে পারলাম। সেফটি ল্যাম্পের আলোয় পাথর খুঁজতে লাগলাম।
এ এক অবাক দেশ। চারিদিক চকমক করছে, ঝলমল করছে সেফটি ল্যাম্পের আলো পড়তেই। এই রকম আলোয় পাথর চেনা মুশকিল, তবুও তামার সালফাইডগুলো, যেগুলো ভীষণ চকচক করে, সেগুলো চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। খনির ভিতরকার কিছু ম্যাপ আছে, সাথে ওই খনির চাকরিরত একজন ভূতত্ববিদও আছেন। নাহলে প্রথমবারেই শুধু ম্যাপ দেখে খনির মধ্যেকার রাস্তা খুঁজে পাওয়া সহজ না। যত পাথর দেখছি, মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। খনির মধ্যে অনেক টানেল থাকে। কোনো কোনো টানেলের কাজ সম্পূর্ণ, অর্থাৎ সেখান থেকে খনিজ উত্তোলন চলছে। আর কোনো কোনো টানেল নতুন তৈরি হয়েছে। সেখানে ভেন্টিলেশন, আলো এসবের ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। যেহেতু খনিজ উত্তোলন শুরু হয়নি, সেই সব নতুন টানেলের পাথর একটু বেশি ফ্রেশ, আমাদের গবেষণার কাজে আসতে পারে। এই রকম একটা নতুন টানেলের মধ্যে ঢুকতেই খনির আসল পরিবেশ বুঝতে পারলাম। একদম হাওয়া নেই। গুমোট গরম। সেফটি ল্যাম্পের আলো নিভিয়ে দিলে পৃথিবী অন্ধ।
চিত্র ৩: (বাঁ দিকে) সেফটি ল্যাম্পের আলো ফেলে খনির মধ্যে পাথর দেখা। (ডান দিকে) খনির মধ্যে হেলমেট, গামবুট পরে পাথর ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে আমার প্রফেসর।
সেই ভয়ঙ্কর গরমে ল্যাম্পের আলোয় পাথর দেখে চলেছি। এর মধ্যে আমার প্রফেসর একটা পাথর দেখে উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। আমাকে বললেন ভাঙতে। পাথরটা রয়েছে আমার মাথার ওপরে। লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েকবার মেরে ভাঙার চেষ্টা করলাম। দেখলাম হলো না। আর এত ঘাম হচ্ছে, যে হাতুড়ি হাত থেকে পিছলে পড়ে যাবার মত অবস্থা। পাশেই দেখলাম দুজন লোক রয়েছে, যারা রোজ খনিতে কাজ করে। আমি তাদের একবার বললাম,
“দাদা, এই পাথরটা ভাঙতে একটু সাহায্য করুন না!”
