~ কলমে অরিত্র দাস ~
দাগ আসলে ভালোই জিনিস। একটা বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞাপন। বাচ্চাদের জামায় দাগ লাগা মানে তারা প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত। তারা শৈশবকে উপভোগ করছে, এরকমই একটা সুন্দর মুহুর্ত তৈরি করে বিজ্ঞাপনটি। যদিও মূল উদ্দেশ্য তাদের ডিটারজেন্ট বিপণন, কিন্তু সেটা আবার আমার কাছে গৌণ।
লেখাটার উদ্দেশ্যই হল কিছু দাগকে সন্মান দেওয়া। যে সে দাগ নয়, এ দাগ না থাকলে পৃথিবীর উষ্ণতা কমে গিয়ে বরফ যুগও চলে আসতে পারে। ভাবছেন কি যা তা বলছি!
তাহলে উদাহরণ দেওয়া যাক। এডওয়ার্ড মাউন্ডার ও এনি মাউন্ডার নামের এক ব্রিটিশ দম্পতি ১৮৯০ সালের আশেপাশে একাধিক বৈজ্ঞানিক পেপার প্রকাশ করে জানালেন, প্রায় ২০০ বছর (১৬৪৫–১৭১৫) আগে থেকে ইউরোপের তাপমাত্রা যে কমে গিয়ে ছোট বরফ যুগ এসেছে তার পিছনে নাকি ওই দাগের অবদান আছে। অবদান মানে, ওই সময়ে ওই দাগ নাকি না থাকার মতনই ছিল। তাতেই বিপত্তি। যাই হোক, কেন ওই ছোট বরফ যুগ তা নিয়ে এখনো বৈজ্ঞানিক মহলে মতানৈক্য থাকলেও উপরের কারণটি সব থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য। এতটাই যে ওই সময়কালকে এখন মাউন্ডার মিনিমাম বলা হয়ে থাকে।
তারপর ধরুন জন ডালটন। বিজ্ঞানের জগতের এক মহীরুহ। তার পরমাণুবাদ সম্পর্কে আমরা সবাই প্রায় ওয়াকিবহাল। উনিও এই দাগ সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। উনার জীবিতকালে অর্থাৎ১৭৯০ থেকে ১৮৩০ এর মাঝে এই দাগ কমে গেছিল। মাউন্ডার মিনিমাম-এর মতন না হলেও স্বাভাবিকের থেকে কম। ইউরোপের তাপমাত্রা সেই সময়ও অস্বাভাবিক ভাবেই কম ছিল। উনার নামে ওই সময়কালের নাম এখন ডালটন মিনিমাম।
ও হ্যাঁ যেটা বলা হয়নি, দাগটার পোশাকি নাম সৌর-কলঙ্ক।
ছবি উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত (CC BY-SA 3.0, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=969067)
চাঁদের গায়ে যেরকম দাগ আছে, আমাদের একমাত্র নক্ষত্র সূর্যের গায়েও দাগ আছে। তবে দুটোর চরিত্র ভীষণ আলাদা। চাঁদের দাগ মোটামুটি চন্দ্রপৃষ্ঠে, আর তা স্থায়ী। সূর্যের দাগ তেমন নয়। সৌরকলঙ্কর স্থায়িত্ব মিনিট থেকে শুরু করে কয়েক দিন অবধিও যেতে পারে। আকারের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, একটা ছোট সৌরকলঙ্কও সাধারণত পৃথিবীর আকারের হয়ে থাকে। আর চাঁদ তো নিজেই পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ। চন্দ্রকলঙ্ক তাই খুব বেশি হলে একটা পাড়া হতে পারে। আসলে চাঁদের গায়ের দাগগুলো হল সেখানে থাকা পাহাড় পর্বত খাদ। এগুলোতে আলো পড়লে তা দৃশ্যমান হয়। আমরা পৃথিবী থেকে তাই দেখতে পাই। চাঁদে বায়ুমণ্ডল না থাকার জন্য এইগুলো খালি চোখেই আমাদের কাছে দৃশ্যমান, কিন্তু সূর্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা।
