~ কলমে এলেবেলে প্রত্যয় ~
a2+b2=c2, এইটি জানে না এমন মানুষ মনে হয় খুঁজে পাওয়া ভার; জ্যামিতির জগতে সবথেকে বিখ্যাত সূত্র। আর, আমাদের আজকের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। সূত্রটির মানে খুব সোজা। একটি সমকোণী ত্রিভুজের দুটি ছোট বাহুর দৈর্ঘ্য যদি a আর b হয়, আর অতিভুজের দৈর্ঘ্য যদি c হয়, তবে a2+b2=c2, a, b, c এর মান যাই হোক না কেন। এই সূত্রর পোশাকি নাম পিথাগোরাসের সূত্র। এটা প্রমাণ করার হাজার রাস্তা আছে, কিন্তু সেসব বলার কোন মানে হয় না। আমাদের গল্প এক অভাগাকে নিয়ে। আচ্ছা যদি প্রশ্ন করি, পিথাগোরাসের সূত্র আবিষ্কার কে করেছেন? অবান্তর প্রশ্ন, নিশ্চয়ই পিথাগোরাস করেছিলেন। মোটেই না। এই সূত্রের কাছে পিথাগোরাস নিতান্ত শিশু।
পিথাগোরাসের হাজার বছরেরও আগে ব্যাবিলনে পিথাগোরাসের সূত্রের কথা পরিষ্কার জানা ছিল।
পিথাগোরাসের জীবনকাল মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি। অথচ, তার প্রায় হাজার বছরেরও আগে ব্যাবিলনে এই সূত্রের কথা পরিষ্কার জানা ছিল। এমনকি মিশরের লোকেও জানত। ফলক, প্যাপিরাস এসব পাওয়া গেছে তাতে ঝুড়ি ঝুড়ি a, b, c-এর মান লেখা আছে। এমনকি, পিথাগোরাসের আবির্ভাবের কয়েকশো বছর আগে ভারতের গণিতজগতও পিথাগোরাসের সূত্র জানত। কিভাবে জানত কেউ জানে না। নিশ্চয়ই মেপে দেখেছিল। তা সে যাই হোক, কোনভাবে এই সূত্র পিথাগোরাসের সূত্র নামেই পরিচিত হয়ে গেলো। মানুষ ততদিনে পূর্ণ সংখ্যা নিয়ে পালোয়ান হয়ে গেছে। তাই এই ফলক, প্যাপিরাস, পিথাগোরাস সব ভর্তি হচ্ছে পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে। সবথেকে ছোট যে পূর্ণ সংখ্যাগুলো এই সূত্র পালন করে তারা হল ৩, ৪, ৫ — ৩২+৪২=৫২। এর পরে খেলাটা খুব সোজা, ৩, ৪, ৫ কে একই পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করলেই হবে, ৬, ৮, ১০ বা ৯, ১২, ১৫; সেটা করেই ভরিয়ে দেওয়া হল। পিথাগোরাস আবার ভগ্নাংশ জুড়েছিলেন সাথে। ওনার বিশ্বাস ছিল যে যেকোনো সংখ্যাকে পূর্ণসংখ্যার ভগ্নাংশ হিসেবে লেখা যায়, অতএব ৩/২, ৪/২, ৫/২ বা ৩/৩, ৪/৩, ৫/৩ এগুলো দিয়েও সমকোণী ত্রিভুজ বানানো যাবে। এখনও কোন সমস্যা নেই। সুখে দিন কেটে যাচ্ছিল, বাধ সাধলেন হেপাসাস।
সুখে দিন কেটে যাচ্ছিল, বাধ সাধলেন হেপাসাস।