ওরা হেসে ফেলল। বললো, “ধুর, ওই উঁচুতে পাথর ওই ভাবে ভাঙা যায় নাকি, ও তো ব্লাস্ট করতে হবে”।
যাই হোক, দেখলাম আমাকেই ভাঙতে হবে। এতদিন পাথর ভেঙে আমাদেরও অভ্যেস হয়ে গেছে যে কীভাবে হাতুড়ি চালালে পাথর ভাঙা যায়। পাথরের মধ্যে অল্প কিছু জায়গা থাকে, সেখানে ঠিক করে মারলে পাথর ভেঙে যাবে। এই অঞ্চলের পাথরের মধ্যে সেই রকম জায়গা অনেক আছে। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় আমি আর আমার প্রফেসর মিলে ভেঙে ফেললাম পাথর। খনির দেওয়াল থেকে খসে পড়তেই দেখলাম পাথরের ভিতরটা চকচক করছে হলুদ আভায়।
রাজস্থানের ক্ষেত্রী অঞ্চল প্রায় চষে ফেলেছিলাম আমরা পনেরো দিনে। বন-জঙ্গল-পাহাড় সমস্ত ম্যাপ মুখস্ত হয়ে গেছিল। দুপুরে যখন সূর্য মাথার ওপর, আমরা হয়ত কোনো টিলার ওপর উঠে তার গোপন গুহার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। আবার তাপ প্রবাহ কমে গেলে পাথর দেখা শুরু। সূর্য ডুবে গেলে সন্ধ্যে ঝপ করে নেমে আসে। আসেপাশের টিলাগুলো হারিয়ে যায় রাতের বিষণ্ণতায়।
আজকের এই উত্তর পশ্চিম রাজস্থানের প্রথম ভিত্তি পাথর হয়ত তৈরি হয়েছে অন্তত ২৫০ কোটি বছর আগে। কোনো এক নাম না জানা মহাসমুদ্রের মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপের মত তৈরি হয়েছিল। তার মত আরো ছোটছোট দ্বীপ হয়ত ছিল। প্রায় ১৭০ কোটি বছর আগে, আরো একটা এই রকম পাথরের দ্বীপ এসে ধাক্কা দেয়। চাপের ফলে সমুদ্রের পলিতে ভাঁজ পড়ে তৈরি হয় আজকের আরাবল্লী পর্বত। চাপ ছাড়াও ধাক্কার জন্য ঘর্ষণ জনিত তাপ উৎপন্ন হয়। তাপের প্রভাবে পারিপার্শ্বিক সমুদ্রের জলের মধ্যে একটা আপাত পরিচলন তৈরি হয় এবং জল গরম হয়ে ওঠে। গরম জল পৃথিবীর অভ্যন্তরের মধ্যে থেকে বিভিন্ন খনিজ পদার্থকে দ্রবীভূত করে নিতে পারে, যেমন লোহা, তামা ইত্যদি। জলের উষ্ণতা কমে গেলে এই জল থেকেই এই সব খনিজ মৌল থিতিয়ে পড়ে ভূপৃষ্ঠের পাথরের ওপর এবং পাথরের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে জটিল যৌগ বা মিনারেল তৈরি করে, যেমন পাইরাইট (লোহা + সালফার), চ্যালকো পাইরাইট (তামা + লোহা + সালফার), এম্ফিবোল (লোহা + ম্যাগনেসিয়াম + সিলিকা + ক্যালসিয়াম/সোডিয়াম)। ১৭০ কোটি বছর আগে যে ধাক্কা হয়, এই সময়ে সমুদ্রের পাললিক শিলা রূপান্তরিত হয়ে কোয়ার্টজাইট শ্রেণীর পাথর তৈরি করে। যাদের রাসায়নিক উপাদান হল সিলিকা, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম। এদের সাথে বিক্রিয়া করে লোহা-ম্যাগনেসিয়াম সম্পৃক্ত গরম জল। তৈরি করে নতুন মিনারেল এম্ফিবোল। অধিক ম্যাগনেসিয়াম থাকার কারণে, এই এম্ফিবোল-এর রং সাদা, যা সচরাচর দেখা যায় না। এই অঞ্চলে তামার উৎপত্তি কিন্তু তখনই হয়নি।
