~ কলমে এলেবেলের অতিথি দেবাশীষ দাশগুপ্ত ~
জুনের গ্রীষ্মের দাবদাহ পেরিয়ে শুভাশিস ঢুকল মদনের চায়ের দোকানে একটু জিরিয়ে নিতে। একটানা কোবিড-জনিত লকডাউনের কারণে বাড়ীতে বসে বসে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। দেখল বদ্যি খুড়োকে ঘিরে চলছে তুমুল আড্ডা— অবশ্য শারীরিক দূরত্ব মেনে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে শুভাশিসের প্রশ্ন— “আচ্ছা খুড়ো এবারে কি বর্ষা নামবে না? গরমে গরমে তো জেরবার হয়ে গেলাম!” বদ্যিখুড়ো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আর একটা প্রশ্নের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন— “বলতো দেখি ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় খরা, পেরু ও ইকুয়েডরে অতি বৃষ্টি ও বন্যা এবং কানাডায় তুষার ঝড় এই ঘটনা গুলির মধ্যে মিল কোথায়?” প্রশ্নটা শুনে সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর বদ্যিখুড়ো মিটিমিটি হাসছেন। অন্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে বদ্যিখুড়োর জুড়ি নেই— আর এটাতে উনি বেশ আনন্দও পান।
সবাই যখন ভেবে ভেবে নাজেহাল তখন খুড়োর মন্তব্য— “তাহলে তোরা বলতে পারবি না বল! যে জন্য বিভিন্ন দেশে এই ঘটনাগুলো ঘটছে সেটার একটাই কারণ, এটাকে তোরা আবহাওয়ার বিশ্বায়নও বলতে পারিস।” সুবিমল বলে “ভণিতা ছেড়ে আসল কারণটা বলেই ফেলোনা খুড়ো!” খুড়োর সংক্ষিপ্ত উত্তর “এল্ নিনো”। এবারে অর্ণবের প্রশ্ন “কথাটা ঠিক বোধগম্য হ’লনা— তাছাড়া কথাটা ইংরেজিও নয়, কেমন একটা ল্যাটিন ল্যাটিন গন্ধ। একটু বুঝিয়ে বলবে কি?”
এই ‘এল্ নিনো’র জন্য দেশে মুদ্রাস্ফীতি নাকি বেড়ে যায় এবং অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব হয় মারাত্মক।
এবারে অমল ফোড়ন কাটে “হ্যাঁ, খবরের কাগজে সেদিন পড়লাম এই ‘এল্ নিনো’র জন্য দেশে মুদ্রাস্ফীতি নাকি বেড়ে যায় এবং অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব হয় মারাত্মক। আমাদের দেশের কৃষি যেহেতু বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল তাই সরকার এবং প্রশাসন ‘এল্ নিনো’র সতর্ক বার্তা থাকলে তার মোকাবিলার জন্য সব রকম আপৎকালীন ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।”
খুড়ো বললেন “কথাটা তুই ঠিকই বলেছিস। এবারে আমি অর্ণবের প্রশ্নটার উত্তর দিই”— বলে খুড়ো চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। “পেরুর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা আনুমানিক ১৬০০ খৃষ্টাব্দে প্রথম ‘এল্ নিনো’র প্রভাব অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারা লক্ষ্য করেছিল প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে সমুদ্রে মাছের সংখ্যা ভীষণ ভাবে কমে যায়। ফলে খালি জাল নিয়ে প্রতিদিন তাদের ফিরে আসতে হয় সমুদ্র থেকে৷ এই সময় পালিত হয় তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব খৃষ্টমাস বা বড়দিন৷ কিন্তু তাদের মুখের আনন্দের হাসি ঢেকে যায় দুশ্চিন্তার কালো মেঘে৷” অর্ণব খুড়োকে থামিয়ে প্রশ্ন করতে গেলে খুড়ো ইঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দেন৷ “তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস এর সঙ্গে এই ‘এল নিনো’র কী সম্পর্ক? বলছি শোন৷ ‘এল্ নিনো’ কথাটা স্প্যানিশ্— ল্যাটিন নয়৷ এর আক্ষরিক অর্থ শিশু পুত্র৷ আবার বৃহত্তর অর্থে ‘এল্ নিনো’র মানে শিশু যীশুখৃষ্ট৷ যেহেতু বড়দিনের সময় এই ঘটনা ঘটে তাই এর নামকরণ হয়েছে ‘এল্ নিনো’।”
‘এল্ নিনো’ কথাটা স্প্যানিশ্— ল্যাটিন নয়৷ এর আক্ষরিক অর্থ শিশু পুত্র৷
অর্ণবের প্রশ্ন— “কিন্তু এর সঙ্গে সমুদ্রে মাছের ঘাটতির কি সম্পর্ক?” “বলছি শোন” বলে খুড়ো চায়ের কাপে এক দীর্ঘ চুমুক দেন৷ “সত্যি মদন কিন্তু চা’ টা ভালই করে৷ তাই এ তল্লাটে এত দোকান থাকলেও সবাই এখানে এসেই ভীড় করে৷” খুড়ো দেখলেন সবারই আগ্রহ অন্য দিকে— প্রসঙ্গান্তরে যাবার কারো কোন ইচ্ছা নেই৷ তাই অগত্যা আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যান৷ “দক্ষিণ আমেরিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের তটবর্তী এলাকায় সমুদ্রের উপরিপৃষ্ঠের জলতলের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটলে জলজ উদ্ভিদ অর্থাৎ মাছের খাদ্যের বিরাট ঘাটতি দেখা যায়৷ তখন মাছের ঝাঁক খাদ্যের খোঁজে অন্যত্র সরে পড়ে, ফলে জেলেদের কপালে ভাঁজ পড়ে৷ এছাড়া সমুদ্রের উপরিভাগে জলতলের তাপমাত্রার বৃদ্ধির জন্য বেশি বাষ্পীভবন হয়, ফলে ওই অঞ্চলে বৃষ্টি বেশি হয় এবং ওই মেঘ দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়— আবার পৃথিবীর অন্য অংশে তা খরার সৃষ্টি করে।
১৯৮২ এবং ১৯৯৭ সালের ‘এল্ নিনো’ ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এইসময় পূর্ব ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা সাধারণের থেকে প্রায় ৩-৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যায়। যার ফলে অস্ট্রেলিয়ায় প্রচন্ড খরা হয়, তাহিতি টাইফুনের কবলে পড়ে, চিলিতে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত ও বন্যা হয়, এবং উত্তর আমেরিকায় শীতকালে প্রচন্ড ঝড় ঝঞ্ঝা হয়। শুধু প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নয়, এর প্রভাবে ভারতে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতেও মৌসুমি বায়ু খুব দুর্বল ছিল এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গিয়েছিল।
এবারে যদি ঘটনাটা উল্টো ঘটে তাহলে কি হবে? অর্থাৎ এই অঞ্চলের সমুদ্রের উপরিভাগের জলতলের তাপমাত্রা যদি স্বাভাবিকের থেকে কমে যায় তাহলেও বিশ্বের আবহাওয়ার বড়সড় পরিবর্তন ঘটবে৷ এর প্রভাবে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে হতে পারে প্রবল বর্ষণ এবং বন্যা— যেমনটা ঘটেছিল অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে ২০১০-১১ সালে৷ যেহেতু এর প্রভাব ‘এল্ নিনো’র বিপরীত, তাই এর নাম ‘লা নিনা’ যার বাংলা অর্থ শিশু কন্যা৷”
সুবিমল এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল— এবারে বদ্যিখুড়োকে জিজ্ঞাসা করে “আচ্ছা খুড়ো, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এইরকম আবহমণ্ডলের যে পরিবর্তন ঘটে তার কারণটা কি?” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খুড়ো উত্তর দেন “তোরা ‘ট্রেড উইন্ড’ অর্থাৎ বাণিজ্য বায়ুপ্রবাহের কথাটা বইতে পড়েছিস নিশ্চয়ই স্কুলে থাকতে৷ এই বায়ুপ্রবাহের উপর ভর করেই ইয়োরোপ থেকে দুঃসাহসিক নাবিকেরা পাল তোলা জাহাজ নিয়ে দীর্ঘদিনের সমুদ্রযাত্রা শেষে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা হয়ে ভারতে পৌঁছেছিল, ব্যবসা বাণিজ্য এবং সেই সঙ্গে দেশ দখলের অভিপ্রায়ে, একথা তোরা ইতিহাসের বইতে পড়েছিস নিশ্চয়ই। কোনো কোনো বছরের শরতকালে এবং শীতকালে এই বাতাস স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দুর্বল থাকে। তখন এই বায়ুপ্রবাহ অক্টোবরে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে প্রবাহিত হয়। যার ফলে সমুদ্রের উপরিপৃষ্ঠের উষ্ণ জলরাশি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে ধাবিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি যে, ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রপৃষ্ঠ ইকুয়েডরের তুলনায় প্রায় দেড় ফুট উঁচুতে উঠে যায়।”
নিচের চিত্রটি থেকে বোঝা যাবে, যে বছরে ‘এল্ নিনো’র প্রভাব পরিরক্ষিত হয় সে বছরে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত বাণিজ্য বায়ুপ্রবাহ অনেক দুর্বল বা স্তিমিত থাকে এবং উষ্ণ জলরাশি নিরক্ষীয় দক্ষিণ আমেরিকার তটভূমি অঞ্চল বরাবর সক্রিয় থাকে।
অপরপক্ষে, যে বছরে ‘এল্ নিনো’র প্রভাব দুর্বল থাকে সে বছরে নিরক্ষরেখা বরাবর প্রবল বাতাস দক্ষিণ আমেরিকার কাছাকাছি উষ্ণ পৃষ্ঠের জলকে পশ্চিম দিকে ইন্দোনেশিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। এই বায়ুপ্রবাহ প্রবল হলে ‘লা নিনা’র অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহে ভর করে যখন উষ্ণ জলের স্রোত পশ্চিম দিকে চলতে থাকে তখন সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে দক্ষিণ আমেরিকার এই তটবর্তী এলাকায় সমুদ্রের তলদেশ থেকে ঠান্ডা জলের স্রোত উপরের দিকে উঠে আসে৷ তার ফলে মাছের খাদ্যের কোন অভাব হয় না এবং জেলেদের জালে ধরা পড়ে প্রচুর টুনা, স্যালমন্ এবং সার্ডিন মাছের ঝাঁক৷
