~ কলমে এলেবেলে প্রত্যয় ~
সন ১৯২০। স্থান কলকাতা।
একটি ঘরের দৃশ্য। ঘরে বসে আছেন বছর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের এক ভদ্রলোক। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, ও একটি চাদর। গাল পরিষ্কার করে কামানো। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোক একটি টেবিল চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছেন। ঘরের যত্র-তত্র ছড়ানো-ছেটানো বই খাতা। দেখলেই বোঝা যায় ভদ্রলোকের যথেষ্ট পড়াশোনা আছে।
নেপথ্যে চিৎকার: মেজদা! ও মেজদা!
(ভদ্রলোক মুখ তুললেন।)
ভদ্রলোক: (দর্শকের উদ্দেশ্যে) ঐ! আবার জ্বালাতে এলেন।
(মঞ্চে প্রবেশ এক কিশোরের। এরও পরনে কাছা ছাড়া ধুতি, আর পাঞ্জাবি। শরীরটি বেশ রোগা-সোগা, কিন্তু মাথাটি প্রকাণ্ড। মাথার চুল সামান্য উষ্কখুষ্ক। এক হাতে একটি নোটবুক, আরেক হাতে পেন্সিল।)
কিশোর: মেজদা, তাড়াতাড়ি বল।
মেজদা: কি বলব?
কিশোর: (ছন্দ করে) কাল থেকে মনে মোর লেগে আছে খটকা, ঝোলাগুড় কিসে দেয়, সাবান না পটকা?
মেজদা: কি?! উঁহ, আবার কাব্যি হচ্ছে? ও বাড়ি বেশী যাচ্ছিস নাকি আজকাল? বেশী যাস না, রবিবাবুর শরীর খারাপ করবে।
কিশোর: আরে, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও না।
মেজদা: আর কেউ নেই? মার কাছে যা না। দাদা কোথায়? নয়তো বাঞ্ছারামের সাথে ফুটবল খেল। আমাকে জ্বালাস না, আমার অনেক কাজ আছে।
কিশোর: মা ঠাকুর ঘরে। বড়দা ঘুমচ্ছে। বাঞ্ছা কাল থেকে পা মচকে পড়ে আছে। আরে, আমার বেশীক্ষণ লাগবে না। তুমি উত্তর বলে দাও, আমি টুক করে আমার নোটবইতে লিখে নি।
মেজদা: নোটবই! বা বা! তুই তো উন্নতি করেছিস, গঙ্গা। দেখি কি আছে তোর নোটবইতে।
(কিশোর একটু ইতস্তত করল)
মেজদা: (ধমকের সুরে) দে বলছি! নয় তো পালা এখান থেকে।
(কিশোর এবার নোটবই হস্তান্তর করল, মেজদা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।)
মেজদা: অ্যাঁ! এই লিখেছিস নোটবইতে? ফড়িঙের কটা ঠ্যাং? আরশোলা কি কি খায়? ঝোলাগুড় কিসে দেয়, সাবান না পটকা? ফড়িঙের ঠ্যাং পাঁচটা লিখেছিস কেন?
কিশোর: গেলো হপ্তায় যে ধরলাম একটা ফড়িং, পাঁচটাই তো ঠ্যাং ছিল।
মেজদা: অ! শোন, আগামী দশদিন রোজ একটা করে ফড়িং ধরবি আর তার ঠ্যাং গুণে এই নোটবইতে লিখবি। তারপর গড় করে আমার কাছে নিয়ে আসবি। বুঝলি?
রোজ ফড়িং ধরে, ঠ্যাং গুণে, নোটবইতে লিখবো।
কিশোর: বুঝে গেছি। রোজ ফড়িং ধরে, ঠ্যাং গুণে, নোটবইতে লিখবো। কিন্তু, ফড়িঙকে প্রণাম করবো কেন? ফড়িং কি কোন দেবতা? আর, তোমার কাছে আনবো কেন? তোমার কি ফড়িং নিয়ে কোন এক্সপেরিমেন্ট আছে?
