~ কলমে এলেবেলে প্রত্যয়~
আজকে কথা শুরুর আগে বলে নেওয়া ভাল যে আজ আর অঙ্কের কথা বেশী বলা হবে না। অল্প-স্বল্প হবে না তা নয়, কিন্তু আজকে যা নিয়ে কথা বলব তাকে অঙ্ক না বলে দর্শন বললে বেশী যুক্তিযুক্ত হবে। আপনি ভাবতেই পারেন প্রত্যয়ের নির্ঘাত মাথার ব্যামো হয়েছে, নয়ত এলেবেলের পাতায় আবার দর্শনের চর্চা কেন। আমি আপনাকে নিশ্চিন্ত করছি, শেষ পাওয়া খবর মত সে সব লক্ষণ এখন আর নাই। আমি এখানে ওখানে বহুবার বলেছি, বিজ্ঞানের সাথে দর্শনের এক অটুট যোগ আছে, একটাকে ছেড়ে আরেকটা নয়। আজ তারই কিছু নিদর্শন দেখাতেই আসা।
এযাবৎ আমরা সংসারের যেসব সংখ্যার উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলো হল পূর্ণসংখ্যা, ভগ্নাংশ, আর অমূলদ সংখ্যা। শেষবার আক্ষেপও করেছি যে এতো কিছু মানুষ জেনে গেলেও, তার শুরু আর শেষটা তখনও তাদের কাছে বেশ ধোঁয়াটে (ঋণাত্বক সংখ্যার কথা বলছি না)। অতএব, যা কিছু সঠিক জানা নেই সেখানেই মানুষ অবতারণা করে দর্শনের।
শেষ থেকে শুরু। অর্থাৎ, সংখ্যার শেষটা কোথায় সেটা নিয়েই আলোচনার শুরু। আমি করিনি, দর্শনে এভাবেই করেছে। শুরু যজুর্বেদে, বলা হল এমন একটা কিছুর কথা যার থেকে কিছুটা নিয়ে নিলে তার পরিবর্তন হয় না, আবার তাতে কিছু জুড়ে দিলেও তার কোন পরিবর্তন হয় না। অঙ্কের ভাষায় সেই ‘এমন একটা কিছু’-ই হল অসীম। তাতে এক যোগ করলেও তা অসীম, এক বিয়োগ করলেও তা অসীম। সমসাময়িককালে গ্রীসেও ওই একই দর্শনের কথা শোনা যেতে লাগল। গ্রিক দার্শনিক অ্যানেক্সাম্যানডার নিয়ে এলেন আপাইরনের ধারনা, এমন জিনিস যা সীমাহীন। এটা যে সময়ের কথা হচ্ছে, সেসময় পিথাগোরাস খ্যাতির চুড়ায়। তাঁর সমর্থকরা মনে করেন সংখ্যার মধ্যে একটা দৈব ব্যাপার আছে। ভগ্নাংশ সেই দৈবের অংশ। সেই কারণেই অমূলদ সংখ্যা দেখেই তাঁদের মটকা গরম হয়ে গেছিল, কারণ সেটা না পূর্ণ সংখ্যা, না ভগ্নাংশ। সে গল্প আগে বলেছি। যাই হোক, ঠিক এই সময় আপাইরনের উপস্থাপনা গ্রিকদের মধ্যে বেশ একটা সাড়া ফেলে দিল। পূর্ণসংখ্যা, তায় আবার সীমাহীন। তাতে দৈবক্ষমতার সীমাহীনতার আভাস পেল সকলে।
যদিও দৈবশক্তি আর সংখ্যা দুটোই অসীম, তাদের অসীমত্বের ভেতরে একটা মূল পার্থক্য আছে।