চিত্র-৪: মাইক্রোস্কোপের নিচে পাথর। বাঁ দিকে: পোলারাইজড আলোর নিচে দেখা যাচ্ছে নীল রঙের এম্ফিবোল। পাশের কালো জায়গা গুলোতে রয়েছে খনিজ পদার্থ, যা পোলারাইজড আলোয় দেখা যায় না। ডান দিকে: রিফ্লেক্টেড আলোর নিচে খনিজ পদার্থ গুলো দেখা যাচ্ছে : চ্যালকো পাইরাইট (সোনালী হলুদ) এবং পাইরাইট (পিঙ্ক/লালচে হলুদ) । এখানে আবার মাঝের এম্ফিবোলের জায়গাটা কালো হয়ে গেছে। রিফ্লেক্টেড আলোয় এম্ফিবোল দেখা যায় না।
রাসায়নিক ভাবে আমরা আরো দুই রকমের এম্ফিবোল আবিষ্কার করেছিলাম। প্রথম প্রকারের এম্ফিবোল সাদা রঙের। দ্বিতীয় এম্ফিবোল সবুজ রঙের। দূর থেকে দেখলে পাথরের মধ্যে কালচে সবুজ দেখায়। কিন্তু মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখলে সবুজ এম্ফিবোল দেখা যায়। মাইক্রোস্কোপের নিচে পাথরের আলাদা জগৎ। রঙিন, আঁকাবাঁকা পাথুরে নকশা সমস্ত চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পরিষ্কার দেখা যায়, সাদা এম্ফিবোল-এর ধার দিয়ে সবুজ এম্ফিবোল তৈরি হয়েছে। ঠিক যেন সাদা এম্ফিবোলকে খেয়ে নিয়েছে। এই রকম পাথরের আকৃতি থেকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে সবুজ এম্ফিবোল তৈরি হয়েছে সাদা এম্ফিবোল-এর পরে।
মাইক্রোস্কোপের নিচে অনেক পাথর দেখে বোঝা যায় যে আরও এক রকমের এম্ফিবোল এই অঞ্চলে তৈরি হয়েছে যা কিনা সাদা এবং সবুজ দুই রকম এম্ফিবোল-এর থেকেও নতুন। রঙের দিক থেকে এই এম্ফিবোল নীলচে এবং রাসায়িনক ভাবে বেশ বৈচিত্র্যময়। অন্যালিসিস করে দেখা যায় এর মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম এবং ক্লোরিন। সাধারণত এম্ফিবোলে ক্লোরিন থাকে না। কিন্তু কোনো গরম জল তার মধ্যে ক্লোরিন দ্রবীভূত করে আনলে, সেই ক্লোরিন বিক্রিয়া করে এম্ফিবোলের মধ্যে আসতে পারে। সাথে থাকল সোডিয়াম। এই দুটি রাসায়নিক উপাদান পাশাপাশি থাকলে স্বাভাবিক বিক্রিয়া করে, এবং আমরা অনেকেই জানি এই বিক্রিয়া থেকে তৈরি হয় নুন, বা সোডিয়াম ক্লোরাইড।
প্রায় কয়েকশ কোটি বছর আগে আজকের রাজস্থানের কাছাকাছি ছিল এক বিশাল হ্রদ। হতে পারে, দুই প্রাচীন দ্বীপের মাঝে যে সমুদ্র ছিল তার কিছু অংশ ভূতাত্ত্বিক আলোড়নের ফলে চারপাশে স্থলবেষ্টিত হয়ে হ্রদ তৈরি করে। তবে এগুলো কেবল অনুমান মাত্র। হ্রদ ঠিক কীভাবে তৈরি হতে পারে, এখন আর বলা সম্ভব নয়, তবে হ্রদ জাতীয় জলাভূমি ছিল, সেই বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যায়, কারণ হ্রদের জল সাধারণত অতিরিক্ত লবনাক্ত হয়। এম্ফিবোলের মধ্যে প্রাপ্ত ক্লোরিন এই রকম এক হ্রদ থাকার সম্ভাবনাকে প্রায় নিশ্চিত করে। হ্রদের উষ্ণ লবনাক্ত জলের ক্লোরিন পাথরের সাথে বিক্রিয়া করে ক্লোরাইড যৌগ তৈরি করতে পারে। পাথরের মধ্যে সব রকমের মৌল থাকে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার ওপর দিয়ে এই রকম গরম লবনাক্ত জল প্রবাহিত হলে, লোহা, তামা, কোবাল্ট, নিকেল, সোনা— এই জাতীয় মৌলগুলো দ্রুত দ্রবীভূত হয়। লবনাক্ত জল সম্পৃক্ত হয় মূল্যবান মৌলের দ্বারা। যেহেতু লবন জলে ক্লোরাইড