~ কলমে এলেবেলে চিরশ্রী ~
আজ আমাদের গল্প আপামর বাঙালির এক ‘মামা’কে নিয়ে – ছোটবেলার সেই সূয্যি মামা। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই স্থাপত্য, পুরাণ, চারুকলাই হোক, কিম্বা দার্শনিক-জ্যোতির্বিদদের মূল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, সর্বত্রই তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তবে তার এই ঔজ্জ্বল্যের রহস্যটা আসলে কি ? সেটা জানতে হলে আমাদের একবার ঢুঁ মারতে হবে সূয্যি মামার হেঁসেলে। কিন্তু ১৫১.৩৫ মিলিয়ন কিলোমিটার (১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ) দূরে বসে আমরা সেখানে কি করে নাক গলাবো?
সেটা জানার আগে আমাদেরকে আলোর গোপন ভাষাগুলো একটু জেনে নিতে হবে, কারণ আলোই হচ্ছে সূর্যের খবর পৃথিবীতে বয়ে আনা প্রথম গুপ্তচর। আমরা তো জানিই যে সাদা আলোকে ভাঙলে আমরা একটা বর্ণালী পাই , যা আসলে বিভিন্ন রঙের সমষ্টি। বিজ্ঞানের ভাষায় আবার এই রঙগুলোকে প্রকাশ করা হয় এক একটা তরঙ্গদৈর্ঘ্য দিয়ে। যেমন ৬২৫-৭৪০ ন্যানোমিটারের (১ ন্যানোমিটার=১/১০০০০০০০০০ মিটার) আলোর রঙ লাল। আমাদের চারপাশে যে মৌলগুলো আছে, তারা আবার নিজেদের চরিত্র অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে পরিস্থিতি বিশেষে শোষণ করতে পারে। উল্টো ভাবে বললে, আমরা যদি এই শোষিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দেখতে পাই তাহলেই আমরা বলে দিতে পারবো কোন কোন মৌল এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো খেয়ে ফেলেছে। একটু সহজ করে বোঝা যাক। ধরা যাক অফিসের ‘ক’-বাবু সন্দেশ খেতে ভালোবাসেন, ‘খ’-দিদি রসগোল্লা আর ‘গ’-দাদা ভালোবাসেন জিলিপি। এখন যদি টিফিনে আনা এক ঠোঙা জিলিপি, এক ভাঁড় রসগোল্লা আর এক প্যাকেট সন্দেশের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকটা জিলিপিকে বেমালুম হাপিশ হয়ে যেতে দেখি, সহজেই আমরা বুঝতে পেরে যাবো যে এটা ‘গ’ – দাদারই কম্মো। ঠিক তেমন ভাবেই, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসা আলোক বর্ণালীকে যদি আমরা পরীক্ষা করি, দেখতে পাবো যে বর্ণালীর কিছু কিছু জায়গা অন্য জায়গাগুলোর থেকে কম উজ্জ্বল বা অন্ধকার, দেখতে অনেকটা উজ্জ্বল পশ্চাৎপটের ওপর কালো কালো দাগের মতো । তার মানে, ওই জায়গায় থাকা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোগুলো সূর্য থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে আসার আগেই ‘ক’,’খ’ বা ‘গ’-এর মতো কোনো পেটুক মৌল তাকে শোষণ করে ফেলেছে। এই ধরণের বর্ণালীকে আমরা বলি “শোষণ বর্নালী” এবং এই কালো রেখাগুলো হল শোষণ রেখা, যা দেখে সূর্যে কোন কোন মৌল উপস্থিত তা খুব সহজেই অনুমান করা সম্ভব। কিন্তু আজ যেটাকে ‘খুব সহজ’ বলতে পারছি, এক-দেড়শো বছর আগেও এই সম্মন্ধে স্পষ্ট কোনো ধারণাই ছিল না।
