~ কলমে এলেবেলের অতিথি অহংজিৎ ভট্টাচার্য ~
চপস্কিন-এমজি-কাফে!
আমার ইস্কুলের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক (স্বর্গীয়) শ্রী অজিত কুমার সেনগুপ্ত একবার জীবনবিজ্ঞান ক্লাসে ঢুকেই চিরাচরিত নাটুকে ভঙ্গিতে এই বিদঘুটে শব্দবন্ধটি ঘোষণা করলেন। আমরা থতমত খেয়ে থাকতে থাকতেই অজিতদা বললেন— এটা কোনো নতুন কফি খাওয়ার জায়গা নয় রে, প্রাণ তৈরির মূল উপাদান হল এই মৌলগুলো। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, ইত্যাদি মৌলের রাসায়নিক সংকেত (C, H, O, P, S, K, N, Na, Mg, Ca, Fe) মিলিয়ে চপস্কিন-এমজি-কাফে। পরে জেনেছিলাম লম্বা কোনো নামের তালিকার এইরকম মজার সংক্ষিপ্ত রূপকে স্মৃতি-সহায়ক বা mnemonic বলে। সে যাই হোক, ছোটবেলায় এটা জেনে খুব অবাক লাগত যে ব্যাক্টিরিয়া থেকে নীলতিমি, সব জীবই আসলে জড়-পদার্থ দিয়ে তৈরি। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মৌলেরা জুড়ে জুড়ে প্রোটিন, শর্করা, নিউক্লিক অ্যাসিড, ফ্যাট, ইত্যাদি জড় অণু তৈরি করে ও তারপরে সেগুলির সমাবেশ ঘটে কোষসমূহ গঠিত হয়। স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, জড় ও জীবের সীমানা তাহলে কোথায়? মূলগত ভাবে দুই-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি, নাকি আণবিক জটিলতাতেই এর উত্তর নিহিত? এই প্রশ্নগুলি বৈজ্ঞানিক অ-বৈজ্ঞানিক সকলকেই বহুকাল ধরে ভাবিয়ে এসেছে আর এখনো ভাবিয়েই চলেছে।
(১) কোথায় এবং কীভাবে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল? (২) আমরা কি মহাবিশ্বে একা?
চিত্র ১: স্ট্যানলি মিলারের ব্যবহৃত যন্ত্র (বাঁ দিকে) ও স্ট্যানলি মিলার (ছবি: উইকি কমন্স)
২০০৫ সালে বিখ্যাত সায়েন্স পত্রিকা তার ১২৫-তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে “”২৫টি অমীমাংসিত প্রশ্নের”” একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল।১ তার মধ্যে ২টি প্রশ্ন ছিল— (১) কোথায় এবং কীভাবে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল? (২) আমরা কি মহাবিশ্বে একা? একবিংশ শতাব্দীতে শুধু নয়, সভ্যতার প্রারম্ভকাল থেকেই মানুষ এই প্রশ্নগুলির ব্যাপারে মহা উৎসুক। প্রাচীন বা মধ্যযুগে অনেক ধর্মীয়, লৌকিক ও আধা-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রচলিত ছিল কীভাবে প্রাণ সৃষ্টি হল সে ব্যাপারে। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে পদার্থবিদ্যা রসায়নে বৈপ্লবিক অগ্রগতির সুবাদে এই বিষয়েও নতুন নতুন চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটল। বিজ্ঞানীদের মনে ক্রমশ এই ধারণা প্রকট হল যে প্রাণের উৎস নেহাৎ কোনো দৈবযোগ ছিল না। বিশ্ব-সংসারের আর সব ঘটনার মত এরও যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা সম্ভব। ১৯২০-র দশকে রুশ বিজ্ঞানী আলেকসান্দার আপারিন ও ব্রিটিশ-ভারতীয় বিজ্ঞানী জে বি এস হ্যাল্ডেন প্রস্তাব দিলেন যে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে জড়পদার্থ থেকেই। যেভাবে গবেষণাগারে অণু-পরমাণুর মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগে নতুন পদার্থ তৈরি হয় ঠিক সেভাবেই। পৃথিবীর শৈশবে নাকি সারা জগৎ জুড়ে এক প্রকান্ড সাগর ছিল ও সেখানে প্রাণের জন্য আবশ্যক অণুসমূহ দ্রবীভূত ছিল। সেই সময়ে আবহাওয়া ছিল অনেক উষ্ণ, আগ্নেয়গিরি থেকে হত ক্রমাগত উদ্গীরণ, মহাশূন্য থেকে মুহুর্মুহু নেমে আসত প্রজ্বলন্ত উল্কারা, আর তরুণ সূর্য থেকে পৌঁছাত তীব্র অতিবেগুনী রশ্মি—সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবী যেন রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটা মস্ত আধার ছিল। কল্পকাল ধরে এই তপ্ত সাগরে অসংখ্য বিক্রিয়া ঘটতে থাকল ও জটিলতর অণু সৃষ্টি হতে থাকল। হ্যাল্ডেন এই জৈব-উপাদানে ভরপুর কাল্পনিক মহাপ্রাচীন সাগরের নাম দিয়েছিলেন “Primordial Soup” বা “”আদিম সূপ””। উল্লেখনীয় হল, বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন-ও প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে লিখেছিলেন যে প্রাণের জন্ম হয়েছিল কোনো জলাধারেই— মজা করে যার নাম তিনি দিয়েছিলেন “”উষ্ণ পুষ্করিণী”” (warm little pond)। এই আদিম সূপের ধারণাটি প্রথমদিকে তাত্ত্বিকই ছিল। আদিম পৃথিবীর অনুরূপ অবস্থা গবেষণাগারে কীভাবে বানানো সম্ভব, এই ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। তারপরে ১৯৫২ সালে স্ট্যানলি মিলার নামে ২১ বছর বয়সী এক তরুণ বিজ্ঞানী হঠাৎই বিজ্ঞান জগতে হইচই ফেলে দিলেন।
