~ কলমে এলেবেলে প্রত্যয় ~
পূর্ণ সংখ্যার গল্প এবার শেষ হল। এবারের গল্পের প্রেক্ষাপট বেশ আন্তর্জাতিক। মিশর, গ্রীস, ভারত সব মিলেই হবে এবারের কাহিনী। শুরু মিশরেই। আমেনেমহেট ১-র পিরামিড তৈরি হচ্ছে। হাজার হাজার ক্রীতদাস লেগেছে সেই কাজে। পাবাশা আছে তাদের মধ্যাহ্নভোজ দেওয়ার দায়িত্বে। একটা মোটা রুটির মতো খাবার, একটায় খেতে পারে ৩ জন। তাহলে কটা রুটি নিয়ে আসবে সে? সেই নিয়ে তার ধন্ধ।
ভগ্নাংশের ধারনাটা এই সময়েই মানুষের মনে তৈরি হতে শুরু করে। গণিত ও স্থাপত্যের উন্নতির সাথে সাথে তা বহুল প্রচলিত হয়ে যায়। আগেই বলেছিলাম আজকের গল্প দেশকালের সীমানা পেরিয়ে যাবে। তাই চট করে আমরা বেশ কয়েক শতাব্দী এগিয়ে যাই, মিশরেই। দোর্দণ্ড প্রতাপ ফ্যারাও রামেসেস – ২ নিজের স্মৃতিসৌধ বানাচ্ছেন। উনি তখন জীবিত। পিরামিডের পরেই মিসরীয় স্থাপত্যের যদি কোন অতুল কীর্তি থেকে থাকে তো সেটা এই স্মৃতিসৌধ। নীলনদের দক্ষিণ পাড়ে তৈরি হচ্ছে সেই সৌধ। অজস্র ক্রীতদাস লেগেছে সেই কাজে। চারিদিকে গড়ে উঠছে, মূর্তি, মন্দির। কিছু পুরনো স্থাপত্যকেও ঠিকঠাক করা হচ্ছে। মন্দিরে ঢুকছে অসংখ্য হিরে জহরত। সব এলাহি ব্যাপার।
সে একটা খোলা মুখ আঁকলো
তার মাঝখানেই এসে হাজির আহমেস, রা-এর পুরোহিত। লোকে যথেষ্ট সম্ভ্রমের চোখেই দেখে তাঁকে। একে তো রামেসেস – ২ নিজেই রা-এর উপাসক, তারপরে তিনি নিজেও বেশ পণ্ডিত মানুষ, জাদু শক্তি আছে ওনার। দাবি ওনার বেশী কিছু না, রা-এর যে নতুন মন্দির তৈরি হচ্ছে তার ভূগর্ভে একটা প্যাপিরাস রাখতে দিতে হবে। প্যাপিরাসে গুপ্তধনের সন্ধান জাতীয় কিছু নেই, আছে একটি ভগ্নাংশের নামতা, আর কটি ভগ্নাংশের অঙ্ক। পাবাশার মতো রুটির অঙ্ক করে করে মিসরীয়দের ধারণা ছিল যে ১ কে যে কোন পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায়, ১/২, ১/৩, ১/৪ এরকম। সেটা লেখারও একটা পদ্ধতি পাবাশা করে দিয়েছে। সে ভাবল ওপরে তো সবসময় ১, তাই ওটা নিয়ে আর ভেবে কাজ নেই। ভগ্নাংশ দেখাবার জন্যে সে একটা খোলা মুখ আঁকলো, আর নিচে লিখল পূর্ণ সংখ্যাটা, সেই খাবাস যেমন লিখত। আহমেস যেটা দেখলেন সেটা হচ্ছে, একটা রুটি যদি ৩ জনে খায় তো দুটো রুটি ৬ জনে খায়। সেটাকেও তো ভগ্নাংশ করে লেখাই যায়, ২/৬। তাহলে তো সব সময় যে ওপরে ১ থাকবে তা নয়। কিন্তু উনি যেটা ভাবলেন সেটা হল তবে কি এমন যে যেকোনো ভগ্নাংশকে ভেঙ্গে কি ১এর ভগ্নাংশ হিসেবে লেখা যায়? উনি শুরু করলেন ২/৩ দিয়ে। এটিকে উনি বাগে আনতে পারলেন না। যদিও এটাকে ১/২+১/৬ হিসেবে লেখা যায়। কিন্তু, কেন যে লিখলেন না কে জানে। তার ওপরেরগুলো, মানে ২/৪ থেকে শুরু করে সবগুলো টপাটপ করে ফেললেন। যেমন ২/১৫=১/১০+১/৩০। হ্যাঁ, কখনও কখনও দুটোর বেশিও ভগ্নাংশ লাগলো, যেমন ২/১০১=১/১০১+১/২০২+১/৩০৩+১/৬০৬। শুধু ঐ ২/৩টি করলেন না। উনি ওটাকে একটা নতুন সংকেত দিয়ে লিখে ছেড়ে দিলেন।