তখন ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিক। আমরা গ্যালিলিও, নিউটন, কেপলার এবং বহু খ্যাতনামা পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞের হাত ধরে ততদিনে সূর্যের ভর, আয়তন প্রভৃতি বেশ কিছু হিসেব কষে ফেলেছি। কিন্তু তখনো আমরা শুধুমাত্র সূর্যের বাইরের চেহারাই দেখতে পেয়েছি, আর দেখেছি সূর্যের মুখের দাগছোপ যা সৌর কলঙ্ক নামে পরিচিত। ঊনবিংশ শতকে ফ্র্যানোফার নামে এক জার্মান বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম সূর্যের শোষণ বর্ণালীতে ৬০০ -র কাছাকাছি শোষণ রেখা খুঁজে পেলেন। এর প্রায় ৪৫ বছর পরে আমরা জানতে পারলাম মৌলের চরিত্রগত বৈশিষ্টের সঙ্গে এই শোষণ রেখার কি সম্পর্ক। এই সব রেখার পর্যবেক্ষণে সূর্যের একদম বাইরের স্তর আলোকমণ্ডল ও তার ঠিক নিচে অবস্থিত স্তর বর্ণমণ্ডলে খুঁজে পাওয়া গেল কার্বন, সোডিয়াম, সিলিকন ও আয়রনের মতো মৌলগুলিকে। ঊনবিংশ শতকের একদম শেষের দিকে এরকমই এক শোষণ বর্ণালীতে আমরা প্রথম খোঁজ পেলাম হিলিয়াম মৌলের। শোষণ বর্ণালীতে পাওয়া কালো রেখাগুলোর তীব্রতার সঙ্গে মৌলগুলির পরিমান, তাপমাত্রা ও চাপের সম্পর্ক আমরা প্রথম জানতে পারবো ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহা প্রদত্ত সাহা আয়নন সমীকরণ থেকে।
কিন্তু এই আগুনপানা সূর্যের ঔজ্জ্বল্যের রহস্য কি ? কিই বা তার পেটের ভেতরের কর্মকান্ড? বিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর দিকেই আলবার্ট আইনস্টাইন বস্তুর ভর ও শক্তির তুল্যতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করালেন। আমরা জানতে পারলাম, খুব ছোট ভরকেও শক্তিতে রূপান্তরিত করলে কি ভীষণ পরিমান তেজ আমরা পেতে পারি। ১৯২০ সাল তখন, স্যার আর্থার এডিংটন প্রথম বললেন, এই শক্তি আসলে সূর্যের কেন্দ্রে চলতে থাকা নিউক্লিও সংযোজন বিক্রিয়ার ফল। একটু খোলসা করে বলা যাক। আমরা জানি, হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটি মাত্র প্রোটন কণা। অন্যদিকে হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে থাকে দু’টি প্রোটন ও দু’টি নিউট্রন কণা। চারটে হাইড্রোজেন নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়া করে একটা হিলিয়াম তৈরী করতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, দাঁড়িপাল্লায় চারটে হাইড্রোজেনের মোট ওজন, একটা হিলিয়ামের থেকে সামান্য বেশী। তাহলে চারটে হাইড্রোজেন থেকে একটা হিলিয়াম তৈরী হবার পরেও একটা ছোট্ট ভরের ঘাটতি থেকে যাবে। এই ছোট্ট ভরটুকুই আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সূত্রে ফেললে আমরা হদিশ পেয়ে যাব একটা বিরাট পরিমানের শক্তির, যার মধ্যেই নিহীত আছে সূর্যের তাপ ও ঔজ্জ্বল্যের রহস্য। সূর্যের কেন্দ্রে থাকা রান্নাঘরে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেনের জ্বালানি থেকে তৈরী হয় ৫৯৬ মিলিয়ন টন হিলিয়াম, আর অবশিষ্ট ৪ মিলিয়ন টন ভরই যোগান দেয় এই বিপুল পরিমান শক্তির।
