কলমে এলেবেলে প্রত্যয়
ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সে নিজের অন্ধকার অফিস ঘরে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক বছর ত্রিশের যুবক। শরীরে একটা দুর্বলতার ছাপ। কয়েকদিন আগেই কঠিন ব্যামো থেকে কোনোরকমে বেঁচেছেন। তাই শরীরের এই হাল। চারিদিকে অজস্র বই, খাতা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কাগজ। টিমটিম করে জ্বলছে একটা প্রদীপ। এর সাথেই ঘরে ডাঁই করা আছে একগাদা মানচিত্র। এই যুবকের কাজ হল মানচিত্র আঁকা। অ্যাকাডেমির নির্দেশ। সেটাই করছিলেন তিনি। কিন্তু চোখ আটকে গেছে একটা পুরনো মানচিত্রে। বিরাট কোন দেশের মানচিত্র না। প্রতিবেশী দেশ প্রাশিয়ার একটা শহরের, নাম কোনিংসবার্গ। ওনার মনে পড়ে গেলো কয়েক দিন আগে পাওয়া একটা চিঠির কথা। কোনিংসবার্গের লোকেরা যে মজার খেলাটা খেলত, তার কথা ছিল সেখানে। তখন ব্যাপারটা আমল দেননি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খেলাটা বেশ আকর্ষক। খেলা বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না। ধাঁধা বলা চলে। যুবক স্থির দৃষ্টিতে মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে। ডান চোখটায় কি একটু আবছা দেখছেন? নাহ্, মনের ভুল। আচমকা, হাতড়াতে লাগলেন বই খাতার তাড়া। বের করে আনলেন লাইবনিৎসের লেখা ‘ইউক্লিডিস প্রটা।’ ঠিক জায়গাটা খুঁজে নিয়ে পড়লেন মন দিয়ে। একবার নয়। বেশ কয়েকবার। নিজের মনে হয়তো বললেন “”এই জন্যেই এই লোকটাকে গুরু মানি।” দিয়ে মানচিত্র সরিয়ে সাদা কাগজ টেনে নিয়ে শুরু করলেন ছবি আঁকা। না, আর মানচিত্র না। এবার অঙ্ক। উনি নিজেও তো গণিতের অধ্যাপক।
ধাঁধাটা কি, সেটা খুলে বলবো। আপনাদের সাথে নিয়ে তার সমাধানও করবো। তবে তার আগে এই যুবককে চিনে নিই। যে সময়ের কথা বলছি, সেটা অষ্টাদশ শতকের ত্রিশের দশকের কথা। আর যে যুবককে দেখলেন, ওনার নাম লিওনারদ অয়লার। জাতে সুইস। বাড়ি সুইৎজারল্যান্ডের বাসেলে। সেখানকার বিখ্যাত বারনোলি পরিবারের কম বয়স্ক সদস্যরা সব বন্ধুস্থানীয় (এঁদের কথা পূর্বে ‘কলনবিদ্যার কলহ’তে বলেছি)। দিকপাল গণিতজ্ঞ জোহান বারনোলির নিজের হাতে তৈরি ছাত্র (এই জোহান বারনোলি আবার লাইবনিৎসের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন)। কিন্তু, বাসেল ইউনিভার্সিটি অয়লারকে চাকরি দিল না। তাই চলে আসতে হল রাশিয়ার সেন্ট পিটারসবার্গে। ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সে গণিতজ্ঞের চাকরি পেলেন। রাশিয়ান শিখলেন। শুরু করলেন গবেষণা। অ্যাকাডেমি গবেষণার দিক দিয়ে ছিল যথেষ্ট উদার। নিজের মতো ভাবনাচিন্তা করাতে কোন হস্তক্ষেপ ছিল না। ওই শুধু মাঝে মাঝে মানচিত্র এঁকে দিতে হতো। কে জানতো এই যুবকই একদিন আধুনিক গণিত জগতে অভাবনীয় কীর্তি রাখবেন। গণিতের ‘সব থেকে সুন্দর সমীকরণ’ লিখবেন। পদার্থবিদ্যাতেও কীর্তি রাখবেন। নিউটনের আলোক কণার তত্ত্বকে অস্বীকার করবেন। তরল প্রবাহকে গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে লিখবেন। শুধু তাই নয়, যুক্তিবিদ্যা নিয়েও কাজ করবেন। গণিত ও সঙ্গীতকে এক জায়গায় এনে ফেলবেন। ওনার জীবনে একটা সময় গেছে যখন উনি গড়ে সপ্তাহে একটি করে কাজ বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। ওনার কাজ ওনার উত্তরসূরিদের এমন প্রভাবিত করেছিল যে, আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ লাপ্লাস নাকি বলেছিলেন “”অয়লার পড়ুন। উনি আমাদের সবার গুরু।”” সেসব গল্প ধীরে সুস্থে অন্য কোনদিন করবো। আজকের বিষয় যে ধাঁধা, সেটা খুব গুরুত্বপুর্ন। কারণ, এখান থেকে গনিত জগতের একটা নয়, দুটো সম্পূর্ণ নতুন ধারার সৃষ্টি হবে। যাক, আর কথা না বাড়িয়ে ধাঁধাটা বলি।
