~কলমে জ্যোতির্ময় পাল
ধুলো, বালি, ঝাঁটা
পৃথিবীতে কিছু প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলে। যেমন, পৃথিবীর আহ্নিক গতি। একদম জম্ন লগ্ন থেকে এই প্রক্রিয়া কখনোই থামে নি, হয়তো গতির পরিমাপ পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু শুন্য হয়ে যায় নি। এরকম আরেকটি নিরবচ্ছিন্ন পদ্ধতি হলো সেডিমেন্টেশন (sedimentation) বা অধঃক্ষেপন। ক্ষেত্র বিশেষে, সেডিমেন্টের (sediment) প্রকতি এবং পরিমান পরিবর্তিত হয়, কিন্তু থেমে যায় না।
সেডিমেন্টেশনের সব থেকে ভালো উদাহরণ হলো, বাড়ির ধুলো। কিছুদিন ঝাঁট না দিয়ে রেখে দিলে ধুলো জমবে। এটা একরকমের সেডিমেন্টেশন যেখানে বায়ু থেকে অপেক্ষাকৃত ভারী পার্টিকলগুলি অভিকর্ষের টানে নিচে জমা হয়। যদি কারোর বাড়ি শহরের কোনো এক রাস্তার ধারে হয়, তাহলে এই ধুলো অনেক বেশি জমবে। কারণ দূষণ জনিত ভারী পার্টিকেলের সোর্স শহরের রাস্তায় অনেক বেশি। শহর থেকে দূরে, যেখানে দূষণের মাত্রা কম, সেখানে কারোর বাড়ি থাকলে ধুলো জমার প্রবণতাও কম হবে। কিন্তু বহুকাল সেই ঘর পরিষ্কার না করলে, যতই দূষণের মাত্রা কম হোক, ধুলো কিন্তু জমবেই। এই সেডিমেন্টেশন থেকে পালাবার পথ নেই। তবুও আমরা বাড়িঘর পরিষ্কার করার জন্য প্রতিনিয়ত ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করি।
বাতাসের মতো নদীতেও সেডিমেন্টেশন হয়। মাধ্যাকর্ষণের কারণে নদী পার্বত্য অঞ্চল বা যেকোনো উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে সাগরের দিকে প্রবাহিত হয়। এই গতিপথে যে সকল পাথর থাকে, তাদের ক্রমাগত ক্ষয় করতে থাকে। যখন নদীর ঢাল বেশি থাকে, তখন নদীর গতিবেগ অনেকটাই বেশি, এবং এই সমস্ত ক্ষয়িত শিলা নদীর সাথে প্রবাহিত হতে থাকে। দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষয়ের ফলে বড় বড় পাথরও ধূলিকণায় পরিণত হয়। এই সব শিলাচূর্ণ (সেডিমেন্ট) দীর্ঘ সময় ধরে অভিকর্ষের টানে যদি বক্ষে ক্রমাগত জমা হতে থাকে। যখন এই সব ক্ষয়িত শিলাচূর্ণের ব্যাসের দৈর্ঘ্য ২-০.০৬২৫ মিলিমিটারের মধ্যে হয়, তখন তাকে বলে বালি বা স্যান্ড (sand)। বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, স্যান্ড কিন্তু একটা পার্টিকেল সাইজ, কোনো রাসায়নিক গুনের ওপর নির্ভরশীল না। সিলিকা কণার সাইজও এই ২-০.০৬২৫ মিলিমিটারের মধ্যে হলে তাকে সিলিকা স্যান্ড বলে, কার্বোনেটের পার্টিকেল এই পরিমাপের মধ্যে হলে সেটা হয় কার্বোনেট স্যান্ড। নদীর জলের ধাক্কায় শিলাচূর্ণ আরো মিহি হয়ে ০.০০৩ মিলিমিটারের কম সাইজ হলে তাকে বলে কাদা বা ক্লে (clay)।
কয়েক কোটি বছরের তরুণ নদী পাহাড় ভেঙে আনে। যে পাহাড়ের উচ্চতা যত বেশি, সেই পাহাড় থেকে আরো বেশি বালি, কাদা জাতীয় সেডিমেন্ট আসতে থাকে। ভূমিরূপের ঢাল কমতে থাকলেই নদীর প্রবাহ দুর্বল হয় এবং পাহাড় থেকে সংগৃহিত পাথরখন্ড নদী গর্ভে জমা হতে থাকে। সাগরের একদম কাছে গিয়ে ভূমিঢাল প্রায় শূন্য হয়ে যায়। নদীর হাজার হাজার কিলোমিটারের যাত্রাপথে বয়ে আনা সমস্ত বালি, পলি, কাদা সাগরের মুখে (মোহনায়/ estuary) জমাতে থাকে।