থাকে, তাই এই সব মৌলগুলো তৈরি করে কোপার-কোবাল্ট এর ক্লোরাইড, যা কিনা জলে দ্রবীভূত হয়ে পরিবাহিত হতে পারে। জলের উষ্ণতা কমে গেলে আবার দ্রাব্যতা পরিবর্তিত হয়। আর এই সমস্ত ক্লোরাইড যৌগকে পরিবহন করতে পারে না। তখন শুরু হয় ডিপোজিশন এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া। অর্থাৎ, আগে যে সব মৌলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত, জলের দ্বারা পরিবাহিত হয়ে সবাই একত্রিত হয়ে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়। আগের যে সমস্ত সবুজ এবং সাদা এম্ফিবোল ছিল, তাদের সাথে বিক্রিয়া করে এই লবনাক্ত জল। এম্ফিবোল জারিত হয়, এবং লবনাক্ত জল বিজারিত হয়ে তৈরি করে সালফাইড এর যৌগ, যার মধ্যে জমে ওঠে তামা, কোবাল্ট , নিকেল, সোনা, এবং উরেনিয়ামের মত খনিজ পদার্থ। কোটি কোটি বছরের রাসায়নিক বিক্রিয়াতে এই সব মূল্যবান খনিজ জমতে থাকে উত্তর আরাবল্লীর পাথুরে জমির মধ্যে। এই সব খনিজের সাথে তৈরি হয়, নীলচে এক যৌগ, এম্ফিবোল।
রাজস্থানের পাথর নিয়ে আমি এই টুকুই কাজ করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কি ভাবে এখানে তামার খনি তৈরী হয়েছে তার ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা। সাথে, এমন একটা মিনারেল কে ইন্ডিকেটর হিসাবে খুঁজে বের করা যার সাথে খনিজ পদার্থের একটা সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। আমরা যেমন খুঁজে পেয়েছিলাম যখন নীল এম্ফিবোল তৈরী হলো, তখনই তামা-লোহা-সোনার খনিজ গুলো জমেছিলো। অর্থাৎ দুজনের উৎপত্তি গত সাদৃশ্য রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক ভাবে এই রকম মিনারেল বেশ গুরুত্ব পূর্ণ। ভবিষ্যতে অচেনা কোনো জায়গায়, যেখানে কোনো খনি নেই- সেরকম জায়গায় কেউ যদি একই মিনারেল খুঁজে পায়, তখন আন্দাজ করা যেতে পারে যে ওই চত্বরেও তামার খনি থাকতে পারে এবং দরকার হলে সার্ভে করা যেতে পারে। আমাদের ক্ষেত্রে এই রকম ইন্ডিকেটর মিনারেল ছিল এই নীল এম্ফিবোল।
রাজস্থান থেকে চলে এসেছি অনেক বছর আগে, সেই বিষয়ে গবেষণা পত্র লেখালেখি হয়েছে, আমার এই বিষয়ে পড়াশুনো শেষ করার পরেও আমার প্রফেসর এবং সিনিয়র মিলে রাজস্থানের ক্ষেত্রী অঞ্চলের তামার উৎপত্তি এবং সামগ্রিক ভূতত্ত্বের ওপর অনেক কাজ করেছেন। অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের আবিষ্কার ছাড়াও সেই অঞ্চলের জীবন যাপন, প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভোলার মত নয়। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে, সেই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার অনুভূতি সব থেকে নিজের। সেই অনুভূতির স্মৃতিতে থাকে কয়েক টুকরো চ্যালকো পাইরাইট।
———————
জ্যোতির্ময় পাল পৃথিবীর বিবর্তন এবং ভূগতিবিদ্যার (Earth evolution and eodynamics) গবেষক, বায়রয়েৎ বিশ্ববিদ্যালয়।