পিথাগোরাসের পরেপরেই এনার জন্ম। ইনি পিথাগোরাসের সরাসরি ছাত্র মনে হয় ছিলেন না, দুজনের জীবনকালে বেশ খানিকটা তফাত আছে, তবে অনেকে বলেন যে ছাত্র ছিলেন। হেপাসাস কিন্তু পিথাগোরাসের বিরোধী ছিলেন না, বরং উনি পিথাগোরাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই অঙ্ক করতেন। গোলটা উনি সেটা করতে গিয়েই করলেন। উনি বললেন যেকোন সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে যদি a2+b2=c2, তাহলে a আর b যদি দুজনেই ১ হয়, তাহলে c এর মান কতো? আর তো c কে পূর্ণ সংখ্যায় লেখা যায় না, আর না পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হিসেবে লেখা যায়। কথিত আছে যে এটাই প্রথম অমূলদ সংখ্যার (এমন সংখ্যা যাকে দুটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হিসেবে লেখা যায় না) সাথে মানুষের পরিচয়। সংখ্যাটা হচ্ছে √২। এই সংখ্যাটার দশমিকের পরে কোন শেষ নেই, আবার কোন পুনরাবৃত্তিও নেই, ঠিক πএর মত। অতএব এটাকে পিথাগোরাসের মত করে লেখার কোন রাস্তা নেই। হেপাসাস যে এখানে থেমে গিয়েছিলেন তা নয়, উনি আরও একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন।
আপনি যে আজকে ধরুন একটা ফটো তুলিয়ে এলেন, ফটোগ্রাফার আপনাকে ফটো প্রিন্ট করে দিল। কখনও ভেবে দেখেছেন ফটোর দৈর্ঘ্য প্রস্থ কি হয়? আর কেনই বা সে ঐ মাপেই ফটো বানাল? মাপ করলেই দেখবেন দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের অনুপাত মোটামুটি ১.৬২। কেন? কারণ, সোনালী অনুপাত। এই সোনালী অনুপাত প্রকৃতির প্রায় সবজায়গায় ছড়িয়ে আছে; শামুক, মানুষ, গাছ, ফুলকপি, সূর্যমুখী সব জায়গায়। শুধু খুঁজতে হবে। সেই নিয়ে এখানে পরে লেখা আসবে। অনেকে বলেন আমরা এতোটাই সেই অনুপাত দেখতে অভ্যস্ত যে ঐ অনুপাতের জিনিস দেখলেই আমাদের ভালো লাগে, তাই ঐ অনুপাতে ফটো প্রিন্ট করা। কিন্তু, বাস্তবে এই অনুপাতটিও একটি অমূলদ সংখ্যা (১+√৫)/২। হেপাসাস একটি ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি করতে গিয়ে এই সংখ্যাটিও উপস্থাপনা করে ফেললেন। করবি তো কর, সেটা আবার জন সমক্ষে পিথাগোরাসকে বলেও ফেললেন। গোপনে বললে হয়ত পিথাগোরাস অতটা অফেন্স নিতেন না। কিন্তু, খোলাখুলি বলায় ঝামেলা বাড়ল।
এই অনুপাতটিও একটি অমূলদ সংখ্যা (১+√৫)/২।
পিথাগোরাস, বা তার অনুগামীরা তো খচে বোম। অন্যায় হয়েছে, শাস্তি হবে। এটা একটা চরম গর্হিত কাজ, ধর্মীয় পাপ। উপায় তবে কি? দেবতারা শাস্তি দেবেন। কি শাস্তি? না, হেপাসাসকে সমুদ্রে বিসর্জন দেওয়া হল। অনেকে আবার বলেন ওনাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। অনেকে বলে পিথাগোরাস নিজে এই শাস্তি দেন, অনেকে বলে এসব ‘পাপ’ কাজ হেপাসাস জাহাজে বসে করছিলেন, সেখানে পিথাগোরাসের অনুগামীরা মিলে তাঁকে জলে ফেলে দেয়। কিন্তু, হেপাসাসের যাই হয়ে থাক না কেন, কোন এক কারণে তার কাজগুলোর সেই গতি হল না। সেগুলো যেমন ছিল রয়ে গেলো, সর্বসমক্ষে। পিথাগোরাস বা তার অনুগামীরা হয়তো বুঝলেন কাজগুলোর কিছু একটা দরকার আছে। তাঁরা এই সংখ্যাগুলোকে প্রকাশ অযোগ্য তকমা দিয়ে এড়িয়ে গেলেন।