চিত্র ২: ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের একটি দৃশ্য (চিত্র লেখকের দ্বারা গৃহীত, মে ২০১৯) শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ইউরির ছাত্র ছিলেন মিলার। সৌরমণ্ডলের উৎপত্তি নিয়ে প্রধানত আগ্রহী হলেও ইউরির মনে প্রাণের উৎপত্তি নিয়েও আগ্রহ জন্মায়। তাঁর ধারণা হয় যে প্রাণ সৃষ্টির পিছনে আদিম পৃথিবীর বিজারক (অক্সিজেন-বিহীন) বায়ুমন্ডলের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মিলার এই চিন্তা-ভাবনার দ্বারা ভীষণভাবে উৎসাহিত হন ও ধারণাটি বাস্তবায়িত করার জন্য খুব তাড়াতাড়ি ইউরিকে রাজি করান। মূল উদ্দেশ্য ছিল গবেষণাগারের মধ্যে আদিম পৃথিবীর সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলীয় দশা অনুকরণ করা। তিনি একটি যন্ত্র বানালেন (চিত্র ১) যার এক অংশে জল ফুটে বাষ্প তৈরী হবে (অগ্ন্যুৎপাতের অনুকরণে), সেই বাষ্প আরেক অংশে মিথেন, অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন গ্যাসের সাথে মিশ্রিত হবে, তারপর সেই মিশ্রণের ওপর একটানা তড়িৎ-প্রবাহ চালিত করা হবে (বজ্রবিদ্যুতের অনুকরণে)। এক সপ্তাহ ধরে এই প্রক্রিয়া চলার পর জলীয় মিশ্রণটি হলদে-বাদামী রং ধারণ করল। সেটি বিশ্লেষণ করে মিলার জানতে পারলেন যে গ্লাইসিন, অ্যাসপার্টিক অ্যাসিড, অ্যালানিনের মত বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড (যা প্রোটিন তৈরির মূল উপাদান) এবং অনেক জৈব অণু তৈরি হয়েছে! এটিই হল প্রথম পরীক্ষা যেখানে নিশ্চিতভাবে দেখানো হয়েছিল যে তাপ ও বৈদ্যুতিক শক্তির দ্বারা সামান্য গ্যাসীয় পদার্থ থেকেও প্রাণ সৃষ্টির উপাদান তৈরি করা যায়। ছাত্রের কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে ইউরি মিলারকে এককভাবে গবেষণাপত্রটি প্রকাশনার জন্য পাঠাতে বলেন (যা পরীক্ষামূলক গবেষণার ইতিহাসে অতি বিরল!)। ইউরি চেয়েছিলেন যে তাঁর খ্যাতির আড়ালে যেন মিলারের নাম চাপা না পড়ে যায়। তারপর ১৯৫৩ সালের ১৫ই মে সায়েন্স পত্রিকায় গবেষণাপত্রটি ছাপা হয় ও ইতিহাস সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে মিলার সান দিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন ও তাঁর ছাত্র জেফ্রী বাদার সঙ্গে এই বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। মিলারের এই যুগান্তকারী পরীক্ষার ফলে প্রাক-জৈবিক রসায়ন (Prebiotic Chemistry) নামক গবেষণাক্ষেত্রের সূচনা হয় এবং কী কী উপায়ে আদিম পৃথিবীতে নিউক্লিক অ্যাসিড, শর্করা, ফ্যাট, ইত্যাদি জৈব-অণু প্রথম সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে সেই বিষয়ে ক্রমশ আলোকপাত ঘটে। এই গবেষণাক্ষেত্রে স্ক্রিপ্স গবেষণা সংস্থানে (ক্যালিফর্নিয়ার লা হোয়া-তে অবস্থিত) কর্মরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী রামনারায়ণ কৃষ্ণমূর্তির অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রাণের উৎপত্তি খোঁজার সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা এটাই যে কালের স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরে ঘটনাগুলো চাক্ষুষ করার কোনো উপায় নেই।
