কলমে এলেবেলে মেঘদীপা
![](https://elebele.org/wp-content/uploads/2024/04/Picture13-2.jpg)
সেটা ছিল ১৯৬৪ সাল আর জায়গাটা হল বেল টেলিফোন ল্যাবোরেটরী। হল্মডেল, নিউ জার্সি। রবার্ট উইলসন আর আরনো পেনজিয়াস তখন হর্ন রিফ্লেক্টর নামে বড় একখানা অ্যান্টেনা নিয়ে আকাশের দিকে তাক করে বসে আছেন। প্রধান উদ্দেশ্য মহাকাশের বিভিন্ন দিক থেকে আসা ক্ষীণ বিকিরণ রাশ্মিগুলোকে দেখা আর উপগ্রহের সাথে যোগাযোগ স্থাপন সংক্রান্ত কিছু গবেষণা করা। আর একইসাথে এটাও দেখা যে মহাশূন্যের তাপমাত্রা কত। তাদের এই অ্যান্টেনাটাই আকাশের বিভিন্ন দিক থেকে আসা নানাধরনের বিকিরণ রশ্মিগুলোকে দেখে আর সেগুলোর তাপমাত্রার হিসেব দেয়। কিন্তু মহাশূন্যের তাপমাত্রা মাপতে গিয়ে বাধল সমস্যাটা। যেমনটা আসার কথা তাপমাত্রা আসছে তার থেকে সামান্য বেশি! অ্যান্টেনা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখা হল। সেই পুরানোদিনের অ্যান্টেনাওলা টিভিতে “”ঝিলমিল ঝিলমিল”” আসলে অ্যান্টেনা বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে যেভাবে দেখা হত যে কোনদিকে অ্যান্টেনার মুখ রাখলে পরিষ্কার ছবি দেখতে পাবো, অনেকটা সেই কায়দায়। কিন্তু নাহ! ফলাফলের কোন হেলদোল নেই। যে সামান্য বেশি তাপমাত্রা ধরা পরেছে তা এতটাই নগণ্য যে সেটা যেকোন ছোটখাট কারণেও আসতে পারে। এমনকি অ্যান্টেনাতে বসে থাকা কোন পাখির শরীর থেকেও আসতে পারে। সেসব ব্যাপারও অতি যত্নের সাথে নজরে রাখা হল। কিন্তু কিসের কি! ওই বাড়তি তাপমাত্রাটা এড়ানো গেলনা। এর কোনও যুক্তিযুক্ত কারণও খুঁজে পাওয়া গেল না। এক হতে পারে কোন অজানা অতিক্ষীণ বিকিরণ রাশ্মি, “”মাইক্রওয়েভ রেডিয়েশন”” ( এটা কি জিনিস সে প্রাসঙ্গে আসছি একটু বাদেই ) এসে পরছে অ্যান্টেনায়। তাহলে প্রশ্ন আসে এই অতিক্ষীণ বিকিরণ রাশ্মি আসছে কথা থেকে? যেহেতু আকাশের সবদিক থেকেই সমানভাবে আসছে সুতরাং এ যে কোন তারা বা অন্য কোন মহাজাগতিক বস্তু থেকে আসছেনা এটুকু জোর দিয়েই বলা যায়। উইলসন আর পেনজিয়াসের কপালে পড়ল ভাঁজ। সত্যি তো, তাহলে কি কোন অজানা অতিক্ষীণ বিকিরণ রাশ্মিই অতিনগণ্য অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণ, যা কিনা পুরো মহাকাশ জুড়ে সমানভাবে ছড়িয়ে আছে!
ওদিকে তখন “”মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব”” নিয়ে বিজ্ঞানীমহল খুব উৎসাহিত! এই তত্ত্বটা আবার বেশ মজার, যাতে মনে করা হয় যে আজ থেকে প্রায় ১৩৭৭ কোটি বছর আগের একটা মহাবিস্ফোরণে এই বিশ্বব্রম্হাণ্ডের সৃষ্টি। এই তত্ত্বে এটাও বলা হচ্ছে যে “”সময়”” বলতে যে জিনিসটা বুঝি তারও নাকি উৎপত্তি এই বিস্ফোরণের সময়ে। তবে হ্যাঁ, এই বিস্ফোরণ কিন্তু বোমা বিস্ফোরণের থেকে এক্কেবারেই আলাদা। কি ভীষণ জটিল ব্যাপার! তার ওপর আরও সমস্যা হল বিজ্ঞানীরা তখনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখাতে পারেননি যে তাদের এই তত্ত্ব আদৌ সত্যি কিনা! তবে, আশার আলো আছে একটা। পাতার পর পাতা অঙ্ক কষে অন্তত এটুকু বোঝা গেছে যে এই সবকিছু প্রমাণ করতে চাই শুধু একটা ছবি। মহাবিশ্বের ছোটবেলার ছবি।
এবারে আসা যাক ছবি প্রসঙ্গে। ব্যাপারটা হল, বিজ্ঞানীদের এই বিস্ফোরণ তত্ত্বটা যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে বিস্ফোরণের ঠিক পরের মুহূর্তে হিসেবমত ব্রম্হাণ্ডের তাপমাত্রা ভয়ঙ্কর রকমের বেশি হওয়ার কথা। তা প্রায় কোটি কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অতি গরমের চোটে আলোর কণা আর পদার্থের কণা মিলেমিশে একাকার কাণ্ড! সবকিছু মিলিয়ে একটা উত্তপ্ত মণ্ড তৈরি হয়ে আছে। এখানে এটা বলে রাখা জরুরী যে এই মণ্ডটা থেকেই কিন্তু পরে তারা, গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু, নীহারিকা, নক্ষত্রমণ্ডল ইত্যাদি ইত্যাদি, যা যা জানি, সবকিছুই জন্ম নেবে। এখনকার মত আলো তখন নিজের ইচ্ছেমত স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারত না। আর ঘুরবেটাই বা কী করে! আরে বাবা ফাঁকা জায়গা বলে তো কিচ্ছু নেই তখন! সবটাই কেমন পাঁচমেশালি ঘণ্টের মত হয়ে আছে। আলোর পালাবার পথ নেই। তার কয়েক হাজার বছর পর পরিস্থিতি যখন অনেকটা ঠাণ্ডা, প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি, মণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় দলা পাকিয়ে তারকাপুঞ্জ তৈরি হতে শুরু করেছে। ফলবশত তৈরি হয়েছে বেশ খানিকটা খালি জায়গা। ওই জলওলা তরকারিকে অনেকক্ষণ কড়াইতে ঘাঁটলে যেমনটা দলা পাকিয়ে ওঠে আর কড়াই এ অনেকটা খালি জায়গা তৈরি হয়, ব্যাপারটা খানিকটা সেরকমই। আর এই খালি জায়গা পেয়ে আলোর হয়েছে মহা আনন্দ! আলো এখন স্বাধীন। ব্রম্হাণ্ডের জন্মের সময়ে জন্ম নিয়ে এই আলোগুলো মহাবিশ্বের খালি জায়গায় ছুটতে শুরু করল। এবং আজও ছুটে চলেছে। আর সাথে নিয়ে চলেছে এক অজানা রহস্য। বিশ্বব্রমহাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য।
তারপর কেটে গেছে কোটি কোটি বছর। ওই সুপ্রাচীন আলোগুলো ঠাণ্ডা হয়েছে আর মহাকাশ জুড়ে সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। এরা এখন এতোটাই ঠাণ্ডা হয়েছে যে এদের আর সাধারণ আলোর পর্যায়েও ফেলা যায় না। সূর্যের আলো, বৈদ্যুতিক আলো এসবের থেকে সে এখন এক্কেবারে আলাদা, আর অনেক অনেক ঠাণ্ডা। বর্তমানে এদের তাপমাত্রা -২৭০.৪২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এখন এদের খালি চোখে দেখার উপায় নেই! আর চোখে দেখতে পাইনা বলে এদের আর আলো না বলে শুধু বিকিরণ রশ্মি বলাই ভালো। এখানে একটু বলে রাখি যে এই বিশ্বে অনেক ধরনেরই বিকিরণ রশ্মি আছে। তাদের মধ্যে যাদের তাপমাত্রা মোটামুটি ভাবে ১.৬৮৭-২.৫৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাদেরকেই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই আর আলো বলে ডেকে থাকি। আর এই আদ্যিকালের বিকিরণ রশ্মি তো এর চেয়ে অনেক অনেক ঠাণ্ডা। অতএব দেখতে পাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তবে এইধরনের ঠাণ্ডা বিকিরণ রশ্মিরও নাম আছে। বিজ্ঞানীরা এরকমের বিকিরণ রশ্মিগুলোকে মাইক্রওয়েভ রেডিয়েশন বলে ডাকেন – আমাদের গল্পের শুরুতেই যার নাম একবার নেওয়া হয়েছে (এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে বিকিরণ রশ্মিরই ইংরেজি নাম হল রেডিয়েশন)। আর এই অতিরহস্যময় বিকিরণ রশ্মির নাম দেওয়া হয়েছে “”কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন””। অতিপ্রাচীন অতিঠাণ্ডা এই ক্ষীণপ্রায় রশ্মিই মহাবিশ্বের ছোটবেলার ছবির তথ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন কেউ বলতেই পারে যে, আরে বাবা বিকিরণ রশ্মি খামোখা ছবি নিয়ে ঘুরতে যাবে কেন? ব্যাপারটা কিন্তু আদতে খুবই সোজা। ক্যামেরাতে যখন আমরা একটা গাছের ছবি তুলি তখন গাছ থেকে প্রতিফলিত হয়ে বেরিয়ে আসা আলোকরশ্মি ক্যামেরায় এসে পরে বলেই গাছের ছবিটা দেখতে পাই। আরো সোজা করে বললে সূর্য থেকে আলো আমাদের চোখে এসে পরে বলেই সূর্যকে দেখতে পাই। এখানেও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে যে – সবই তো বুঝলাম কিন্তু গাছ, সূর্য এগুলো তো আছে তাই তাকে দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যে জিনিসটার অস্তিত্বই এখন আর নেই তা দেখব কিভাবে? এইটি বোঝাতে অমি সূর্যের উদাহরণটা আবার টানব। স্কুলে ভূগোল বইয়ে পড়েছি যে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলোর আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। আর আগেই বললাম যে যখন সূর্য থেকে আলো এসে চোখে পড়ে তখনই সূর্যকে দেখতে পাই। তাহলে এই দুটো তথ্য একসাথে জোড়া লাগালে দাঁড়ায় যে সূর্য ওঠার ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড পরে সূর্যকে দেখতে পাই। আর একটু অন্যরকমভাবে বললে বলা যায় আমরা যখন আকাশে সূর্য দেখি তা আসলে সেই মুহূর্তের নয়, তার থেকে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগের সূর্যের ছবি। সূর্য তো তাও আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা। এমন অনেক তারা আছে যা থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লেগে যায় কয়েক লক্ষ বছর। এমন কান্ডও হয় যে আলো কোনো তারা থেকে পৃথিবীতে আসতে এতটা সময় নিয়েছে যে ততোদিনে সেই তারাটাই ধ্বংস হয়ে গেছে, অথচ এখন রাতের আকাশে তারাটিকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি! তার মানে রাতের আকাশে এমন অনেক তারাই দেখি যারা আসলে এখন আর নেই! তেমনই অতিপ্রাচীন এই রশ্মিগুলো যেগুলো ব্রম্হান্ডের জন্মের সময়ে বেরিয়ে এসেছিল সেগুলোকে অ্যান্টেনাতে ধরতে পেলেই দেখতে পারব যে কোটি কোটি বছর আগে, প্রায় জন্মলগ্নে ব্রম্হান্ডটা ঠিক কেমন ছিল, যদিও সেসময়কার ব্রম্হান্ডের অস্তিত্ব এখন আর নেই।
এবারে ফিরে আশা যাক আমাদের মূল গল্পে, ১৯৬৪ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের দল হন্যে হয়ে “”মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব”-এর প্রমাণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। চলছে এই বহুমূল্যবান ছবির খোঁজ। অঙ্ক কষে এই ছবির অস্তিত্বের কথা যাঁরা যাঁরা বলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবার্ট ডিকি। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড টড উইলকিলসন ও পিটার রোল ছিলেন ডিকির অন্যতম সহকর্মী। তাঁরাও আছেন এই খোঁজে। তৈরি করে ফেলেছেন একটা অ্যান্টেনা। শুধু ওই বিকীর্ণ রশ্মি একবার দেখার আশায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেরকম কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। এমন সময় বেল টেলিফোন ল্যাবোরেটরী থেকে একটা কল এলো। ফোনটা ধরলেন ডিকি। উইলসন আর পেনজিয়াস জানালেন যে তারা তাদের অ্যান্টেনা থেকে কিছু আপ্রয়োজনীয় বিকীর্ণ রশ্মির খোঁজ পেয়েছেন। যেগুলো খুব ঠাণ্ডা। আকাশের যেকোনো দিকে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে তাঁরা দেখেছেন যে সবদিক থেকেই সমানভাবে এগুলো আসছে, অর্থাৎ মহাকাশ জুড়ে সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। ডিকি বুঝলেন এতদিন ধরে তাঁরা যে খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তার সন্ধান পাওয়া গেছে। দুঃখের ব্যাপারটা হল তাঁদের আগেই উইলসন আর পেনজিয়াস এই বহুমূল্যবান ছবির খোঁজ পেয়ে গেছেন। ডিকি ফোন রেখে সহকর্মীদের বললেন “”boys, we have been scooped!”*
নিজেদের অজান্তেই উইলসন ও পেনজিয়াস আবিষ্কার করে ফেললেন “”কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন”” সোজা ভাষায় ব্রম্হাণ্ডের ছোটবেলার ছবি। আরও ১৪ বছর ধরে অনেক বিজ্ঞানীর দল বারবার করে পরীক্ষা করে এই আবিষ্কারের সত্যতা নিশ্চিত করলেন। ১৯৭৮ সালে উইলসন ও পেনজিয়াস পেলেন নোবেল পুরষ্কার। প্রমাণিত হল “”মহাবিস্ফোরণ” আসলে একটি সত্যি ঘটনা, বিজ্ঞানীদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত আকাশকুসুম কল্পনা নয়। খুলে গেল পদার্থবিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা, কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব ।
*বিজ্ঞানীমহলে কোন গবেষক কোন নতুন তথ্য খোঁজার প্রতিযোগিতায় অন্য গবেষকের কাছে হেরে গেলে “”scooped”” কথাটা বলে থাকেন।
এলেবেলের দলবল