মেজদা: ওরে গড় মানে অ্যাভারেজ। তুই ঠ্যাং গোনা হয়ে গেলে, দশদিন পরে নোটবুকটা নিয়ে আসবি। তাহলেই হবে।
কিশোর: বেশ।
মেজদা: আর এগুলো কি করেছিস নোটবইতে? আরশোলার পাশে লেখা কাবুলিওয়ালা, ঝোলাগুড়ের পাশে মেজদা লেখা। এগুলোর কি মানে?
কিশোর: ওগুলো কিভাবে উত্তর জানবো তার নোট। যেমন ঝোলাগুড় সাবানে দেয়, না পটকায় দেয় সেটা তুমি বলবে।
মেজদা: আর, কাবুলিওয়ালা?!
কিশোর: একটা আরশোলা পুষেছি, নাম দিয়েছি কাবুলিওয়ালা। ওকে খাইয়ে খাইয়ে জেনে নেবো। তবে যদি তুমি জানো তো বলে দাও।
মেজদা: নাহ! ওটা তুই দেখ।
কিশোর: তবে বল, ঝোলাগুড় কিসে দেয়, সাবান না পটকা?
মেজদা: (চিন্তিতভাবে) ঝোলাগুড়? সাবানে কি দেয়? এসবের উত্তর প্রফুল্লবাবু দিতে পারেন। ওনার কারখানায় সাবান তৈরি হয় মনে হয়। তবে, সাবানে কি কাজে লাগবে?
কিশোর: তবে, পটকা?
মেজদা: পটকায় তবে দেওয়া যেতে পারে। তবে দেয় কিনা জানি না। দেওয়া যেতেই পারে।
কিশোর: কি রকম?
মেজদা: বলতো পটকার আসল জ্বালানি কি?
কিশোর: বারুদ।
মেজদা: হ্যাঁ, বারুদ। কিন্তু, বারুদ কি দিয়ে তৈরি হয়? জানিস না তো? পটাসিয়াম নাইট্রেট, সালফার আর চারকোল। আর চারকোলের থেকেই আসে কার্বনটা। অতএব ঝোলাগুড়েও কাজ চলবে।
পটাসিয়াম নাইট্রেট, সালফার আর চারকোল। আর চারকোলের থেকেই আসে কার্বনটা।
কিশোর: বুঝলাম না।
মেজদা: আরে বাবা, ঝোলাগুড়ে সুক্রোজ আছে। মানে কার্বন। চারকোলটা দেওয়াই তো হয় কার্বনের জন্যে। কার্বনটা খুব দরকার বাজি-পটকা বানাতে।
কিশোর: কেন?
মেজদা: কার্বনটাই তো আসল। পটাসিয়াম নাইট্রেটটা হচ্ছে জারক। আরও অনেক জারক হয়। এদের মূল কাজ হল অক্সিজেন তৈরি করা। সেই অক্সিজেনই কার্বনটাকে জ্বলতে সাহায্য করবে। সেখান থেকে তৈরি হবে বিপুল পরিমাণে কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস। পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে তোর পটকার ঐ ছোট কাগজের খোলকটার ভেতরে। ফলে, এতো গ্যাসের চাপে ঐ কাগজের খোলক ফট করে ফেটে যাচ্ছে।
কিশোর: তার মানে তো চিনিও দেওয়া যায়। চিনিতেও তো কার্বন থাকে?
মেজদা: হ্যাঁ, দেওয়া যায়। চিনদেশে প্রথম যখন বারুদ আবিষ্কার হয় তখন ওনারা মধু ব্যবহার করতেন।
কিশোর: আর তারাবাতি, তুবড়ি এগুলোতে?
মেজদা: ওয়ার্কিং প্রিন্সিপালটা একই। তবে যাতে যেমন দরকার সেই মতো অনুপাতগুলো অদল-বদল করা হয়। যেমন, তারাবাতিতে বেশী গ্যাস লাগে না, কিন্তু, তুবড়িতে ভাল পরিমাণ গ্যাস প্রয়োজন নয়তো ফুলকিগুলো অতো ওপরে উঠবে না। তবে বিক্রিয়াটা করার জান্যে যে পরিমান কার্বন প্রয়োজন, সেটা তো লাগবেই।
কিশোর: হাউই?