কিন্তু এত বিরাট একটা শক্তিপুঞ্জ সূর্যের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে আসবে কি করে? এমনিতে কোনো শক্তি মূলতঃ তিন ভাবে পরিবাহিত হতে পারে – পরিচলন, পরিবহন ও বিকিরণ। পরিচলন পদ্ধতিতে উত্তপ্ত অণুগুলো নিজেরাই শক্তিকে বগলদাবা করে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় (জলকে গরম করলে টগবগ করে ফোটে এই পরিচলনের জন্যই)। অন্যদিকে পরিবহন অনেকটা হাতে হাতে পাশের প্রতিবেশী অণুকে তাপ স্থানান্তর করার মত ব্যাপার (গরম পাত্রকে স্পর্শ করলে ছেঁকা লাগে এই পরিবহন প্রবাহের জন্য)। বিকিরণ পদ্ধতিতে তাপ আশেপাশের মাধ্যমকে কোনোরকম পাত্তা না দিয়েই তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় (সূর্যের থেকে এই পদ্ধতিতেই আলো পৃথিবীতে আসে)। সূর্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, বিকিরণ ও পরিচলন স্রোতই তাপ প্রবাহের মূল কান্ডারী। কিন্তু দুর্গাপুজোর ভীড়ে যেমন দু’পা হাঁটতেই দু’ঘন্টা লেগে যায়, সূর্যের ভেতরের চাপ আর উপাদানগুলোর ঘনত্বের গাদাগাদিতে আলোরও তেমনি নাস্তানাবুদ অবস্থা হয়ে যায়। সূর্য থেকে পৃথিবীর ১৫১.৩৫ মিলিয়ন কিলোমিটারের দূরত্ব আসতে যেখানে আলোর সময় লাগে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড, সেই আলোই সূর্যের কেন্দ্র থেকে মাত্র ০.৭ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে সূর্যের বাইরে আসতে সময় নেয় ১০,০০০ – ১,৭০,০০০ বছর। এ প্রসঙ্গে বলি, এমনিতে আমরা যে আলো চোখে দেখতে পাই, তা আসলে একরকম তড়িৎ -চৌম্বকীয় তরঙ্গ বা বিকিরণ। তবে সব রকম তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ কিন্তু আমরা চোখে দেখতে পাই না। গামা রশ্মি, এক্স রশ্মি, অতি-বেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ, বেতার তরঙ্গও এক এক রকমের তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ। মূলতঃ এদের শক্তির পরিমানই এদের গোত্র নির্ধারণ করে। সূর্যের কেন্দ্রে জন্মানো আলোকমণ্ডলের দিকে ধেয়ে আসা ‘আলো’গুলোও সাধারণ আলোর পর্যায়ে পরে না, এরা আসলে উচ্চ শক্তি বিশিষ্ট গামা রশ্মি। বাইরে আসার পথে ধাক্কাধাক্কিতে শক্তিক্ষয় হতে হতে শেষ পর্যন্ত এই তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি চলে আসে (শক্তি কমলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ে)। সেই কারণেই সূর্যের উপরিতল থেকে যে ‘আলো’কে আমরা পৃথিবীতে আসতে দেখি, তার মধ্যে দৃশ্যমান আলো, ও তার কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট অতি-বেগুনি রশ্মি ও সামান্য পরিমানে অবলোহিত রশ্মির অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
সূর্যের উপরিতল পৃথিবীর বহিরাবরণের মত কঠিন নয়, তবুও আমরা পরীক্ষালব্ধ ছবির মাধ্যমে আলোকমণ্ডলের ভেতরে থাকা স্তরগুলোর গঠন দেখতে পাই না। আলোকমণ্ডলের এই অভেদ্যতার জন্যই একে আমরা সূর্যের পৃষ্ঠতল হিসেবে ভাবতেই পারি। এদিকে শোষণ বর্ণালীও শুধু ওপরের দিকে থাকা আলোকমণ্ডল ও বর্ণমণ্ডলে উপস্থিত মৌলগুলোরই খোঁজ দেয়। তাহলে সূর্যের কেন্দ্রের যে প্রকান্ড নিউক্লিও সংযোজন যজ্ঞ চলছে, তা হাতেনাতে প্রমান করার কি কোনো উপায় নেই?
ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম, রান্নাঘরে কি রান্না হচ্ছে আমরা জানি, কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় ঠিকঠাক দেখে উঠতে পারছি না। সেটা জানার একটাই উপায়- গুপ্তচর। সূর্যের রান্নাঘরের খবর সবার চোখ এড়িয়ে কে পৌঁছে দিতে পারবে আমাদের কাছে? কেই বা সূর্যের প্রকৃত মেজাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে পারবে? এখানে দু’জন খাস গুপ্তচরের সঙ্গে আমাদের আলাপ করতে হবে। একজনের নাম নিউট্রিনো কণা, অন্যজন সৌরকম্প তরঙ্গ (অনেকটা ভূমিকম্পের মত)। সূর্যের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামের জন্মের সময় প্রচন্ড শক্তির সাথে সাথে সঙ্গী হিসেবে জন্ম হয় নিউট্রিনো নামক এক কণার। এই কণাটি আলোর মতো সূর্যের ভেতরে বাধাপ্রাপ্ত হয় না ও খুব সহজেই আলোকমণ্ডলের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। যেহেতু ইতিমধ্যেই আমরা এই কণার জন্মরহস্য ভেদ করতে পেরেছি, তাই কোনো পরীক্ষায় যদি সূর্য থেকে এই কণার আগমন হাতে নাতে ধরতে পারি, তাহলে তো ঘুরিয়ে বলতেই পারবো – নিশ্চয়ই নিউট্রিনোর জন্মের কারণটা সূর্যের গর্ভেই বিদ্যমান। এই নিউট্রিনোই আমাদের বলে দিতে পারবে সূর্যের আভ্যন্তরীণ উষ্ণতা ও কার্যকলাপের হাল হকিকত। ১৯৬০ সালে হোমস্টেকের সোনার খনিতে রেমন্ড ডেভিসের নেতৃত্বে প্রথমবার এই ‘সৌর গুপ্তচর’ নিউট্রিনো সনাক্তকরণের পরীক্ষা করা হয় জন বাকলের গণনার ভিত্তিতে। (সূর্যে নিউট্রিনোর উপস্থিতির পাশাপাশি এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত ব্যতিক্রমী ফলাফল ভবিষ্যতে আমাদের সামনে নিউট্রিনো গবেষণার নতুন পথ খুলে দেবে। তবে সে আর এক গল্প !)
অন্যদিকে, পৃথিবীতে যেমন আমরা ভূমিকম্প বা সুনামি দেখতে পাই, একই ভাবে সূর্যের উপরিতলও সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উথাল পাথাল করে আর তার সাথে দেখা যায় প্রবল কম্পনের তান্ডব। এটা আসলে ‘গুপ্তচর’ সৌরকম্প তরঙ্গের উপস্থিতির প্রমাণ। সূর্যের আভ্যন্তরীন ঘনত্ব, শব্দের বেগ, উপাদান ও সূর্যের ঘূর্ণন সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই এই কম্পনঘটিত তরঙ্গের মাধ্যমে। এই ঘটনার তত্ত্বকে বলে সৌরকম্পতত্ত্ব (হেলিওসিসমোলোজি)।
তাহলে কি দাঁড়ালো? আজকের আড্ডায় ‘গুপ্তচর’ আলো, নিউট্রিনো ও সৌরকম্প তরঙ্গের সঙ্গে আলাপ তো হল, উপরন্তু আমরা জানলাম নিউক্লিও সংযোজন বিক্রিয়ার খুঁটিনাটি। জানলাম পেল্লায় শক্তির উৎস কথা। শোষণ বর্ণালী জানালো সূর্যের উপরিতলের উপাদানগুলোর হাল হকিকত। কিন্তু আমাদের গল্প এখনো শেষ হয়নি। পরের আড্ডায় আমরা আলাপ করব আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার দুই স্তম্ভ মেঘনাদ সাহা ও সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখরের সঙ্গে। আলাপচারিতায় থাকবে আমাদের প্রিয় সূয্যি মামাও, ‘তারা’দের প্রতিনিধি হয়ে।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।