এই খানে সাগর ঝাঁটার মতো কাজ করে। আমাদের বাড়িঘর যেমন ঝাঁটদিয়ে পরিষ্কার করতে হয়, যাতে ধুলো না জমে, সাগরের ঢেউ এবং জোয়ার ভাঁটা এই কাজটা করে। একে বলে রিওয়ার্কিং (Reworking)। নদী কতটা সেডিমেন্ট ডিপোজিট করছে,আর সমুদ্র কত তাড়াতাড়ি রিওয়ার্ক করে তাকে সরিয়ে দিতে পারছে, তার ওপর নির্ভর করে নদী-সাগর মিলনের ভূমিরূপ। সম্ভবত নীল নদের মোহনায় ত্রিভুজ আকৃতি ভূমিরূপের কারণেই এই অঞ্চল গুলির নাম দেওয়া হয় ডেল্টা (delta)। যদিও বাংলা নামটা অনেক বেশি তারপর্যপূর্ন। ব-দ্বীপ। ব-দ্বীপ কিন্তু প্রকৃতই একটা (বা অনেকগুলো) দ্বীপ। যে স্থলভাগের চারদিক জলদ্বারা বেষ্টিত, তাকে দ্বীপ বলে। ব-দ্বীপ গুলিও চার দিকে সমুদ্র এবং নদী দ্বারা বেষ্টিত থাকে।
যদি নদী বাহিত সেডিমেন্টের পরিমান অনেক বেশি হয়, যা সমুদ্র রিওয়ার্ক করে সরিয়ে ফেলতে না পারে, তাহলে সমুদ্রের মুখে সেডিমেন্ট জমতে থাকে। এতে স্বাভাবিক উপকূল ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে এগোতে থাকে, বা বলা ভালো, সমুদ্রকে ঠেলে পিছনে সরাতে থাকে। সমুদ্র পৃষ্ঠ কি কি ভাবে এগিয়ে এসে স্থলভাগকে গ্রাস করে ফেলতে পারে, বা কি করে পিছিয়ে গিয়ে স্থলভাগের আয়তন বাড়িয়ে দিতে পারে, তার বেশ কিছু হিসাব আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের এই আপেক্ষিক সরণের ওপর নির্ভর করে নদীতে ব-দ্বীপ তৈরী হবে কিনা। জটিল হিসাবের কিছু অতিসরলীকৃত অংশ এখানে আলোচনা করছি।
সমুদ্রের আসা যাওয়ার মাঝে
ধরা যাক সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা সময়ের সাথে sine ফাঙ্কশনের মাধ্যমে যুক্ত। অর্থাৎ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা যদি z হয়, তাহলে,
z= a*sint
যেখানে a হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের সর্বাধিক বা সর্বনিম্ন উচ্চতা। যদি a ১০ হয়, তাহলে বুঝবো, কোনো এক সমুদ্রপৃষ্ঠ mean sea level এর থেকে সর্বাধিক ১০ মিটার বেশি উঠতে পারে বা ১০ মিটার নেমে যেতে পারে। t হলো সময়। সময়ের সাথে সাথে কখনো সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়েছে, কখনো কমেছে। এই সমুদ্রতলে উচ্চতার পরিবর্তন প্রথম ছবির গ্রাফের মাধ্যমে দেওয়া আছে। লাল রঙের কার্ভ টি এই উচ্চতার পরিবর্তনকে দেখাচ্ছে। সবুজ রঙের সরলরেখাটি নির্দেশ করছে mean seal level ।
কিন্তু সমুদ্রতল কত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, সেটা জানতে গেলে একটা ছোট অঙ্ক করতে হবে। যারা অল্প অল্প ক্যালকুলাস করেছ, তারা জানবে যে z কে t এর সাপেক্ষে ডিফারেন্সিয়েট করলে উচ্চতার পরিবর্তনের হার (rate of change of sea level ) জানা যাবে। অর্থাৎ,
dz/dt = a*cost
প্রথম ছবিতে নীল রঙের দাগ দেওয়া কার্ভটি এই পরিবর্তনের হারকে (dz/dt) দেখাচ্ছে।