এবার, ২/৩ কে নিয়ে কারসাজি শুরু করলেন, তাতে ১এর বিভিন্ন ভগ্নাংশ জুড়তে শুরু করলেন। প্রাথমিক ভাবে একটু ঝামেলা হলেও, খানিকক্ষণের মধ্যেই নতুন নতুন ভগ্নাংশ পেতে শুরু করলেন। এই রকমভাবে ভগ্নাংশ নিয়ে উনি বেশ কতকগুলি অঙ্ক তৈরি করলেন। উনি এটাও দেখালেন যে ভগ্নাংশ ব্যবহার করে দুটো সংখ্যার গুণ কিভাবে করতে হয়। সব শেষে একটি প্যাপিরাস বের করে তাতে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চললেন রা-এর মন্দিরে। এই প্যাপিরাসের একটা সংরক্ষণ দরকার। সংরক্ষণ হল। পরে আবার চুরি হল, আবার উদ্ধারও হল, বিদেশে চলে গেলো সেই প্যাপিরাস। তবে সেই গল্প একটু পরে বলছি।
সংরক্ষণ হল। পরে আবার চুরি হল, আবার উদ্ধারও হল, বিদেশে চলে গেলো সেই প্যাপিরাস।
ভগ্নাংশ প্রথম মিশরে ব্যবহার হলেও, অন্তত প্রত্নতাত্বিকরা যা খুঁজে পেয়েছেন তাতে তাই মনে হয়। তবে অনুমান করা যায় এই সময়ের আগে পরে পৃথিবীর বাকি প্রান্তেও ভগ্নাংশের ধারণা তৈরি হতে শুরু করে। যেমন আরও কয়েক শতক পরে গ্রীসদেশে এবং ভারতে ভগ্নাংশের ব্যবহার বহুলভাবে শুরু হতে থাকে। সমস্ত পৃথিবীতেই ভগ্নাংশ এবার নানান পুঁথিতে নানা ভাবে গণিতের সংখ্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আসতে শুরু করে দিয়েছে। যদিও একথা সত্য যে আজকের ভগ্নাংশের ধারণা সম্পূর্ণভাবে আসতে প্রায় হাজার বছর সময় লেগেছে। এর মধ্যে ভারতে সুলভা সুত্রা এসেছে বা গ্রীসে ইউল্কিড তাঁর ১৩ খণ্ডের ‘এলেমেনটস’ নিয়ে এসেছেন। সেখানে সার্বিকভাবে ভগ্নাংশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যাক, এবার তবে থ্রিলারটায় ফেরা যাক।
চারদিক ঘুরে দেখলেন একটা সৈনিক ধারে কাছেই আছে, আগ্নেয়াস্ত্র সহ।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ৫০-৬০-এর দশকের কথা। হ্যাঁ, প্রায় ৪০০০ বছর এগিয়ে গেছি একধাপে, আধুনিক যুগে। এক রুগ্ন স্কটিশ যুবক ঘুরে ঘুরে জিনিস দেখছেন মিশরের লাক্সুর শহরের বাজার। নাম আলেকজান্ডার রিহ্ন্ড। হঠাৎ, ওনার মনে হল কেউ একটা যেন ওনাকে অনুসরণ করছে। সাধারণ ছিনতাইবাজ হতে পারে, তাই সতর্ক হয়ে গেলেন রিহ্ন্ড। বাজারের কেনা-কাটা চলল সমানতালে, কিন্তু সন্দেহভাজনকে চোখে চোখে