বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, “গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পার।” আমি বললাম, “বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না?” কারণ, তিব্বতীয় মালভূমিতে অক্সিজেন ঘনত্ব সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০% কম আর সূর্যের অতি-বেগুনী রশ্মি ৩০% বেশি। তার ওপর চরম ঠান্ডা আর খাদ্যও পর্যাপ্ত নয়। তিব্বতীয় মালভূমি প্রায় গড়ে পনের হাজার ফুট উঁচু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে। গত নয় হাজার বছর ধরে সেখানে মানুষের স্থায়ী বসবাস শুরু হয়েছে। এই কয়েক হাজার বছর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের জিনগত পরিবর্তন হয়েছে। ফলে তিব্বতীরা প্রকৃতির এই সব ভ্রুকুটি সহ্য করে নিজেদের দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে সেখানে, বিভিন্ন অভিযোজন দ্বারা। আমরা কি আর বললেই, তা হুট করে পারব? বাকি প্রসঙ্গ নাহয় বাদই দিলাম, অক্সিজেনের ব্যাপারটাই তো মারাত্মক হবে। প্রথমে উচ্চতা জনিত অসুস্থতা শুরু হবে, সেটি পাত্তা না দিলে, হয় ফুসফুসে জল জমে, নয় মস্তিষ্কে অক্সিজেন না পৌঁছে কিছু সময়ের মধ্যে খাঁচার ভেতর থেকে অচিন পাখির বেরিয়ে যাবার আশঙ্কা প্রবল। তাই কিছুদিন কসরত-টসরত করে অল্প অল্প করে উচ্চতা বাড়িয়ে শরীরটাকে সইয়ে নিলে তারপর না হয় তিব্বত যাবার কথা ভাবা যেতে পারে গরমের জন্য।
এখন কথা হল, যে কোন বায়ুজীবির প্রতিটি কোষে শক্তি উৎপাদনের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য্য। কিন্তু যদি কখনো শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, যাকে হাইপক্সিয়া (Hypoxia) বলে, কোষ কিভাবে তা টের পায় আর কিভাবে তা মোকাবিলা করার চেষ্টা করে? এর জন্যে বেশ অনেকগুলি পদ্ধতি আছে, যেমন কোষের ভেতরে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়ামের পরিমাণের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, কোষের বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, আর অন্যতম ঘটনাটি হল- কোষে অক্সিজেনের অভাবে বেঁচে থাকার জন্য কিছু বিশেষ প্রোটিন তৈরি করে। জীবদেহে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড বা ডিএনএ-তে গাঁথা থাকে প্রতিটি প্রোটিনের সঙ্কেত। ডিএনএ-র ছাঁচে তৈরি হয় রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ, আর আরএনএ-র সঙ্কেত অনুযায়ী বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় প্রোটিন। ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরির প্রক্রিয়াকে বলে আরএনএ সংশ্লেষ (Transcription)। এই প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক ভাষায় একটু পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ এক নিউক্লীক অ্যাসিডের ছাঁচ থেকে অন্য নিউক্লিক অ্যাসিড তৈরি হল, কিন্তু ভাষাটা বদলাচ্ছেনা, একই আছে- নিউক্লিক অ্যাসিড, তাই একে বলে Transcription। কিন্তু নিউক্লীক অ্যাসিড আরএনএ থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড মানে রাসায়নিক ভাষাটাই বদলে গেল, তাই এই প্রক্রিয়াকে বলে প্রোটিন সংশ্লেষ বা অনুবাদন (Translation)। বোঝাই যাচ্ছে, কোষে কোন প্রোটিনের পরিমাণ নির্ধারিত হয়, কোষে ওই প্রোটিনের সঙ্কেত বহনকারী কত আরএনএ আছে তার ওপর। এছাড়া, প্রোটিনটি কোষে কতক্ষণে রাসায়নিক ভাবে না ভেঙ্গে বজায় থাকছে, সেটাও আরেকটা বড় ব্যাপার। আরএনএ তৈরি নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন আরএনএ সংশ্লেষ নিয়ামক (Transcription Factor)। এরাও এক বিশেষ ধরণের প্রোটিন। এই আরএনএ সংশ্লেষ নিয়ামকরা এসে ডিএনএ-তে বসে, ডিএনএ-তে বসে তারা ডেকে নিয়ে আসে আরএনএ সংশ্লেষের অন্যান্য উপাদানকে, ফলে আরএনএ তৈরি হয়। এরকমই একটি নিয়ামক গোষ্ঠী হল Hypoxia-Inducible Factors (HIFs), যার প্রধান দুটি সদস্য- HIF1 আর HIF2। এরা কোষে অক্সিজেন ঘাটতি হলেই সক্রিয় হয়। আর তার ফলে দ্রুত বহু অক্সিজেনের অভাব জনিত সমস্যা দূর করতে শ’ খানেকেরও ওপর প্রোটিন তৈরিতে সহায়তা করে। সেই প্রোটিনদের কেউ চেষ্টা করে অক্সিজেনের অভাবেও কিভাবে বিপাকক্রিয়া চালানো যায়, আর শক্তি উৎপাদন করা যায়। কোন প্রোটিনেরা আবার চেষ্টা করে যেটুকু অক্সিজেন আছে, তা সুষ্ঠু ভাবে যতটা ভাগ করে দেওয়া যায়। এরকম বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে HIF-রা চেষ্টা করে কোষকে বাঁচিয়ে রাখতে।
যখন শরীরে অক্সিজেনের কোন কমতি নেই, অক্সিজেনের প্রভাবে বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় HIF1 কোষের মধ্যে ভেঙে যায়, কিন্তু যখন অক্সিজেন নেই, তখন সেই বিক্রিয়াটা হয়না। ফলে HIF1 ভাঙে না, আর আরএনএ সংশ্লেষ নিয়ামক হিসেবে তার কাজ শুরু করে দেয়। তিব্বতী বা শেরপাদের ক্ষেত্রে অন্যান্য পার্বত্য অভিযোজনের সাথে, HIF-গোষ্ঠীর বা HIF-গোষ্ঠীর স্থায়িত্বের সাথে যুক্ত বিভিন্ন প্রোটিনের কার্য্যকারিতা সমতলের মানুষের চেয়ে ভিন্ন। যে জন্য কম অক্সিজেন ঘনত্বেও তাদের বিশেষ অসুবিধে হয়না। রক্তাল্পতা, হৃদরোগের ক্ষেত্রে HIF প্রাণদায়ী ভূমিকা নেয়, তাই HIF কে রাসায়নিক ভাবে ভেঙ্গে ফেলতে ভূমিকা নেয়, সেরকম প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ তৈরি হয়েছে ও সাফল্যও পাওয়া গেছে এসব রোগে।
কিন্তু রক্তাল্পতা, হৃদরোগের ক্ষেত্রে HIF প্রাণদায়ী ভূমিকা নিলেও, বেশির ভাগ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে HIF বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন ক্যান্সার কোষ দ্রুত বাড়তে থাকে আর মাংসল টিউমার তৈরি করে, তখন রক্তবাহী নালিগুলো টিউমারের চাপে সঙ্কুচিত হয়ে যায় ও অক্সিজেন চলাচল ব্যহত হয়। ফলে টিউমারে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছয় না। এদিকে অক্সিজেন কম থাকায় টিউমারে HIF1 ভাঙ্গেনা। HIF1 কর্তব্যে অটল। কোন কোষ ভাল, কোন কোষ মন্দ, এসব বিচার সে করেনা। বরং টিউমারে থাকা অক্সিজেনের অভাবে ক্যান্সার কোষগুলোকে বাঁচাতে সে বেশি তৎপর হয়। ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধির জন্যে প্রচুর গ্লুকোজ, জ্বালানি হিসেবে লাগে শক্তি উৎপাদনে। HIF1 তাই ক্যান্সার কোষে গ্লুকোজ যোগান দিতে গ্লুকোজ পরিবাহক(Glucose Transporters) শ্রেণীর প্রোটিন তৈরি করতে থাকে, যারা কোষে গ্লুকোজ যোগানে সহায়তা করে। তারপর, HIF1 তৈরি করে VEGF নামে একটি প্রোটিন। এই VEGF নতুন রক্তবাহক তৈরি করে টিউমার অঞ্চলে, অক্সিজেনের সুষম বণ্টনের জন্য। এছাড়া, HIF-রা আরও অনেক প্রোটিন তৈরি করে যা ক্যান্সার কোষকে হুহু করে বাড়তে সাহায্য করে। মূলতঃ, এই HIF-দের সক্রিয়তা ক্যান্সার কোষকে কম অক্সিজেন পরিবেশেও বাঁচিয়ে রাখে। এমনকি, HIF এমন কিছু প্রোটিন কল তৈরিতে অংশ নেয়, যা কেমোথেরাপির ওষুধ ক্যান্সার কোষের বাইরে থুঃথুঃ করে বের করে দেয়। ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ওষুধ বানানো হয়েছে HIF-কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখনো খুব বড় মাপের সাফল্য পাওয়া যায়নি। তাই তাকিয়ে থাকতে হবে ভবিষ্যতের দিকে।