যদিও দৈবশক্তি আর সংখ্যা দুটোই অসীম, তাদের অসীমত্বের ভেতরে একটা মূল পার্থক্য আছে। সেটা উপলব্ধি করেন ভারতের জৈন গণিতজ্ঞরা। তাঁরা বলেন যে অসীম অনেক রকমের হতে পারে, দুটো জিনিস অসীম বলে তাদের একই ভাবার কোন কারণ নেই। তাঁরা সবার আগে গাণিতিক অসীম আর ধর্মীয় অসীমকে আলাদা করেন। তাঁরা বলেন অসীম মূলত তিন প্রকার — ১) এমন অসীম যা গোনা যায়, অর্থাৎ সংখ্যা। যেখানে ১, ২, ৩ করে করে আপনি যতদূর খুশি যেতে পারেন, কিন্তু একটা সসীম সময়ে আপনি সসীম অব্দিই যেতে পারবেন। ২) এমন অসীম যা এতো বড় যে গোনা যায় না, যেমন এক বস্তা চাল, আপনি জানেন ওতে সসীম সংখ্যক চালের দানা আছে, কিন্তু গুনতে অপারগ। ৩) আর, এমন জিনিস যা গোনাগুনির বাইরে, প্রকৃত অসীম, অর্থাৎ ঈশ্বর। এখানেই থামলেন না, তাঁরা আরও বললেন যে প্রথম দুই প্রকারের অসীম আবার তিন প্রকার, দৈর্ঘ্যে অসীম, ক্ষেত্রে অসীম, আর আয়তনে অসীম। এই তিন প্রকারের অসীম বস্তুত আলাদা। আমাদের সাদা মনে এটা মনে হতেই পারে, যা ক্ষেত্রে অসীম তা আয়তনেও নিশ্চয়ই অসীম, কিন্তু বাস্তবে তা যে সবসময় হবে তার মানে নেই।
এই তিন প্রকারের অসীম বস্তুত আলাদা।
অন্যদিকে এই সময়ে গ্রিকরা অসীমের ধারনাটা ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। জেনো অসীমকে নিয়ে আসছেন, কিন্তু যখনই তিনি তা নিয়ে ভাবছেন, তখনি তিনি কিছু অসঙ্গতির সম্মুখীন হয়ে যাচ্ছেন। উনি বললেন যে ধরা যাক খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় হচ্ছে। খরগোশ ভালো দৌড়বে, তাহলে কচ্ছপকে একটু আগে এগিয়ে যেতে দেওয়া হল, ধরলাম ১০ মিটার। এবার ধরলাম খরগোশ ১ সেকেন্ডে ১ মিটার যায়, আর কচ্ছপ ১ সেকেন্ডে ০.০১ মিটার যায়। এবার খরগোশকে ছেড়ে দিলে ১০ মিটার যেতে তার সময় লাগবে ১০ সেকেন্ড। কিন্তু, এই দশ সেকেন্ডে কচ্ছপ এগিয়ে গেলো আরও ০.১ মিটার। খরগোশের এই রাস্তা যেতে লাগবে ০.১ সেকেন্ড, কিন্তু সেই সময়ে কচ্ছপ আরও এগিয়ে যাবে ০.০০১ মিটার। খরগোশের সেটা পেরতে সময় লাগবে ০.০০১ সেকেন্ড, কিন্তু কচ্ছপ সেই সময়ে এগিয়ে যাবে ০.০০০০১ মিটার। অতএব কচ্ছপ সব সময় এগিয়েই থাকবে। জানিনা এই জাতীয় প্রতিযোগিতায় কচ্ছপ সবসময় জিতে কেন যায়? পরবর্তীকালে প্রমাণ করা সম্ভব হয় যে বাস্তবে জেনোর কিছু ভুল ছিল। সেই আলোচনা সম্পূর্ণ হতে কয়েক হাজার বছর লেগে যায়। তারমধ্যেই এসে পৌঁছন অ্যারিস্টটল। জৈন গণিতজ্ঞদের মত তিনিও বোঝেন যে গাণিতিক অসীম দু-রকমের হতে পারে — ১) কার্যত অসীম, আর, ২) যথার্থ অসীম। জেনোর কথা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে বাস্তব জগতে যথার্থ অসীমের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। যথার্থ অসীম থাকলেই স্থিতি-গতি সব উল্টোপালটা হয়ে যায়। তিনি তাই