অয়লার পড়ুন। উনি আমাদের সবার গুরু।
অয়লারের মতো অস্পষ্ট, হাতে আঁকা মানচিত্র আপনাকে দেবো না। আপনার জন্যে রইল কোনিংসবার্গের ঝকঝকে পরিষ্কার একটা মানচিত্র। চিত্র ১-এ। ধাঁধার বিষয় নদীর ওপর থাকা সাতটি সেতু (একটা নিচের ডানদিকের কোনায় আছে, খেয়াল করবেন) । ধাঁধার শর্ত: আপনি যেকোনো জায়গা থেকে হাঁটা শুরু করতে পারেন। যেকোনো পথে যেতে পারেন। যে কোন জায়গায় হাঁটা শেষ করতে পারেন। কিন্তু এই পথে, আপনাকে সাতটি সেতুর সবকটিই পেরতে হবে, এবং কোন সেতু দুবার ব্যবহার করা যাবে না। কোনিংসবার্গের কেউ পারেনি সেই পথ খুঁজে পেতে। যদি চান চেষ্টা করে দেখুন। তাহলে আর এগোবেন না। এর পরেই আমি কিন্তু উত্তর বলা শুরু করবো।
আমরা একদম অয়লারের পথেই এগবো। তার জন্যে সব গণিতবিদ আর পদার্থবিদ যা করেন আমরাও তাই করবো। সবার আগে সমস্যাটাকে সোজা করা দরকার। সেইটার সামাধান করব। তারপর ধাপে ধাপে কঠিন করে, শেষে আসল সমস্যাটাকে পাকড়াও করব। তো, সবার আগে অয়লার যা করলেন, তা হল উনি নদীর গতিপথ পাল্টে দিলেন। না, বাস্তবে নয়, অঙ্কের খাতায়। এবার নদী মোটামুটি সোজা চলে যাচ্ছে। তার ওপর কয়েকটা সেতু। অনেকটা চিত্র ২ এর মতো। ভূখণ্ড আর সেতুগুলিকে আমরা নাম দিয়ে দিলাম নিজেদের সুবিধের জন্যে। ভূখণ্ড দুটি A, আর B। সেতুগুলি a, b, c, আর d। সেই সাথে এটাও ধরে নিলাম যে আমরা যাত্রা সবসময় Aএর যেকোন একটি বিন্দুতে শুরু করব। প্রথমে ধরে নিচ্ছি সেতু বলতে আছে শুধু a, বাকিগুলো পরে দেখা যাবে। এবার ধাঁধার শর্ত অনুযায়ী আমদের a সেতু পেরতে হবে, শুধু একবার। অতএব, হিসেব পরিষ্কার A ভূখণ্ড থেকে শুরু করে a সেতু পেরিয়ে আমরা এলাম B ভূখণ্ডে। এবার ধরছি আমাদের কাছে দুটো সেতু আছে a, আর b। তাহলে যদি দুটি সেতুই পেরতে হয় তবে রাস্তা দুটি: ১) A থেকে a হয়ে B, তারপর, B থেকে b হয়ে A, ২) A থেকে b হয়ে B, তারপর, B থেকে a হয়ে A। এই চার লাইন অঙ্ক কষেই অয়লার করলেন প্রথম চালাকিটা। উনি বুঝলেন কোন সেতু আগে পার হচ্ছি সেটা অপ্রাসঙ্গিক। মোদ্দা কথা হল যদি একটা সেতু থাকে তো A থেকে B তে যাবো। উনি এটা লিখলেন AB। দুটো সেতু হলে A থেকে B তে যাবো, এবং তারপর B থেকে A তে ফিরব। ওনার চিহ্নে হল ABA। তিনটে হলে? ঐ একই ABAB। এই যে পথ ABAB, এতে A দুবার। এভাবেই ৫টা, ৭টা, ইত্যাদি অযুগ্ম সংখ্যক সেতু নিয়ে যদি পথ আঁকা হয়, তো আপনি দেখতে পাবেন যে, সেই পথে A আছে, সেতুর সংখ্যার সাথে এক যোগ করলে যা হয় তার আর্ধেক। ৩ টে সেতু হলে ২, ৫ টা হলে ৩, ৭ টা হলে ৪, এভাবে। আচ্ছা যদি A থেকে চলা শুরু না করে B থেকে করি? তাতেও এই নিয়মের পার্থক্য কিছুই হবে না। ABAB না হয়ে, BABA হবে। কিন্তু কতবার A আসবে সেই সংখ্যাটা একই থাকবে। আর একটা খুব কাজের কথা, যেটা একটু পরে লাগবে, সেটা হল পথে মোট অক্ষরের সংখ্যা সেতুর থেকে ঠিক এক বেশী। যেমন তিনটে সেতু হলে পথে মোট অক্ষরের সংখ্যা ৪, দুটো A, দুটো B।