এবার, এই HIF-দের কথা জানা গেল কিভাবে? কি করে জানা গেল HIF-দের ভাঙ্গা গড়া, তার সাথে তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রোটিনের ওঠাপড়ার গল্প? গল্পটা শুরু হয়েছিল এরিথ্রোপোয়েটিন (EPO) নামে হর্মোন দিয়ে। কোষে অক্সিজেন কম থাকলে EPO তৈরি হয় এটা জানা ছিল। ১৯৯৫ সালে বিজ্ঞানী পিটার র্যাটক্লিফ (Peter Ratcliffe), গ্রেগ সেমেনযা (Gregg Semenza) পৃথক ভাবে আবিষ্কার করলেন, EPO জীনের ডিএনএ-তে একটি বিশেষ অঞ্চল আছে, যেখানে কোন আরএনএ সংশ্লেষ নিয়ামক বসে EPO হরমোন তৈরিতে সহায়তা করে। ওঁরা দেখলেন, এটা সব কোষেই আছে, এবং কম অক্সিজেনে পরিবেশে তৈরি অন্যান্য প্রোটিন যেমন, VEGF-র সঙ্কেতবাহী ডিএনএ-তেও এই ধরণের অঞ্চল আছে। ওঁরা বুঝলেন, এটা কোষের অক্সিজেন মাত্রা নির্ধারণের একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। সেমেনযা-র ল্যাব থেকে আবিষ্কৃত হল আরএনএ সংশ্লেষ নিয়ামক গোষ্ঠীর প্রোটিন। তাঁরা তার নাম দিলেন Hypoxia-Inducible Factor-1 (HIF-1)। এভাবেই HIF আবিষ্কার হল। দেখা গেল, HIF-1 কোষে কম অক্সিজেনের পরিবেশেই পাওয়া যায়। এদিকে হারভার্ডের বিজ্ঞানী বিল কেলিন (William G. Kaelin) ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে জানতেন, বৃক্ক বা কিডনির ক্যান্সারে VHL বলে একটি প্রোটিনের অভাবে প্রচুর রক্তজালিকা তৈরি হয়। এটাও দেখলেন, VHL-র অভাবে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতেও VEGF সহ অন্যান্য HIF নিয়ন্ত্রিত প্রোটিন তৈরি হতে পারে। বুঝলেন, VHL আর HIF-র মধ্যে একটা যোগ আছে। কেলিন আর র্যাটক্লিফ দেখলেন, পর্যাপ্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে HIF-এ একটি রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, ফলে তা VHL-র সাথে সংযুক্ত হতে পারে। এবং সেটিই পর্যাপ্ত অক্সিজেনে HIF-র ভেঙে যাবার কারণ। অক্সিজেনের অভাবে HIF-এ ওই রাসায়নিক পরিবর্তনটি ঘটে না, ফলে VHL-র সাথে সংযুক্তও হতে পারেনা। তাই ভেঙ্গেও যায়না। বরং সক্রিয় হয়ে কম অক্সিজেনে বেঁচে থাকার উপযোগী প্রোটিন তৈরিতে সহায়তা করে। গত তিন দশকে কোষে এই HIF সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য জানা গেছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও চেষ্টা চলছে, HIF সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ তৈরির। ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে HIF কে নিষ্ক্রিয় করার বিভিন্ন ওষুধের। কোষের অক্সিজেন সংবেদনশীলতার এই বিস্তারিত পথটি আবিষ্কারের জন্য ২০১৯ সালে সেমেনযা, র্যাটক্লিফ ও কেলিনকে শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসা বিদ্যায় নোবেল সম্মানে ভূষিত করা হয়। ~~~~~
*প্রসঙ্গতঃ, আমার বর্তমান গবেষণার পথ-প্রদর্শক ডঃ পিটার অ্যাডামসের পথ-প্রদর্শক ছিলেন প্রফেসার বিল কেলিন। তাঁর নোবেলের খবর শুনেই আমরা বলেছিলাম, যাক, ঠাকুরদা নোবেলটা পেলেন তাহলে। কারণ, ২০১৬ সালে এই তিনজন যখন ‘অ্যামেরিকার নোবেল’ অ্যালবার্ট ল্যাসকার চিকিৎসা গবেষণা পুরস্কার পান; তখন থেকেই মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল, এঁদের আসল নোবেল পাওয়াটা খালি সময়ের অপেক্ষা।
ছবিতে বাম দিক থেকে তিন বিজ্ঞানী বিল কেলিন, পিটার র্যাটক্লিফ এবং গ্রেগ সেমেনযা।
(চিত্রঋণ: http://nobel.org/)
~কলমে এলেবেলে নির্মাল্য ~
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
“