খুড়ো একটু থেমে আবার শুরু করলেন “প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল জলরাশি পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের তুলনায় এই নিরক্ষীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সূর্যালোক পায়, যার বেশিরভাগটাই সমুদ্রের জলে তাপশক্তি হিসেবে সঞ্চিত থাকে৷ এই তাপশক্তি কতটা তার একটা ধারণা করতে পারবি একটা উদাহরণ দিলে— মোটামুটি ১০ লক্ষটা এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা-সম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলতে পারে এই তাপশক্তিতে৷ কাজেই এর ক্ষমতা যে প্রবল সেটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছিস তোরা৷ জলের তাপমাত্রা এবং বাণিজ্য বায়ুপ্রবাহের তারতম্য একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ‘এল্ নিনো’ বা ‘লা নিনা’র অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আবহাওয়ার বিরাট পরিবর্তন ঘটায়৷ তবে এর সঙ্গে ‘গ্লোবাল ওয়ারমিং’ বা বিশ্ব উষ্ণায়ণের কোন সম্পর্ক নেই৷ শুধু এই উষ্ণায়ণ ‘এল্ নিনো’কে ত্বরান্বিত করতে পারে বা তার শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে”।
“আচ্ছা খুড়ো এই ‘এল্ নিনো’র জন্য শুধু প্রশান্ত মহাসাগরই কেন দায়ী? ভারতমহাসাগর অথবা অ্যাটলান্টিকেও তো অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে?”
সুবিমলের প্রশ্ন “আচ্ছা খুড়ো এই ‘এল্ নিনো’র জন্য শুধু প্রশান্ত মহাসাগরই কেন দায়ী? ভারতমহাসাগর অথবা অ্যাটলান্টিকেও তো অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে?” খুড়ো বলেন, “এতক্ষণে তুই একটা ভাল প্রশ্ন করেছিস৷ দ্যাখ, প্রশান্ত মহাসাগরের মত আর কোনও মহাসাগরের ব্যাপ্তি এত বিশাল নয়৷ ভারতমহাসাগর এবং অ্যাটলান্টিক এর তুলনায় অনেকটা সংকীর্ণ এবং স্থলভূমির দ্বারা প্রভাবিত৷ ভারত মহাসাগরে প্রবাহিত মৌসুমীবায়ু ওই অঞ্চলের আবহাওয়াকে পরিচালিত করে৷ সূর্যের উত্তরায়ণ এবং দক্ষিনায়ণের কারণে আশেপাশের স্থলভূমি গ্রীষ্মে গরম এবং শীতে ঠান্ডা হয়৷ এই জল ও স্থলের তাপমাত্রার তারতম্য এখানকার আঞ্চলিক আবহাওয়ার নিয়ামক৷”
শুভাশিস এবারে প্রশ্ন করে, “সবই যদি প্রকৃতির খেয়ালে হয় তবে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা কী করে এর আগাম আভাস দেন?” খুড়োর উত্তর “কথাটা ঠিকই বলেছিস। ‘এল্ নিনো’র পরিস্থিতি কখন সৃষ্টি হবে তার আগাম আভাস দেওয়া খুবই শক্ত। তাছাড়া আবহাওয়ার উপর প্রতিটি ‘এল্ নিনো’র যে একই রকম প্রভাব হবে তারও কোনও স্থিরতা নেই। যেহেতু ‘এল নিনো’ মোটামুটি ৩ থেকে ৫ বছরের ব্যবধানে ঘটে তাই এ সম্বন্ধে আমাদের হাতে তথ্যও অনেক কম। দ্যাখ আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের একটা বদনাম আছে যে আজকে বৃষ্টি হবে না বললে লোকে ছাতা নিয়ে বার হয়। তবে আধুনিক যুগে উপগ্রহ এবং উচ্চ ক্ষমতা-সম্পন্ন কম্প্যুটার ব্যবহার করে জলের উষ্ণতা, চাপের তারতম্য এবং অন্যান্য বহু তথ্যের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে গাণিতিক মডেলের সাহায্যে বিশেষ ভাবে বিশ্লেষণ করে এখন অনেকটাই সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে।“
খুড়োর কথা শেষ হতে না হতেই আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। মূহূর্তের মধ্যে সভা ভঙ্গ— কোনোরকমে মাথা বাঁচিয়ে যে যার বাড়ির দিকে দৌড়।
চিত্রসুত্র-AndyHM, CC BY-SA 4.0 <https://creativecommons.org/licenses/by-sa/4.0>, via Wikimedia Commons
দেবাশীষ একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রযুক্তিবিদ।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
এলেবেলে – Elebele