সমুদ্রতলের উচ্চতা এবং উচ্চতা পরিবর্তনের হার সেডিমেন্টেশনকে প্রভাবিত করে। t1 সময় থেকে আলোচনা শুরু করা যাক, যখন সমুদ্রতল সর্বোচ্চ। এই সময় যদি যদি থেকে অনেক বেশি পরিমানে সেডিমেন্ট জমতে থাকে, এবং সমুদ্র যদি তাকে রিওয়ার্ক করতে না পারে, তাহলে নদীর সেডিমেন্ট সমুদ্রকে ঠেলে সরিয়ে দিতে থাকবে। এই ঘটনাকে বলে মেরিন রিগ্রেশন বা সমুদ্রের স্বাভাবিক পিছিয়ে যাওয়া (Normal marine regression)। ঠিক t1 এর পর থেকেই তাই সমুদ্রতলের উচ্চতা হ্রাস পেতে থাকছে। t1 – t2 পর্যন্ত এই সময়ে সমুদ্রতলের পিছিয়ে যাচ্ছে, এবং নদীবাহিত সেডিমেন্ট ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে। এটা ব-দ্বীপ তৈরির আদর্শ সময়। Sequence stratigraphy ভাষায় এই সময় কালকে বলা হয় Highstand systems tract (HST)। চিত্র ১ এ এই ঘটনার একটা কল্পচিত্র দেওয়া আছে। ৫টি সময়ের জন্য কি ভাবে নদী এবং সাগরের সঙ্গম স্থলে কি ভাবে সেডিমেন্টেশন হচ্ছে, তা দেখা যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে ভূতাত্ত্বিক স্থানের বৈশিষ্ট কি ভাবে পরিবর্তন হয়, তাকে বলে space-time diagram। চিত্র ১ এরকমই একটি ডায়াগ্রাম, যেখানে বোঝা যাবে সময়ের সাথে সাথে সেডিমেন্টেশনের ভূমিরূপ কি ভাবে বদলাচ্ছে। নদীবাহিত সেডিমেন্ট এখানে সবুজ রঙের, অগভীর সমুদ্রের সেডিমেন্ট হলুদ এবং গভীর সমুদ্রের সেডিমেন্ট গোলাপি রং দিয়ে বোঝান হয়েছে। প্রতিটি হলুদ অংশের সর্বোচ্চ প্রান্তটি সেই সময়ের সমুদ্র এবং নদীর (উপকূলের) মিলনস্থল বা relative sea level নির্দেশ করছে। যদি সবুজ রঙের অংশ গুলি গভীর সমুদ্রের দিকে এগোতে থাকে (গভীর সমুদ্র ছবিতে ডান দিকে, লাল রঙে লেখা), অর্থাৎ নদীবাহিত সেডিমেন্ট সমুদ্রকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে, তাহলে স্থলভাগ বৃদ্ধি পাবে, এবং নতুন বা-দ্বীপ অঞ্চল তৈরী হতে পারে। (a) ছবিতে দেখতে পাচ্ছি HST পর্যায়ে নদীর সেডিমেন্ট (সবুজ) ক্রমশ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে আসছে। বাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চল সম্ভবত এই রকম HST সময়েই তৈরী হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় ১ কোটি বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ট বর্তমান উত্তর বঙ্গের কাছে, হিমালয়য়ের পাদদেশীয় অঞ্চলে থাকতো। ক্রমাগত নদীর সেডিমেন্ট জমা হয়ে হয়ে সমুদ্রকে পিছনে ঠেলে বিস্তৃত ব-দ্বীপ অঞ্চল তৈরী হয়েছে।
t2 সময় অতিক্রান্ত হলে দেখা যাচ্ছে লাল কার্ভ mean seal level এর নিচে চলে গেছে । এই ঘটনা ঘটে যদি সমুদ্রপৃষ্ঠে জলতল নিচে নেমে যায়। পৃথিবীতে তুষারযুগে সমুদ্রের জল বরফ হয়ে গেলে জলতল নেমে আসতে পারে। জলের গভীরতা কমে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো জলের ওপরে উঠে আসবে। ঠিক যেন জোড় করে জল সরিয়ে দিয়ে সমুদ্রের নিচের স্থলভাগকে তুলে আনা হচ্ছে। সমুদ্রের এই রকম অবস্থানকে বলা হয় forced regression (b) । t2 থেকে t3 এর মধ্যে সময়কালকে বলা হয় Falling-stage systems tract (FSST)। এদিকে সমুদ্রের জলের তল নিচে নেমে যাবার কারণে নদীর মধ্যে এক নতুন আলোড়ন শুরু হচ্ছে। নদীর বিশেষ বৈশিষ্ট হলো, সে সব সময় সমুদ্রতলের সাথে সমান অনুভূমিক তলে বইতে চায়। সমুদ্রতল নিচে নেমে গেলে নদীর ক্ষয়কার্য বেড়ে যায়, ফলে নদী উপত্যকার গভীরতা বাড়তে থাকে। অধিক ক্ষয়ের জন্য নদীর মুখে সেডিমেন্ট জমা হয় না, বরং আগের যে সেডিমেন্ট জমা হয়েছিল তাকেও ধ্বংস (river incision) করে ফেলে। এই সময় কোনো ব-দ্বীপ তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা কম হয় না। কিন্তু বরং গভীর এবং অপেক্ষাকৃত চওড়া হয়ে নদী সমুদ্রের মধ্যে সরাসরি এসচুয়ারির (Estuary) মাধ্যমে প্রবেশ করে। প্রবেশ করে। এই রকম মোহনাকে বলে এসচুয়ারি (Estuary)। ছোট ছোট নদীতে যখন সেডিমেন্ট খুব এ কম থাকে, এবং সমুদ্রের ঢেউ তাদের কে ধ্বংস করে দেয় তখন ও এই রকম এসচুয়ারি তৈরী হয়। নর্মদা নদীতে কম সেডিমেন্ট এবং forced regression এর কারণে ব-দ্বীপ তৈরী হয় না, এসচুয়ারির মধ্যে দিয়ে নর্মদা আরব সাগরে মিলিত হয়।
FSST Forced regression এর শেষবেলায় (t3) সমুদ্রের উচ্চতা হ্রাসের হার কমে যায়, এবং আবার ধীর গতিতে উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে নদীর ক্ষয়ক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে ক্ষয়িত সেডিমেন্ট আবার সাগরের মুখে জমা হতে থাকে এবং ব-দ্বীপ তৈরির সম্ভাবনা তৈরী করে। (c) তে দেখা যাচ্ছে, আবার নদীবাহিত সেডিমেন্ট (সবুজ রঙের) জমা হচ্ছে, যা (b) তে অনুপস্থিত ছিল। t3 থেকে t4 পর্যন্ত এই সময় কে বলে Lowstand systems tract (LST), কারণ এই সময়ে সমুদ্রের জলতল সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছায়। সুন্দরবনাঞ্চলে নতুন যে সমস্ত ব-দ্বীপ তৈরী হয়েছে, তা সম্ভবত এই পর্যায়ে তৈরী হওয়া।
পরবর্তী ধাপে (d) সমুদ্রপৃষ্ঠ আবার উচ্চতা লাভ করে এবং এই উচ্চতা বৃদ্ধির হার হয় খুব দ্রুত এবং সেডিমেন্টেশনের হারের থেকে অনেক বেশি। তাই, সেডিমেন্টেশনকে ঝাঁটার মতো পরিষ্কার করে সমুদ্র স্থলভাগের দিকে এগোতে থাকে। এই ঘটনাকে বলা হয় marine transgression। t4 থেকে t5 পর্যন্ত সময়কে বলে Transgressive systems tract (TST), কারণ এই সময়ে যে সমস্ত সেডিমেন্ট জমা হয় তা সমুদ্রের এগিয়ে আসার (Transgression) কারণে। সমুদ্র যেহেতু স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসে, এই ক্ষেত্রেও তাই ব-দ্বীপ তৈরী হতে পারে না। তুষারযুগে নরওয়ে,সুইডেনের উপকূলের সমুদ্রতল অনেকটা নিচে অবস্থান করত, কারণ সমুদ্রের জল বরফ হয়ে গিয়ে জলতল নামিয়ে এনেছিল। এর ফলে ওই সমস্ত অঞ্চলে ব্যাপক হরে forced regression হয়। forced regression হলেই নদী বা হিমবাহ নিম্নমুখী ক্ষয় করে গভীর নদী বা হিমবাহের উপত্যকা তৈরী করে ।তুষারযুগ শেষ হবার পর সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে গভীর হিমবাহের উপত্যকা গুলো আবার সমুদ্রের জলে ভরে ভোরে গেছে। TST পর্যায়ে তৈরী হওয়া এই রকম এসচুয়ারিকে উত্তর ইউরোপে বলে ফিয়র্ড (Fjord)।
ওদের কোনো দ্যাশ নাই
TST এর পর আবার HST শুরু হয় এবং আবার নতুন করে ব-দ্বীপ গঠনের কাজ সম্ভব হয় (e)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব-দ্বীপ তৈরী হওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার না। অন্তত স্কুলের ভূগোলে যা পড়া হয়েছিল, তার থেকে বেশ অনেকটাই জটিল। সেডিমেন্টেশন নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, কিন্তু সমুদ্রতলের উচ্চতার ওপর নির্ভর করে নদীর ক্ষয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে অথবা সমুদ্রের রিওয়ার্কিংয়ের কারণে