ধরে নিলেন যে কার্যত অসীমটিই ঠিক ভাবনা। এটা জৈন গণিতবিদদের গোনা যায় এমন অসীমের প্রায় সমতুল। বলে রাখা ভাল যে জেনো ও অ্যারিস্টটলের ধারনার মধ্যে মিল এবং অমিল দুই থাকলেও, দুজনের অসীমকে বোঝার মধ্যে কিছুটা অসম্পূর্ণতা ছিল। সেইগুলো সম্পূর্ণ দূর হতে প্রায় ২০০০ বছর লেগে যায়। এখনও পর্যন্ত কিন্তু ইউরোপে অসীমের সাথে দৈবের যোগটা থেকেই যাচ্ছে। তারা কিন্তু এখনও সংখ্যার অসীমকে দৈবশক্তির প্রকাশ হিসেবেই ভেবে আসছেন। ইতিমধ্যে যখন অসীম শ্রেণীর যোগের কথা আসছে তারা দেখেছে ১+১/২+১/৪+…=২, তারা ভাবছে এটা দৈবক্ষমতারই প্রকাশ। আগেই বলেছি পূর্ণসংখ্যা আর ভগ্নাংশকে তারা দৈব বলেই ধরত, এখন দেখছে পূর্ণসংখ্যা আর ভগ্নাংশ দিয়ে বানানো অসীম শ্রেণীর যোগফল দাঁড়াচ্ছে আরেকটা পূর্ণসংখ্যা।
সংখ্যা হল পরিমাণগত অসীম, আর ঈশ্বর হলেন গুনগত অসীম।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এসে টমাস অ্যাকয়েনাস প্রথম এই পার্থক্যটা করলেন। উনি বললেন সংখ্যা হল পরিমাণগত অসীম, আর ঈশ্বর হলেন গুনগত অসীম। উনি বললেন ঈশ্বর একমাত্র গুনগত অসীম, আর বাকি সব সসীম নয়ত পরিমাণগত অসীম। এখানেই ঈশ্বরের সাথে বাকি সবার তফাত। দর্শনের থেকে গণিতের অসীমের আলাদা হয়ে যাওয়াটা ঠিক এই জায়গাতেই। এখান থেকে আরও এগিয়ে গিয়ে বলা হল অসীম যখন একটা অতি বৃহৎ জিনিস, তাহলে নিশ্চয়ই বাকি যা কিছু সসীম তা ওই অসীমের মধ্যে আবদ্ধ। আবার কেউ বললেন ঈশ্বর যদি অসীম হন, তাহলে তাঁর ভেতরে খণ্ড থাকা সম্ভব নয়। সব খণ্ডই তবে ঈশ্বরের অংশ। আর আমরা সবাইকে মিলিয়ে দেখলে যা দেখতে পাই, তাকে আমরা প্রকৃতি বলে থাকি, অর্থাৎ প্রকৃতিই হল ঈশ্বর। এসব কথা দর্শনের। তবে এগুলোকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে গণিতের ব্যাবহারও হয়েছিল পুরো দমে।
জেনোর কথা আপনাকে কি এখনও ভাবাচ্ছে? ভুলটা এখানে ছিল যে উনি ভাবছিলেন যে এক্ষেত্রে অসীমটাকে কয়েকটা সসীম ভাগে ভাগ করা সম্ভব। আমি যদি ১+১/২+১/৪+ করে করে কোন একটা জায়গায় থেমে যাই তাহলে কিন্তু ২ পাব না, তার থেকে কমই পাবো। ২ পেতে গেলে আমাকে প্রকৃতপক্ষে অসীম সংখ্যক পদই যোগ করতে হবে। তার মানে এই নয় যে সেটা করতে হলে খরগোশ কে অসীম সময় অব্দি অসীম সময় অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। অসীম সংখ্যক পদের যোগফল সসীম হতেই পারে।
শেষটা বলে দিলাম। পরের পর্বে এবার শুরুটা বলব, মানে শূন্যটা।
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।