সূর্যের এই দাগ আসে ভিতর থেকে। সূর্য আসলে একটা গ্যাসীয় গোলক যে তার নিজের অক্ষের উপর পাক খায়। প্রতিনিয়ত সে ভিতর থেকে হাইড্রোজেনকে হিলিয়াম ও অন্যান্য ভারী মৌলে রূপান্তর করছে এবং তাঁর সাথে প্রচন্ড তাপ উৎপন্ন করছে। গ্যাসীয় হওয়ার ফলে এবং কঠিন না হওয়ার ফলে সূর্যের এই নিজের চারদিকে পাক খাওয়ার সময়টা বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন হয়, মানে সূর্যের পেট নিজের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে ২৪ দিনের কাছাকাছি সময় নেয়, কিন্তু সূর্যের মাথা ও পা নিজেদের চারদিকে একবার ঘুরতে প্রায় ৩০ দিন সময় নেয়। বিজ্ঞানের ভাষায় এটা হল ডিফারেন্সিয়াল ঘূর্ণন। কঠিন হওয়ার ফলে সমগ্র পৃথিবীর নিজের চারদিকে ঘুরতে আলাদা আলাদা সময় লাগে না। এক দিনেই সে নিজের চারদিকে ঘুরে আসে।
সূর্যের এই হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামে রূপান্তর প্রক্রিয়াতে সূর্যের ভিতর কিছু ‘চৌম্বকক্ষেত্র রেখা’ তৈরি হয়, যা উত্তর-দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর একটা সরলরেখায় তৈরি হয়। ডিফারেন্সিয়াল ঘূর্ণন-এর জন্য এই ‘চৌম্বকক্ষেত্র রেখা’গুলো আর সরলরেখা থাকতে পারে না। একটা ইলাস্টিককে দু’প্রান্ত আটকে রেখে জোরে ঘোরালে সেটার পেটের কাছটা স্ফীত হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। এই বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য যে বল ঐ ইলাস্টিকে তৈরি হয় তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় অপকেন্দ্র বল বা centrifugal ফোর্স বলে। এক্ষেত্রেও তাই হয়, চৌম্বক রেখাগুলো বেঁকে গিয়ে সৌরপৃষ্ঠ ছেদ করে বেরিয়ে যায়, কিন্তু যেহেতু সৌরপৃষ্ঠ কোন কঠিন বস্তু না, একটি গ্যাসীয় অবস্থা, তাই আবার ঢুকেও যায়, কিন্তু এই ঢোকা বেরনোর রাস্তাটা দৃশ্যমান হয়ে সৌরপৃষ্ঠে দাগ তৈরি করে। এই দাগের অস্তিত্ব এক মিনিট থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত হতে পারে, যা চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তির উপর নির্ভর করে। সৌরকলঙ্ক দেখতে পাওয়া মানে ধরে নেওয়া হয় সূর্য প্রাণবন্ত আছে।
সৌর-কলঙ্ক তারিখ-১৭/১২/২০২১, ছবি-লেখক
ছবি-Addison Wesley
সৌরকলঙ্ককে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ বছর ধরে নিয়মিত নথিভুক্ত করা হয়ে চলেছে। সৌরকলঙ্ক-এর সাধারণত ১১ বছরের এক একটা চক্র হয়ে থাকে। এই ১১ বছরের শুরুতে সৌর-কলঙ্ক-এর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে, সাধারনত এক এক দিন ১০০ টা অবধিও সৌর-কলঙ্ক দেখা যেতে পারে। ১১ বছরের শেষের দিকে বেশিরভাগ দিনই সৌর-কলঙ্ক দেখা যায় না। নথিভুক্ত শুরু করার সময় অনুযায়ী এখন ২৫ তম সৌর-চক্র চলছে।
ছবি: https://phys.org/news/2018-12-scientists-imminent-sun-cooling-climate.html
বিশেষ সতর্কীকরণ: খালি চোখে সূর্য দেখার চেষ্টা চোখের স্থায়ী ক্ষতি করে। তাই খালি চোখে সূর্য দেখার চেষ্টা না করাই উচিত। নিয়মিত সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষকরা বিশেষ ভাবে প্রস্তুত ফিল্টার ব্যবহার করে সূর্য পর্যবেক্ষণ করে।
—————————————————-
লেখক পরিচিতি: এলেবেলের অতিথি অরিত্র দাস (https://www.aritra.space)
সৌরকলঙ্ক ও পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষক: আমেরিকান অ্যাশোসিয়েসন অফ ভেরিয়াবেল স্টার অবজারভারস,
প্রতিষ্ঠাতা: জিওরদানো ব্রুনো অবজারভেটরী, কাঁচরাপাড়া।
পেশায়: বরিষ্ঠ বিভাগীয় প্রকৌশলী (যান্ত্রিক), পূর্ব রেলওয়ে কারখানা, কাঁচরাপাড়া।