সেডিমেন্ট জমতে পারে না। তাই ব-দ্বীপ সবসময় তৈরী হতে পারে না। তাও এখানে যে উদাহরণটি নেওয়া হয়েছে, যে সমুদ্র পৃষ্ঠ নিয়মিত ভাবে sine curve এর মতো ওঠা নাম করে, বাস্তবে তা হয় না। সমুদ্রের সরণ এতো নিয়মিত হয় না। আর একটি বিষয় এখানে আলোচনা করি নি, সেটা হলো টেক্টোনিক্স (Tectonics) এর প্রভাব। টেক্টোনিজম সমুদ্রের সরণ কে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে এবং সাথে সাথে সেডিমেন্টেশন এর হার ও পরিবর্তিত হয়। সুতরাং, একাধিক প্যারামিটারের ওপর নির্ভর করে ব-দ্বীপ তৈরী হবে কিনা। তবেএবং এটাও খুব পরিষ্কার যে, একবার ব-দ্বীপ তৈরী হলে তা চিরস্থায়ী নয়। পৃথিবীর ওপর কোনো জিনিষ ই তা নয়, কিন্তু ব-দ্বীপ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে সৃষ্টি বা ধ্বংস হতে পারে। ব-দ্বীপের জীবনচক্রের প্রধান চালক সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এখন আর কোনো লুকানো বা বিভ্রান্তিকর বিষয় নয়। সমস্ত বৈজ্ঞানিক ডাটা নিশ্চিত করেছে যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে এবং আগামী দিনে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়বে, অর্থাৎ, মেরিন ট্রান্সগ্রেশন হবে। এক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বে পৃথিবী ব্যাপী সমস্ত ব-দ্বীপ অঞ্চল, বিশেষত ক্রান্তীয় এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে যেখানে জনঘনত্ব অত্যাধিক। ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবন ব-দ্বীপের অনেক অংশই সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এর একটা অন্যতম কারণ হতে পারে। আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ১ মিটার বৃদ্ধি পায় , তবে নিশ্চিত ভাবে সুন্দরবন ব-দ্বীপের বেশ কিছুটা অংশ হারিয়ে যাবে। বিপুল জনবহুল অঞ্চলে তৈরী হবে পরিবেশ উদ্বাস্তু (climate refugee)। ভবিষ্যতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম ক্রাইসিস ঘিরে থাকবে এই সমস্ত নদীর ব-দ্বীপের ইতিহাস এবং ভূতত্ত্ব ।
আরো কিছু ভাবার জন্য
ব-দ্বীপের ভূতত্ত্ব নিয়ে ভাবার জন্য আরো কয়েকটা ছবি দিলাম। ব-দ্বীপ কি ভাবে হচ্ছে এবং sequence stratigraphy এর কোন পর্যায়ের (systems tract) সাথে মিল আছে, সেই নিয়ে আরো চিন্তা করার জন্য। ১-৫ ছবি গুলি ম্যাপভিউ, অর্থাৎ যদি আমরা উড়োজাহাজ করে একটা মোহনার (নদী এবং সাগরের মিলন) ওপর দিয়ে যাই তাহলে এরকম ছবি দেখতে পাবো। ছবিতে সবুজ অংশটা একটা স্থলভাগ, নীল অংশটা সমুদ্র। স্থলভাগের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা নীলরংয়ের নদী বইছে। নতুন সেডিমেন্টকে হালকা এবং গাঢ় বাদামি রং দিয়ে দেখানো হয়েছে। সংশ্লিট ৬-১০ ছবি গুলিকে বলা হয় উল্লম্ব ক্রস-সেকশন। ১-৫ ছবির ওপর একটা কালো দাগ টানা আছে (AA’)। এই দাগ বরাবর যদি মাটির নিচে যেতে থাকি, তাহলে এই ক্রস-সেকশন দেখতে পাবো। পাঠকরা বলতে পারেন কোন ছবিটি sequence stratigraphy এর কোন পর্যায়ে (HST, FSST, LST, TST) পড়ছে ।
—————————————————————
জ্যোতির্ময় পাল
গবেষক, ভারতীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান