কলমে এলেবেলে প্রত্যয়
(যাঁরা পর্ব – ১ পড়েননি, তাঁদের কাছে অনুরোধ এই লিঙ্কে গিয়ে একবার পড়ে নিন। তাহলে পরের কাহিনী বুঝতে পরবেন।)
নিশ্চয়ই এখনও অব্দি নামকরনের সার্থকতা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। হ্যাঁ, এবার সেটাই বলবো। তার আগে বলুন দেখি, আদায় কাঁচকলায় মিল কোথায়? আচ্ছা, আদা, কাঁচকলা আর ফুটবলেরই বা মিল কোথায় ? বা ধরুন, চায়ের কাপ আর সাইকেলের টিউব কিভাবে এক? আবার, চায়ের কাপ আর জলের গ্লাস কেন আলাদা? একি সুকুমার রায়ের লেখা? “”বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার।” এসবের উত্তর গণিতের যে শাখায় পাওয়া যায় তার নাম আকৃতিবিদ্যা (ইংরেজি নাম টোপোলজি, কোন বাংলা পরিভাষা না খুঁজে পেয়ে আমরা নিজেরাই একটা পরিভাষা বানালাম। এরকম আরও কিছু আমাদের বানানো পরিভাষা এই লিঙ্কে পেয়ে যাবেন)। খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে এটি হল আকৃতির জ্যামিতিক অধ্যয়ন। হিসেব মতো এটি জ্যামিতির আধুনিকতম বিভাগ। কিভাবে এক জ্যামিতিক আকৃতিকে আরেক জ্যামিতিক আকৃতিতে রূপান্তরিত করা যায়, এ তারই কথা বলে।
স্কুলের অঙ্কের বই থেকে আমরা বেশ কিছু জ্যামিতিক আকৃতির সাথে সুপরিচিত। বৃত্ত, ত্রিভুজ, আয়তক্ষেত্র, ইত্যাদি। এই জ্যামিতিগুলির একটি নাম আছে। ইউক্লিডীয় জ্যামিতি। ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে যেকোনো জ্যামিতিক আকৃতিকে যেকোনো দিকে সরানো যায়, ঘোরানো যায়, আর আয়না দিয়ে প্রতিফলন করানো যায় (চিত্র ১ দেখুন)। আসলে যে জ্যামিতিক আকারই আঁকি তার বাহুর দৈর্ঘ্যগুলোতো আর দুমদাম পাল্টে দেওয়া যায় না। বৃত্তের ক্ষেত্রে পরিসীমাও তাই। আসল কথা হল আকৃতিটিকে কোন মতেই পালটানো যায়না। যাই করি না কেন, ত্রিভুজ ত্রিভুজই থেকে যায়, বৃত্ত বৃত্তই থেকে যায়। ত্রিভুজ কখনোই বৃত্ত হয়ে যেতে পারে না। এদের প্রত্যেকটি আকৃতিই দৃঢ়, অনমনীয়।
বাস্তবে না হয় নাই করলাম, কিন্তু অঙ্কের খাতায় তো করতে পারি। ভাবলাম আমার ত্রিভুজের বাহুগুলি রাবার ব্যান্ড দিয়ে তৈরি। এবার আর কোন অসুবিধে নেই। এবার রাবার ব্যান্ড কে টেনেটুনে বৃত্তের মতো আকৃতি দিলেই হল। যেমন করলাম চিত্র ২-এ। আপনি চাইলেই একই ভাবে ত্রিভুজ থেকে বৃত্ত, বৃত্ত থেকে বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্র যা খুশি বানান। কোন বাধা নেই। না, বাধা একটা আছে। সেটা বুঝতে চিত্র ৩ দেখুন। যদি আপনার কাছে এই বাংলা ৪ এর মতো দেখতে একটা রাবার ব্যান্ড থাকে, তবে সেখান থেকে বৃত্ত, ত্রিভুজ, আয়তক্ষেত্র কিছুই বানাতে পারবেন না। কারণ সেক্ষেত্রে আপনাকে ওর মাঝের জোড়া লেগে থাকা অংশটাকে ছিঁড়তে হবে। ছেঁড়াছিঁড়ি এখানে চলবে না। অতএব বুঝতেই পারছেন যে ত্রিভুজ, বৃত্ত, বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্র এসব এক শ্রেণীতে পড়ে। সেই শ্রেণীতে সব আকৃতির শুধু একটি ফুটো। মানে একটা সাধারণ রাবার ব্যান্ড যার মাঝখানে একটাই খালি জায়গা। ‘৪’ আকৃতিটা আলাদা, কারণ এর মাঝে একটা নয় দুটো খালি জায়গা, অর্থাৎ দুটো ফুটো। এবার এই দুটো ফুটোকে একটা ফুটো করতে গেলে মাঝখান থেকে ছিঁড়তে হবে। সেটা করা যাবে না। অতএব দুই ফুটোওয়ালা আকৃতি সব সম্পূর্ণ আলাদা একটা শ্রেণী। এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীতে যাওয়া সম্ভব নয়। দুইটি শ্রেণী আকৃতিগত ভাবে সম্পূর্ণ আলাদা।
তা দ্বিমাত্রিক আকারের কথা তো না হয় বোঝা গেলো। তিন মাত্রায়, যে সব জিনিস আমরা রোজকার দিনে দেখি, সেখানেও কি এই ফুটোর হিসেব? হ্যাঁ, একদমই তাই। তবে এবার আর রাবার ব্যান্ড না, ধরুন সবকিছুই রাবারের চাদর দিয়ে বানানো। এই বারে ভাবুন প্লেট, বাটি, আর গ্লাস। এর তিনটেতেই কোন ফুটো নেই। ফুটো থাকাটাও সঙ্গত নয়। নয়তো জল ঝোল সব পড়ে গিয়ে একসা হবে। অতএব প্লেট, বাটি, আর গ্লাস যদি রাবারের তৈরি হতো তো খুব সহজেই আপনি একটিকে বেঁকিয়ে, টেনে অন্যটি করে দিতে পারতেন। ঠিক যেমন করেছি চিত্র ৪-এ। আদা আর কাঁচকলাও ঐ একই ভাবে এক। দুটোতেই কোনও ফুটো নেই।
এবার ফুটোওয়ালা কিছু একটা ভাবা যাক। ধরা যাক চায়ের কাপ। এর একটি ফুটো। ওই হাতলটায়। যেটা দিয়ে আঙ্গুল গলে। সেই একই ভাবে টানতে হিঁচড়াতে থাকুন। পেয়ে গেলেন সাইকেলের টিউব (চিত্র ৫ দেখুন)। এবার বস্তুত, আপনি দেখতেই পেলেন কিভাবে জলের গ্লাস আর কাঁচের প্লেট এক, কিন্তু সেগুলো চায়ের কাপের থেকে আলাদা। দেখতে হবে ‘ফুটোস্কোপ’ দিয়ে। বুঝতে হবে কিসে কটা ফুটো।
কিন্তু, এর সাথে পর্ব ১ এর ধাঁধা বা অয়লারের যোগটা কোথায়? আপনি যদি ওই ধাঁধায় ফিরে যান আর অয়লারের সমাধান (বা সমাধান যে সম্ভব নয় সেটা) দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে A, B, C, ও D ভূখণ্ডও গুলি যে কতো বড়ো, বা তার ঠিক কোন জায়গাতে সেতু গুলি আছে (চিত্র ৬ দ্রষ্টব্য) তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল বিষয় হল কটা ভূখণ্ড আছে আর প্রত্যেকটা ভূখণ্ড থেকে বেরবার কটা পথ আছে। আমরা চাইলেই ভূখণ্ডগুলোকে একটা একটা বিন্দু দিয়ে দেখাতে পারি, আর সেতুগুলিকে দুটি ভূখণ্ডের সংযোগী রেখা দিয়ে দেখাতে পারি (আবার চিত্র ৬ দ্রষ্টব্য)। তাতে মূল সমস্যা বা তার সমাধানের কোনও পরিবর্তন হয় না। শুধু সমস্যার ভাষাটা একটু পাল্টে যায়। এই পদ্ধতিতে করা সমাধান আজকের গণিতের ভাষায় গ্রাফ তত্বের অন্তর্গত। অয়লার যা আবিষ্কার করেছিলেন, যে নিয়ম বা সূত্রগুলো আমরাও আগের পর্বে বের করেছি, সেগুলো হচ্ছে গ্রাফ তত্বের প্রথম সূত্রাবলী। এর সাথে আমাদের সদ্য আলোচিত বাটি, গ্লাস, সাইকেলের টিউবের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। তবে, ঐ যে বলেছিলাম এই ধাঁধা থেকে গণিতের দুটো ধারার জন্ম, এটা তার একটা। তবে, অন্যটাই আজ আমাদের মূল আলোচ্য।
কোনও স্থানের জ্যামিতি কেবল তার মাপের মধ্যে বা দৃঢ় আকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়
অয়লারের এই বোধ যে ভূখণ্ডগুলোর আকার আকৃতিগুলো যে কেবল বাহ্যিক, তাঁদের ঠিক কোন জায়গায় সেতু আছে সেটা যে গুরুত্বহীন, এটাই জন্ম দেয় আকৃতিবিদ্যা (টোপোলজি)। উনি দেখিয়ে দেন যে কোনও স্থানের জ্যামিতি কেবল তার মাপের মধ্যে বা দৃঢ় আকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তার থেকে অনেক বেশী কিছু। এই ভাবনা কেবল গণিত নয়, দর্শনের দিক থেকেও এক বিরাট অগ্রগতি।
এই কাজ প্রকাশের আরও প্রায় দশ বছর পর অয়লার আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন যা আজকের আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক। উনি দেখান যে যেকোনো ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক আকার, যার প্রত্যেকটি পৃষ্ঠতল সমতল, তার শীর্ষের সংখ্যা, বাহুর সংখ্যা, আর পৃষ্ঠতলের সংখ্যার মধ্যে একটা খুব সহজ সম্পর্ক আছে। সেটি হল শীর্ষের সংখ্যা – বাহুর সংখ্যা + পৃষ্ঠতলের সংখ্যা = ২। সে আকারে বড়ো হোক বা ছোট। সামনে যা ত্রিমাত্রিক আকৃতি পাচ্ছেন তাতেই পরীক্ষা করে দেখুন। মিলে যাবে। আমার হাতে শিঙাড়া (যদিও তার সব পৃষ্ঠতল একদম সমতল নয়), আমি সেটা নিয়েই দেখছি। শিঙাড়ার মোট শীর্ষের সংখ্যা ৪, বাহুর সংখ্যা ৬, আর তলের সংখ্যা ৪। অতএব, ৪ – ৬ + ৪ = ২। মিলে গেলো হিসাব। বিদগ্ধজনে মনে করেন এটাই আকৃতিবিদ্যার প্রথম সূত্র। এরপর অনেকেই এই বিষয়ে কাজ করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলেন অঁরি পঁকারে (উচ্চারণে একটু হয়তো ভুল হল, মাফ করবেন)। আয়লার যদি আকৃতিবিদ্যার জনক হয়ে থাকেন, তবে পঁকারে হলেন আকৃতিবিদ্যার সেই ছোটবেলার অতি বদমাশ বন্ধু, যার হাত ধরে আকৃতিবিদ্যার সব বাঁদরামিতে হাতে খড়ি।
শীর্ষের সংখ্যা – বাহুর সংখ্যা + পৃষ্ঠতলের সংখ্যা = ২।
যাই হোক। আকৃতিবিদ্যার একটা খুব গুরত্বপূর্ণ দিক হল এই পদ্ধতির সাথে দৈনন্দিন ঘটনা বা সমস্যার যোগাযোগ। যেমন আগের দিনের আমাদের সেতুর সমস্যাটি। এই কারণেই আজকের দিনে এই আকৃতিবিদ্যা শুধু গনিতের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে যায়নি। তার অবাধ বিচরণ পদার্থবিদ্যায়, জীববিদ্যায়, কম্পিউটারে, রোবটে, সোশাল নেটওয়ারকিংএ, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। পাঠককে বেশী তথ্যে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। তবে, আকৃতিবিদ্যার দু-একটি দৈনন্দিন ব্যবহার না বললেই নয়। খনিতে, বা কলকারখানায়, বা এয়ারপোর্টে কনভেয়ার বেল্ট অনেকেই দেখে থাকবেন। এই বেল্ট অনেকটা সাইকেলের চেনের মতো কাজ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কেবল একটি তলই সবসময় মেশিনের সাথে (মানে গিয়ারের সাথে) বারবার ঘসা লাগত। ফলে টিকত না বেশিদিন, দু দিনেই ছিঁড়ে যেত। এর সমাধান করা হল বেল্টটাকে খুলে আধা প্যাঁচ দিয়ে আবার জুড়ে দিয়ে। আকৃতিবিদ্যার ভাষায় বলে মোএবিয়াস স্ট্রিপ (Möbius strip)। এতে বেল্টের দুটি তলই সমান ভাবে মেশিনের সংস্পর্শে এলো, টিকল বেশী দিন। এই একই মোএবিয়াস স্ট্রিপ টাইপরাইটারের/প্রিন্টারের কালির রিবনেও ব্যবহার হয়, যাতে রিবন কে দুদিক থেকেই ব্যবহার করা যায়।
শেষ করার আগে অয়লার সম্পর্কে দু-একটা কথা না বললে একদমই চলছে না। অয়লার তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় ৫০০ বই আর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর আরও প্রায় ৪০০০ লেখা প্রকাশিত হয়। বুঝতেই পারছেন ওনার মতো প্রভাবশালী গনিতবিদ এই পৃথিবীতে খুব কমই জন্মেছেন। অয়লারকে নিয়ে, তাঁর আবিষ্কারগুলোকে নিয়ে কথা বলতে গেলে তা একটা বা দুটো প্রবন্ধে করা সম্ভব নয়। আমি ওনার একটা আবিষ্কারকে নিজের মতো করে পাঠকদের কাছে তুলে ধরবার ধৃষ্টতা করলাম মাত্র। ওনার বাকি আরও কিছু আবিষ্কার নিয়ে পরে আবার ফিরে আসতেই হবে। বিশেষ করে ঐ ‘সব থেকে সুন্দর সমীকরণ’-টা। বিদায় নেবার আগে শুধু একটা ছোট তথ্য দিয়ে চলে যাই, আজ ডান চোখে আবছা দেখাটাকে অয়লার মনের ভুল ভাবলেন (পর্ব ১ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু আর দুবছরের মধ্যেই উনি ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারাবেন (১৭৩৮)। অনেকে পেছনে মজা করে ওনাকে সাইক্লপস (গ্রীক পুরাণের এক চোখা দৈত্য) বলে ডাকতে শুরু করবে।
এলেবেলের দলবল
“