এবার আরেক ধাপ এগোনো যাক। এবার চিত্র ৩ এর মতো তিনটে ভূখণ্ড। A, B, আর C। A থেকে মোট তিনতে সেতু বেরিয়েছে। দুটো গেছে C তে, একটা B তে। খেলার নিয়ম একই। শুরু করব A থেকে। একটা সম্ভাব্য পথ হল এরকম: A থেকে C, সেখান থেকে B, B থেকে ডানদিকের নিচের সেতু ধরে A। তারপর A থেকে আবার C। যাত্রা শেষ। অয়লারের ভাষায় পথটা কি দাঁড়াল তবে? ACBAC। A কতবার এলো গুণে দেখলেন? ২ বার। A থেকে সেতু বেরিয়েছে তিনটে। তাই আগের বারের হিসেবের মতো এবারেও ২। মানে মূল কথা হচ্ছে, A থেকে কটা সেতু বের হল সেটাই কথা, সেটা কটা ভূখণ্ডের সাথে কিভাবে যুক্ত সেটা কথা নয়। আগের বারের মতো এবারেও আপনি A তে শুরু না করে অন্য যেকোনো জায়গায় শুরু করতেই পারেন, বা অন্য যেকোনো পছন্দসই পথ নিতে পারেন। যাই করুন A পাবেন সাকুল্যে দুবার।
গনিতের ভাষায় এধরনের প্রমাণ কে বলা হয় দ্বন্দ্ব দ্বারা প্রমাণ।
এতক্ষণ ধরে এতো কথা বলার যেটি মূল উদ্দেশ্য, সেটি হল আসল ধাঁধার উত্তর বের করা। এবার তার পালা। ঐ একই মানচিত্র নিয়ে এসে এবার ভূখণ্ডগুলোর নাম দিয়ে দিলাম। মোট সাতটা সেতু আছে। অতএব, যে পথই খুঁজে পাইনা কেন তাতে মোট ৮ টা অক্ষর থাকবে। এবার আলাদা আলাদা করে দেখে নিই কোন অক্ষর কটা থাকবে। কিভাবে বের করব সে আমরা আগে থেকেই জানি। A থেকে তিনটে সেতু বেরিয়েছে, অতএব, যে পথ আমরা উত্তরে পাবো তাতে থাকবে ২ টি A। B-এরও তিনটে সেতু, B থাকবে ২ টি। D-এরও তাই। শুধু C থেকে সেতু আছে ৫ টি, অতএব C আসবে ৩ বার। তবে মোট অক্ষর সংখ্যা দাঁড়াল ২+২+২+৩=৯। যাহ! কি হল? ওখানে পেলাম ৮ টা, এখানে পাচ্ছি ৯ টা। কিছু কি ভুল হল? না, কোন ভুল নেই। অয়লারও তাই পেয়েছিলেন। আর এটা দিয়েই উনি প্রমাণ করে দিলেন যে এই ধাঁধার কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। গনিতের ভাষায় এধরনের প্রমাণ কে বলা হয় দ্বন্দ্ব দ্বারা প্রমাণ (proof by contradiction)। পদ্ধতিটি মোটামুটি এরকম, আপনি একটা কিছু ধরে নিয়ে অঙ্ক করা শুরু করে দিলেন, কিছুদূর এগিয়ে দেখলেন অবান্তর কিছু পাচ্ছেন। অতএব, আপনি যা ধরেছিলেন তা নিশ্চয়ই ভুল। যেমন এখানে হল, আমরা ধরে নিলাম এই ধাঁধার সমাধান আছে, তারপর আগে এগিয়ে দেখলাম যে পথ এর উত্তর হবে তাতে একভাবে দেখলে ৮ টা অক্ষর থাকবে, আরেক ভাবে দেখলে ৯ টা অক্ষর থাকবে। যা অসম্ভব। অতএব এরকম কোন পথ থাকতেই পারে না, যা ঐ ধাঁধার উত্তর হতে পারে। কোনিংসবার্গের লোকরা বৃথাই চেষ্টা করে যাচ্ছিল অ্যাদ্দিন।
১৭৪১ সালে অয়লার এসব কথা বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ করেন ‘কমেন্টারই অ্যাকাদেমিআই স্কিএন্তিয়ারুম পেট্রোপলিটানি’ নামের এক বিজ্ঞান পত্রিকায়। আর তার থেকেই জন্ম নেয় গণিতের দুটি নতুন ধারা। সেটা বলার আজ বোধ হয় আর সময় হবে না। আগামী সপ্তাহে ফিরে আসবো দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে। তার আগে একটা ছোট তথ্য দিয়ে যাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনিংসবার্গে বোমা পড়ে, আর দুটো সেতু সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। আজকে মানচিত্রটা দেখতে অনেকটা চিত্র ৫ এর মতো। এবার একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি, ধাঁধাটার উত্তর করা যায় কি না?
(ক্রমশ। যাহ! নামকরণের স্বার্থকতা বলা হল না। আচ্ছা নয় পরের সপ্তাহেই বলবো।)
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.