রেখে। একসময় এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেলেন রিহ্ন্ড, যেখানে বাজার খুব পাতলা হয়ে গেছে। এরপর এগোলে প্রায় ফাঁকা জায়গায় পড়ে যাবেন উনি, ছিনতাইবাজের সাথে একা। উনি একা তাঁর সাথে লড়াইয়ের অবস্থায় নেই, শারীরিক দুর্বলতা ওনার এখনো কাটেনি। চারদিক ঘুরে দেখলেন একটা সৈনিক ধারে কাছেই আছে, আগ্নেয়াস্ত্র সহ। অতএব, বাঁচালে একা এই বাঁচাতে পারে। সরাসরি ছিনতাইবাজের সামনে গিয়ে ঝামেলা শুরু করাই একমাত্র রাস্তা। সেটাই করতে যাচ্ছিলেন। অথচ, ছিনতাইবাজের চোখে চোখ পড়তেই দেখেন সে সৈনিকের দিকে একটা চোখের ইশারা করে সরে পড়ল পাশের গলিতে। যাওয়ার আগে ঘাড় নাড়িয়ে ইশারায় অনুসরণ করতে বলে গেলো। রিহ্ন্ড দোটানায়। শেষে দোনামনা করে, যা থাকে কপালে ভেবে উনিও পা বাড়ালেন। গলির ভেতরে ঢুকে দেখেন সে লোক উধাও। খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখেন একটা বাচ্চা মেয়ে। মুহূর্তের জন্যে খেলা থামিয়ে সে আরও ভেতরের দিকে আর একটা গলির দিকে দেখিয়ে দিল। রিহ্ন্ড এগিয়ে চললেন।
স্কটল্যান্ডে থাকতে রিহ্ন্ড পড়েছিলেন কঠিন ফুসফুসের রোগে। স্কটল্যান্ডের ভেজা ভেজা আবহাওয়া, তাই, ডাক্তারের নির্দেশে যেতে হবে শুকনো জায়গায়। রিহ্ন্ড সিদ্ধান্ত নিলেন যে মিশরে যাবেন, লাক্সুর শহরে। এই লাক্সুর শহরের বাইরেই ছিল রামেসেস–২-এর স্মৃতিমন্দির। বিরাট জায়গা জুড়ে একাধিক মন্দির, স্মৃতিসৌধ, নাম রামেসিয়াম। শুধু রামেসেস–২-এর নয়, আরও অনেক ফ্যারাওয়ের অবদান আছে সেখানে। এই মন্দিরের কোথাও কোন গর্ভগৃহে রাখা ছিল আহমেসের প্যাপিরাস। মিশরে সবদিনই কিছু সমাধি চোর থাকে। এরা জানত যে পিরামিড, বা এই স্মৃতি মন্দিরগুলোর গর্ভগৃহে জমা আছে অসংখ্য ধন দৌলত। তারা খুঁজে বের করে ইতিহাসের বালুর নিচে চাপা পড়ে যাওয়া এই সমাধিগুলো। এই সমাধি চোরেরা সেই সমাধিতে খোঁড়াখুঁড়ি চালায়, এবং বেশ কয়েকবার তারা বেশ লাভবানও হয়। এই সমাধি চোরদের থেকে পিরামিডগুলোকে বাঁচাতেই কিন্তু পিরামিডের সব অভিশাপের গল্প। আপনি যে শুনতে পান, অমুক ফ্যারাওয়ের শান্তিভঙ্গ করলে শাস্তি হবে, এগুলো সবই ঐ জিনিস। বহুদিন ধরেই এই সমাধি চোরেরা আছে, আর এদেরকে আটকাতেই এই অভিশাপের কথা হাজার হাজার বছর ধরে প্রচার করা হয়। এই রকম একদল চোরই গোপনে খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ করে রামেসিয়ামে। এখনও ধনদৌলত কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু প্যাপিরাস পেয়েছে তারা। সেগুলো তারা গায়েব করেছে। এগুলোর খুব একটা দাম পাওয়া যায় না, তবে মাঝে মাঝে