প্রাণের উৎপত্তি খোঁজার সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা এটাই যে কালের স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরে ঘটনাগুলো চাক্ষুষ করার কোনো উপায় নেই। গবেষণাগারে মিলারের মত কৃত্রিম দশা সৃষ্টি করে অনেক রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলিও বিশেষ অনুমান-সাপেক্ষ। তাছাড়া আদিম পৃথিবীতে কী কী গ্যাস ছিল, তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলীয় দশা কেমন ছিল ইত্যাদি ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। তাহলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্যের কি কোনোদিনই উদ্ঘাটন হবে না? সমস্যাটি দুরূহ, কিন্তু এরও একটি সমাধান আছে। আমাদের পৃথিবীতেই অনেক জায়গা আছে যা এখনো প্রাচীন পৃথিবীর মতই চরমভাবাপন্ন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল থেকে এরকম অনেক জায়গা সম্বন্ধে জেনেছিলাম, কিন্তু প্রথমবার সেরকম কিছু চাক্ষুষ করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম। স্থানটি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। প্রায় ন’হাজার বর্গকিমি এলাকা জুড়ে থাকা এই আগ্নেয় ভূমিতে একের পর এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। কোথাও টগবগে ফুটন্ত জলের হ্রদ, কোথাও তীব্র অম্লীয় জলের হ্রদ, কোথাও মাটি ভেদ করে তেড়েফুঁড়ে বেরোচ্ছে বাষ্প, আর কোথাও বাতাসে সালফারের কটু গন্ধ (চিত্র ২)। যা আরো বিস্ময়কর তা হল এই সমস্ত নরকসম স্থান আণুবীক্ষণিক প্রাণে পরিপূর্ণ। প্রাণ যদি এত চরম অবস্থাতেও টিকে থাকতে পারে, প্রাণের সৃষ্টিও কি এরকম কোথাও হয়ে থাকতে পারে না? এরকম আরেক আকর্ষণীয় স্থান হল গভীর সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে থাকা তাপরন্ধ্র। ক্রমাগতভাবে উচ্চ তাপমাত্রার (অনেকক্ষেত্রে ক্ষারকীয়) জল উদ্গীরণ করলেও স্থানগুলি যেন মরুভূমির বুকে মরুদ্যান! বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ মনে করেন যে প্রাণের উৎপত্তি হয়তো এরকম কোনো স্থানেই হয়েছিল। প্রাণের উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় মহাজাগতিক বস্তুতেও। মহাশূন্যে ঘুরতে থাকা ধূমকেতু বা গ্রহাণুতে বহু রকমের জৈব-অণুর সন্ধান পাওয়া গেছে। যখন এরকম বস্তু উল্কা হয়ে পৃথিবীতে খসে পড়ে তখন সেই জৈব-অণু থেকেও প্রাণের সঞ্চার ঘটে থাকতে পারে। এছাড়া আমাদের সৌরমন্ডলেই অনেক গ্রহ ও উপগ্রহ আছে যেখানে ধারণা করা হয় যে প্রাণের অনুকূল অবস্থা থাকা অসম্ভব না।
ইউরোপের সার্ন (CERN)-এ যেভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা চলছে, কিছুটা সেভাবে।
প্রাণের উৎপত্তি খোঁজার জন্য বিজ্ঞানীরা আরও একটি চতুর পন্থা বার করে ফেলেছেন। ইউরোপের সার্ন (CERN)-এ যেভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা চলছে, কিছুটা সেভাবে। মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং-এর সময়কালে ফিরে যাওয়া অসম্ভব ঠিকই, কিন্তু অনুরূপ অবস্থা তৈরি করার প্রয়াস চলছে সার্ন-এ এবং সেখান থেকে প্রকৃত ঘটনাধারার বিষয়ে বেশ কিছুটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। একই রকম ভাবে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে প্রাণ সৃষ্টি করার চেষ্টায় রত আছেন। উদ্দেশ্য হল, প্রাণ সৃষ্টির ন্যূনতম ‘রেসিপি’-টা কী, তা খুঁজে বার করা। এই নতুন গবেষণাক্ষেত্রের নাম দেওয়া হয়েছে সংশ্লেষী জীববিদ্যা (Synthetic Biology)। যেভাবে রসায়নের সংশ্লেষী-শক্তির দ্বারা নতুন নতুন পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে, সেভাবেই সংশ্লেষী জীববিদ্যাকে ব্যবহার করে নতুন জৈব-প্রক্রিয়া তৈরির প্রয়াস চলছে। এমনকি নতুন ধরণের প্রাণ, যার অস্তিত্বই কখনো ছিলনা, তা-ও কোনো একদিন হয়তো তৈরি হবে। সেই গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ— কিন্তু অন্য আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। ততক্ষণ চপস্কিন-এমজি-কাফেতে বসে আদিম সূপে চুমুক দেওয়া যাক!
তথ্যসূত্র:
১. https://www.sciencemag.org/site/feature/misc/webfeat/125th/
২. Antonio Lazcano and Jeffrey L. Bada. The 1953 Stanley L. Miller Experiment: Fifty Years of Prebiotic Organic Chemistry. Origins of Life and Evolution of the Biosphere 33: 235–242, 2003.
লেখক সান দিয়েগোর ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম প্রাণ ও প্রাণের উৎপত্তির ওপর গবেষণা করে পি.এচ.ডি লাভ করেছেন। বর্তমানে লেখক স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষক হিসেবে কর্মরত।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।