কিন্তু, গ্রীসের বিজ্ঞান দর্শন তখন পাল্টাতে শুরু করেছে। এসে গেছেন প্লেটো। তিনি হয়ে গেলেন হেপাসাসের গুণগ্রাহী। ব্যাপারটা এখানেই থামলো না। এরপরে এলেন থিওডোরাস। উনি প্রমান করে দিলেন শুধু √২ অমূলদ না, আরও আছে √৩, √৫, √১৭। উনি অমূলদ সংখ্যার গবেষণাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গেলেন। শেষে এলেন অ্যারিস্টটল। হেপাসাসের কাজে এতোটাই প্রভাবিত হলেন যে ওনাকে অগ্নির ধারক হিসেবে বর্ণনা করলেন। গ্রীসের ধারণা মতে বিশ্ব মোট চারটি মূল জিনিস দ্বারা তৈরি, অগ্নি তার একটি। অতএব শ্রদ্ধার পরিমাণটা অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়ই। তারপর এলেনে ইউক্লিড, সেই একই জিনিস। সবাই মিলে যেটা প্রমাণ করে ছাড়লেন সেটা হচ্ছে, শুধু মূলদ সংখ্যা দিয়ে হবে না, অমূলদ সংখ্যা পৃথিবীর একটা খুব অপরিহার্য অঙ্গ, প্রকাশ করা যায়না বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না। অগ্নির মতই তার প্রয়োজন আছে।
গ্রিসে ইউদক্সাস, ভারতে মানব, আর্যভট্ট।
কিন্তু, মজাটা হচ্ছে এর পরে পরেই অমূলদ সংখ্যার চর্চাটা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে। একদম যে মুছে যায় তা নয়, অনেকেই অল্পবিস্তর চর্চা করেন, যেমন গ্রিসে ইউদক্সাস, ভারতে মানব, আর্যভট্ট। পরবর্তী কালে বনিকদের হাত ধরে ভারত থেকে আরবেও অমূলদ সংখ্যা এসে পৌঁছয়। ঘনমূল, চতুর্মূল, এসবও নিয়ে আসা হয়। সেখানেও অমূলদ সংখ্যার ছড়াছড়ি। তবু কেমন যেন একটা স্তিমিত অবস্থা। সবশেষে প্রায় সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে অমূলদ সংখ্যার চর্চাটা বিরাট আকার ধারণ করে। একাধিক গণিতবিদ নেমে পড়েন সেই কাজে। দেখা যায় যে অমূলদ সংখ্যাও আবার দুরকমের হয়। করণী নিয়ে কাজ শুরু হয়। সেই সব চোখে পড়ে আয়েলারের, সেখান থেকে শুধু আরও আরও এগিয়ে যাওয়া।
হাঁটার আগেই, দৌড়তে শেখা।
যদিও সেই ইতিহাস বলতে গেলে আরও অনেক রকম সংখ্যার আসা দরকার। প্রথমত, এখনও মানুষ পূর্ণ সংখ্যারই পুরোটা জেনে উঠতে পারেনি, কিন্তু তার আগেই তারা ভগ্নাংশ, মূলদ সংখ্যা, অমূলদ সংখ্যা সবে হাতে খড়ি করে ফেলেছে। হাঁটার আগেই, দৌড়তে শেখা। সংখ্যার কোথায় শুরু, কোথায় শেষ তাই তারা এখনও জানে না। সেই নিয়ে আলোচনা করতে আমাদের পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে যেতে হবে, তবে সেটা পরের পর্বে হবে।
যাওয়ার আগে শেষ কথা, √২ যদি পৃথিবীর প্রথম আবিষ্কৃত অমূলদ সংখ্যা হয়, আর সেটা যদি হেপাসাস আবিষ্কার করে থাকেন, তাহলে √২-এর নাম কি হল? না, পিথাগোরাস ধ্রুবক!
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।