~ কলমে এলেবেলে দেবযানী ~
শীতের ছুটিতে পপাইরা সবাই মিলে চলেছে পিকনিকে। জি.টি রোড ধরে চন্দননগরে যাচ্ছে ওরা। লকডাউনের এতদিন পরে বাড়ি থেকে বের হতে পেরে স্বভাবতই খুব খুশি ক্লাস ফাইভ এর পপাই। বাবা মার সাথে ওদের গাড়িতে পাপাইয়ের অসমবয়সী বন্ধু কলেজে পড়া অরণ্য দাদাও আছে। ডানলপ এর কাছে হঠাৎ ওদের গাড়িটা সিগনালে দাঁড়াল।
রাস্তার উল্টোদিকে তাকিয়ে পপাই বলল, “দেখো, লোকটা কত প্লাস্টিক এর বোতল জমা করেছে, এত প্লাস্টিক? রোজ আমরা এত প্লাস্টিক ব্যবহার করি?”
“পপাই তুই ভাবতেও পারবি না যে রোজ রোজ আমরা কত ময়লা উৎপন্ন করি। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ২.০১ বিলিয়ন টন পৌরসভার বর্জ্য উৎপন্ন হয়। অতিরিক্ত পরিমাণ নগরীকরণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক বিকাশের কারণেই বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়ে চলেছে। ভারতেই পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি পরিমাণে বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়। ২০১৬ সালে হওয়া একটি সার্ভে অনুযায়ী, ভারতে প্রতিদিন ২৭৭ মিলিয়ন টন পৌর কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, যা কিনা দক্ষিণ এশিয়ার মোট ৮০%। ভারতে এই বর্জ্য উৎপাদন তালিকার শীর্ষে রয়েছে আমাদের রাজধানী দিল্লি।”— একনাগাড়ে অরণ্য বলে চলল।
“কিন্তু না হয় আমাদের জনসংখ্যা বেশি বলে মোট জঞ্জাল এত উৎপন্ন হয়, কিন্তু জানিস তো যে দেশ যত উন্নত, মাথাপিছু, মানে এক এক জন মানুষ সবথেকে বেশি বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন করে।”
— “সেটা কেমন বাবা?”
— “আসলে আমরা বর্জ্য পদার্থ বলতে স্বাভাবিকভাবে বুঝি যেগুলো আমরা ফেলে দিই সেটুকুই, কিন্তু ব্যাপারটা শুধুমাত্র তাই নয়। যার জীবনযাত্রা যত বেশি জটিল সে কিন্তু ততবেশি বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন করে…”
যার জীবনযাত্রা যত বেশি জটিল সে কিন্তু ততবেশি বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন করে…
পপাই এর মা পাশ থেকে বলল “তার মানে বলতে চাইছো লাগজারি লাইফস্টাইল?”
— “ঠিক তাই। ধরো, তুমি চুলে শ্যাম্পু ব্যবহার করো, তেল, কন্ডিশনার, হেয়ার লোশন, কত রকম ক্রিম, আরও হাজার গণ্ডা প্রসাধনী লাগাও, আমি এই যে পারফিউম, নানা রকম ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করি, দামি গাড়ি চালাই, ল্যাপটপ ব্যবহার করি— এই যে এত কিছু তৈরি করতে কত কেমিকাল, প্লাস্টিক, পেপার প্রয়োজন হয়, কত ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য পদার্থ তার ফলে উৎপন্ন হয়, এই যে আমাদের অরণ্য দু’বছর পরপর মোবাইল চেঞ্জ করে তার ফলে যে ইলেকট্রনিক বর্জ্য, এগুলোকেও কিন্তু ধরতে হবে। কিন্তু যারা খুব সরল জীবনযাপন করে তাদের ক্ষেত্রে এতকিছু বর্জ্যই হবে না, তাই না?”
— “দেখলি অরণ্য, দেখলি? তোর কাকু কিন্তু ঠিক সুযোগ বুঝে আমার মেক আপ নিয়ে একটা খোঁটা দিয়েই দিল, হুনহ…”
— “যা বাবা… বোঝো! দেখ, আমি শুধু একটা উদাহরণ দিলাম, আর তোর কাকিমা সেটা গায়ে মেখে নিল!”