মেজদা: আরে বললাম তো, সবারই মোটামুটি একই। তুবড়িতে ওপরের দিক দিয়ে গ্যাস বেরোয়, হাউইতে নিচের দিক দিয়ে। চরকিতে পাশের দিক দিয়ে। তাই বলে তুই আবার তুবড়িকে উল্টো করে জ্বালিয়ে হাউই বানাস না। হাউইতে একটা ছোট ফুটো আগে থেকেই করা থাকে। আর অনেকগুলো আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ থাকে। একটার কাজ ওপরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। পুরো নিউটনের গতিসূত্র মেনে। ফুটো দিয়ে প্রবল বেগে গ্যাস বেরিয়ে আসে, আর সেই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় হাউই ওপরে ছুটে যায়। আবার আরেকটা প্রকোষ্ঠ আছে যেটা আকাশে গিয়ে ফেটে রঙিন আলো ছড়িয়ে দেয়। রঙিন আলো বলতে মনে পড়ল। দাঁড়া বইটা দেখি।
আবার আরেকটা প্রকোষ্ঠ আছে যেটা আকাশে গিয়ে ফেটে রঙিন আলো ছড়িয়ে দেয়।
কিশোর: বইতে রঙ্গিন আলো বানানোর ফরমুলা বলা আছে?
মেজদা: না, ওতে বলা আছে কোন কেমিক্যাল কোন রঙের আলোর শিখায় জ্বলে। (বই হাতড়ে) এই তো পেয়ে গেছি। বারুদে এই কেমিক্যালগুলো মেশালেই বিভিন্ন রঙের আলো পাওয়া যায়।
কিশোর: কিরকম?
মেজদা: ক্যালসিয়াম দিলে গেরুয়া, সোডিয়াম দিলে হলুদ, বেরিয়াম দিলে সবুজ, কপার দিলে নীল, ম্যাগনেসিয়াম বা অ্যালুমিনিয়াম দিলে সাদা।
কিশোর: কিন্তু কেন?
মেজদা: রাদারফোর্ড আর বোর সাহেবের মতে, প্রত্যেক অণুর বেশ কয়েকটা করে শক্তিস্তর থাকে। কার্বনটা জ্বললে যা তাপ উৎপন্ন হয়, তাতে এই ধাতুর অণুগুলোর কিছু ইলেকট্রন উচ্চ শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু সেখানে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না, নীচে নেমে আসে। এই নীচে নেমে আসার সময় ওরা যে শক্তি হারায় সেটাই এই বিভিন্নরকম রঙের আলো হয়ে বেরিয়ে আসে।
কিশোর: আর, তারাবাতিতে এই বারুদ, কেমিক্যাল সব একসাথে চিটে থাকে কি করে?
মেজদা: তার জন্যে দরকার হয় এক বিশেষ ধরনের আঠার, যাতে সহজে আগুন ধরানো যায়। নাম তো জানা নেই, কিন্তু খুঁজে দেখতে পারি।
কিশোর: দেখো তবে।
(মেজদা একগাদা বই হাতড়ে, একটা নিয়ে ফিরে এলেন)
মেজদা: হ্যাঁ, পেলাম। নাম ডেক্সট্রিন। এটা আঠাও, আবার নিজেও জ্বালানির মতো কাজ করে। বুঝেছিস এবার পালা। আমার কলেজের খাতা দেখা আছে।
কিশোর: আচ্ছা, বুঝলাম। আমার নোটবই দাও তবে। আমি সব লিখে নি।
মেজদা: এই নে। এবার যা। শোন, বিকেলে আমার জন্যে গাছ থেকে দুটো পেয়ারা পেড়ে দিস তো।
কিশোর: আমার সময় নেই। আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি আছে। মাকে ধরে জানতে হবে তেজপাতায় তেজ কেন? লঙ্কায় ঝাল কেন? (দ্রুতবেগে প্রস্থান)
মেজদা: (চিৎকার করে) আরে শুনে যা! লঙ্কায় ঝাল কেন আমি জানি। ওতে ক্যাপ্সাইসিন… (দর্শকের উদ্দেশ্যে) যাক গে। উঁহ, প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। জেনে যেন কতো উদ্ধার করবেন উনি। তিন-তিনবার তো ম্যাট্রিকে ফেল, তবু চেষ্টা চলেই যাচ্ছে। কে জানে কবে ঘায়েল হয়ে থামবেন?
(সমাপ্ত)
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
এলেবেলে – Elebele