সাদা চামড়ার কিছু লোক আসে, তারা এগুলো খোঁজে, বেশ ভালো দামে বিক্রি করা যায়। রিহ্ন্ড ও স্বাস্থ্য উদ্ধারের পাশাপাশি, মোটামুটি এরকমই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন। স্কটল্যান্ডে এই সময়ে বেড়েছে প্রত্নতত্ত্বের ঝোঁক। ন্যাশনাল মিউসিয়ামও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রিহ্ন্ডেেরও প্রাচীন জিনিস খুব পছন্দের। তাই উনি বেশ কয়েকদিন ধরেই লাক্সুরের বাজারে বাজারে ঘুরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন পুরনো জিনিস। বাজারে যদিও খুব পুরনো জিনিস পাওয়া যায় না, আর প্রচুর ঠগও আছে। তাই, ইতিমধ্যে উনি স্থানীয় কিছু লোকের মধ্যে এটাও প্রচার করেছেন যে উনি বেশ পুরনো জিনিস কিনতে আগ্রহী। আজকের সন্দেহভাজন সেই চোরের দলেরই একজন। প্রচারটা তাঁর কানে গেছে। তার হেফাজতে কিছু প্যাপিরাস। তার মধ্যেই আছে আহমেসের প্যাপিরাস।
গলির একদম শেষ প্রান্তে একটা অন্ধকার জায়াগায় দাঁড়িয়ে সেই চোর। দূর থেকে রিহ্ন্ডকে দেখেই সে হাতছানি দিয়ে ডাকল। রিহ্ন্ড গতি বাড়ালেন। সামনে যেতেই সে তার ব্যাগ থেকে বের করল সব প্যাপিরাস। মনে সন্দেহ হলেও, রিহ্ন্ড ভালো করে দেখতে শুরু করলেন সেসব। চোর এদিকে খুব তাড়ায়। দেরী না করে প্রায় জলের দরেই রিহ্ন্ড কিনে নিলেন সব কটা।
পৃথিবীর প্রথম নাম জানা গণিতজ্ঞ।
রিহ্ন্ড এরপর আর বেশিদিন বাঁচেননি। তাঁর খুঁজে পাওয়া সব প্রাচীন জিনিস বিক্রি করে দেওয়া হল ব্রিটিশ মিউসিয়ামকে। বেশ কয়েক দশক লাগলো সেসব খুলে পড়ে বুঝতে। কিন্তু, পড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের তো চক্ষু চড়কগাছ। এটা কি দেখছেন তাঁরা? একটা প্যাপিরাসে লেখা রয়েছে ভগ্নাংশের এতো এতো নিয়ম, আর এতো এতো অঙ্ক। আর তার থেকেও বড় কথা তাতে রয়েছে লেখকের নাম, আহমেস। পৃথিবীর প্রথম নাম জানা গণিতজ্ঞ। শাসা, আকুদ, খাবা, খাবাসের মত নাম হারিয়ে যাওয়া নয়, আহমেসের নাম আর পৃথিবী থেকে আর কোনদিন মুছে যাবে না। চিরতরে রয়ে গেলো ব্রিটিশ মিউসিয়ামে।
এই প্যাপিরাসের এক জায়গাতেই পাওয়া গেলো π-এর একটা আনুমানিক মান। যদিও আমরা আজ জানি পাই অমূলদ সংখ্যা। তবুও সেদিন সেটা মূলদ বলেই ধরা হতো। লোকে অমূলদ সংখ্যা জানত না। শুধু অমূলদ সংখ্যা যে হয়, এটা বলেই নির্বাসন গেছিলেন, না মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল একজনের। এবার সেই গল্পেই ঢুকবো।
(ক্রমশ)
========================
এলেবেলে দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
এলেবেলে – Elebele