হাহা… প্রবল হাসতে হাসতে অরণ্য বলল…“তোমরা পারো বটে! তবে ঠিক বলেছ কাকু। সেইজন্যেই উত্তর আমেরিকা (বারমুডা, কানাডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র) প্রতিদিন জনপ্রতি ২.২ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করে যা মাথাপিছু উৎপাদনে বিশ্বের সর্বাধিক। কিন্তু একইভাবে সাব-সাহারান আফ্রিকা যারা খুবই গরীব দেশ এবং যাদের জীবনযাত্রা এখনো খুবই সাধারণ, তারা সারা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে কম বর্জ্য উৎপাদন করে, দিনপ্রতি ০.৪৫ কেজি। ভারতীয়রা কিন্তু মাথা পিছু উৎপাদনে নিচের দিকেই আছে। প্রতিদিন জনপ্রতি মাথাপিছু প্রায় পাঁচশ গ্রাম করে বর্জ্য উৎপন্ন করে, সারা বিশ্বের গড় অর্থাৎ ০.৭৪ গ্রামের থেকেও কম! কিন্তু জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই মাথাপিছু বর্জ্য পদার্থ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আর অনেক ক্ষেত্রেই এই ময়লাগুলো আলাদাভাবে ফেলা হয়না, যা সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়।”
এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল পপাই, এটা শুনতেই সে বলে উঠল, “আমি জানি! যেগুলো পচে যায়, যেমন রান্নাঘরের শাকসবজির খোসা, খাবারের টুকরো এগুলো আলাদা ফেলতে হয়, আর প্লাস্টিক, ধাতু, কাঁচ, পেপার যেগুলো আবার পরে ব্যবহার করা যাবে, সেগুলো আলাদা করে ফেলতে হয়… আমাদের এনভায়রনমেন্ট ক্লাসে বলেছে ম্যাম…”
— “একদম ঠিক রে পপাই, আরো একটা ব্যাপার হল যদি এই বর্জ্যপদার্থ ঠিকভাবে না ফেলা হয় তাহলে অনেক সময়েই আমাদের সেই বর্জ্যপদার্থ পুড়িয়ে ফেলতে হয়, যা কিনা ভয়ানক বায়ু দূষণ ঘটায়। প্রতিদিন গড়ে ভারতের শহরগুলিতে ২% থেকে ২৪% বর্জ্যপদার্থ শুধুমাত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যে সমস্ত জায়গায় যেমন গ্রামে বা ছোট শহরে সঠিকভাবে বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নেই, সেখানে তো মোট উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থের প্রায় নব্বই থেকে একশ শতাংশই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এইজন্য বায়ুতে ভেসে থাকা অতি সূক্ষ্ম কঠিন পদার্থ বা পি.এম ২.৫ তৈরি হয়। প্রায় ২৬ শতাংশ পি.এম ২.৫ তৈরির জন্য দায়ী এই অব্যবস্থা।”
— “পি.এম ২.৫? সেটা আবার কি বাবা?”
প্রতিদিন গড়ে ভারতের শহরগুলিতে ২% থেকে ২৪% বর্জ্যপদার্থ শুধুমাত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যে সমস্ত জায়গায় যেমন গ্রামে বা ছোট শহরে সঠিকভাবে বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নেই, সেখানে তো মোট উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থের প্রায় নব্বই থেকে একশ শতাংশই পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
— “পার্টিকুলেট ম্যাটার। এগুলো আসলে বাতাসে ভেসে থাকা ছোট্ট ছোট্ট কঠিন পদার্থ যাদের আকার ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার থেকেও কম। মাইক্রোমিটার তোকে বোঝাই কি করে? উম্ম… এই ধর আমাদের মাথার চুলের ব্যাস ৭০ মাইক্রোমিটার। তার মানে তিরিশটা এরকম পি.এম ২.৫ মিলে এক একটা চুলের মত মোটা হবে। এতই ছোট, কিন্তু সাংঘাতিক ক্ষতিকর। এরা আমাদের ফুসফুসে, রক্তে চলে যেতে পারে, আরও অনেক রকম রোগ, সমস্যা সৃষ্টি করে।”
পপাইয়ের মা বলল “এই দিল্লির বাতাস এত খারাপ বলে, এজন্যই তো বলো? কালকেই স্বাগতাদি বলছিল, ওর ছেলের নাকি এই বারো বছর বয়স থেকেই শ্বাস কষ্ট..”
“অস্বাভাবিক না কাকিমা, উইকিপিডিয়ায় বলছে দিল্লির মোট বাচ্চার অর্ধেকেরই এরকম ফুসফুসের সমস্যা হচ্ছে। শীতকালে মানে, সেপ্টেম্বরের পর থেকে ওখানে বাতাসে দূষণ আরো বাড়তে থাকে। তবে জানো তো, এখন এই নোংরা থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করার একটা চেষ্টা চলছে। ভারতের এই বিপুল জঞ্জালগুলোকে কিছুও যদি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায় তাহলে তো ভালোই। প্রতিদিন ১০০ টন বর্জ্য থেকে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পারে। ভারতে এরকম ৯২ টা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্লান্ট আছে, যা থেকে সবমিলিয়ে ২৫০ MW বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পারে, যেটা খুবই আশার কথা!”
— “ওও মা… এত গল্প শুনতে শুনতে খিদে পেয়ে গেল তো আমার! চিপসের প্যাকেটটা দাও না প্লিজ…” পপাই বলল।
— “শোন, প্যাকেটটা যখন কাটবি, সাইডের তিনকোনা ছোট টুকরোটা যাতে পুরোপরিভাবে না পড়ে যায়, সেরকম করে কাটবি। প্যাকেট এর সাথেই লেগে থাকে যেন,”
এবার হা হা করে হেসে উঠল অরণ্য! “কাকিমা, আমি কিন্তু ধরে ফেলেছি তুমি কেন এটা বলছ…”
“শোন, প্যাকেটটা যখন কাটবি, সাইডের তিনকোনা ছোট টুকরোটা যাতে পুরোপরিভাবে না পড়ে যায়, সেরকম করে কাটবি। প্যাকেট এর সাথেই লেগে থাকে যেন,”
পপাইয়ের বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল “সে কি! এসব খবর আমার কাছে থাকছে না? কেন এরকম বললে? বল বল?”
— “বছর খানেক আগে কর্ণাটকে এই নিয়ে একটা বেশ বড় একটা খবর হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, এই দুধের প্যাকেট কাটতে গিয়ে আমরা ছোট্ট মতো তিনকোনা টুকরোটা যদি পুরোপরিভাবে না কেটে রেখে দিই, তাহলে শুধুমাত্র ব্যাঙ্গালোর থেকেই এরকম ৫০ লাখ ছোট ছোট প্লাস্টিকের টুকরো উৎপন্ন হওয়া থেকে বাঁচানো যাবে। কেননা সাধারণভাবে ময়লা থেকে ওই দুধের পাউচের প্যাকেটটা সংগ্রহ করা গেলেও, ছোট তিন কোনা অংশগুলো আর সংগ্রহ করা যায় না; তার ফলে এগুলো মাটির সাথে মিশে যায়। ক্ষতি করে গাছপালার, মাটিতে থাকা জীবজন্তুর। আর আমরা তো জানিই প্লাস্টিক ভেঙে মাটির সাথে মিশতে কতটা সময় লাগে… সাড়ে চারশো বছর!”
— “বাহ দারুণ তো! ছোট ছোট ব্যাপারগুলোর সাথেই কত বড় বড় জিনিস জড়িয়ে থাকে তাই না?” বলল পপাইয়ের বাবা।
— “আরও একটা সমস্যার ব্যাপার হল, ওই ইংলিশে যাকে বলে ইলেকট্রনিক বর্জ্য, ই-ওয়েস্ট। না পারা যায় ফেলতে, না পারা যায় গিলতে! বড় সমস্যা। যত দিন যাচ্ছে পুরনো ভাঙাচোরা ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওভেন, হাজার খানিক মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি জড়ো হচ্ছে… আর এগুলো তো আর সাধারণভাবে ফেলা যায় না। অনেক ক্ষতিকারক কেমিকাল, যেমন পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম জাতীয় ক্ষতিকারক পদার্থ থাকতে পারে। উন্নয়নশীল দেশের ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িত শ্রমিক সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি অনেক বেশি। এসমস্ত বর্জ্য পুনঃচক্রায়ন (Recycling) প্রক্রিয়াতে শ্রমিকেরা ভারী ধাতুর সংস্পর্শে যেন না আসে, সে ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান হওয়া উচিত। আর কিছু কিছু পদার্থ যেমন এখানে থাকা লোহা, তামা, সোনা, রূপো, অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করাই যায়। কিন্তু এখনো অব্দি সারা বিশ্বে যা ই-ওয়েস্ট উৎপন্ন হয়, তার কেবলমাত্র কুড়ি শতাংশ পুনর্নবীকরণ করা হয়। কি অবস্থা না অরণ্য?”
“তবে অনেক সংস্থা এসব নাকি সংগ্রহ করছে। আবার যারা এই ল্যাপটপ, মোবাইল তৈরি করে তাদেরকেই এই জাতীয় পুরনো জিনিস নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। কিছু একটা উপায় তো বের করতেই হবে।”
“মাঝে মাঝে ভাবি.. এরকম চলতে থাকলে সত্যিই আমাদের অবস্থাটা সেই ওয়াল-ই সিনেমার মতো হয়ে যাবে! যেখানে দেখিয়েছিল সমস্ত পৃথিবী পুরো ময়লায়, জঞ্জালে ভরে গেছে, তাই পৃথিবীর সব মানুষ থাকছে অন্য একটা গ্রহে!”
— “তাহলে তো খুব মজা হবে! আমরা অন্য গ্রহে থাকবো?” পপাই বলে উঠল।
— “দূর বোকা। ওগুলো কল্পবিজ্ঞান। এখনো পর্যন্ত এই পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ, যেখানে আমরা থাকতে পারি, বাঁচতে পারি। সেটাকে বাঁচাতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, আমাদের একেবারে নিজের ভেবে থাকতে হবে। যেমন আমরা নিজের ঘর গুছিয়ে রাখি, তুই যেমন যত্ন করে তোর গোকু, পোকেমন কার্ডগুলো গুছিয়ে রাখিস, ঠিক অতটা যত্নেই। বুঝলি? আর শোন.. যারা এই নোংরা নিয়ে যায়, তারপরে ভাগাড়-ভ্যাট থেকে প্লাস্টিক, পেপারগুলোকে আলাদা করে তাদের কখনো ঘৃণা করবি না। ওরা কত বড় উপকার করছে পরিবেশের, সেটা নিজেরাও জানেনা।”
— “একদম করব না, একদম করব না মা” বলে মাকে পাশ থেকে মাকে জড়িয়ে ধরল পপাই।
ওর বাবা হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠল “এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…”। গাড়ি ছুটে চলল চন্দননগরের দিকে …