কলমে এলেবেলে প্রত্যয়
সাইরাকিউসের সাথে রোমের যুদ্ধ। রোমের জিত, সাইরাকিউসের হার। যুদ্ধ শেষ। এবার শুরু হবে লুঠ তরাজ। সেই উদ্দেশ্যে সাইরাকিউসের পথে চলেছে এক সৈনিক। যুদ্ধের বিভীষিকার কিছু চিহ্ন এখনো তার শরীরে। তবে, চোখে মুখে লেগে আছে বিক্রমের হাসি। সে চলছে শহরের অভিমুখে। হঠাৎ দেখে, রাস্তায় এক দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মাটিতে বসে আঁক কষছে আর কি সব বিড়বিড় করছে। পোশাক আশাক নোংরা বিক্ষিপ্ত। এক কথায় পাগল না ভাবার কোনো কারণ নেই। বুড়োর কাছে আবার কতকগুলি যন্ত্রপাতি। সেই দিয়ে মাঝে মাঝেই আবার ছবি আঁকছে। বৃত্ত, সরলরেখা, বর্গক্ষেত্র। সৈনিকের নজর সেদিকে নেই। তার নজর ওই চকচকে ধাতব যন্ত্রের ওপর। ওগুলো তার চাই। অতএব, শুরু হলো ঝগড়া-ঝাটি, বাগ-বিতন্ডা। যদিওবা বুড়ো যন্ত্রপাতি দিতে রাজি হলো, কিন্তু রাস্তা সে কিছুতেই পেরোতে দেবে না। তার দাবি রাস্তা পেরোতে দিলে তার সাধের অঙ্ক আর ছবি নাকি বিগড়ে যাবে। বলে “”অতো তাড়া কিসের হে? তুমি দাঁড়াও! খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্ক করছি। আমাদের (মানে আমাকে আর আমার অঙ্ককে) বিরক্ত করো না। অঙ্ক শেষ হলে চলে যাবে।”” এতটা ঔদ্ধত্য সৈনিকের আর সহ্য হলো না। “”তোর রাজ্যকে একটু আগে যুদ্ধে একদম কচুকাটা করেছি। আর তুই কিনা আমাকে দাঁড়াতে বলিস!”” ব্যাস! ঘ্যাচাং। পড়ে রইলো শুধু বৃত্ত।
ঘটনাটা হয়তো এরকম হয়নি। পুরোটাই কল্পনাপ্রসূত। তবে এক সৈনিক যে সেদিন এক বুড়োকে মেরেছিলো সেটা সত্যি। সৈনিককে ইতিহাস মনে রাখেনি। সে হয়তো অনেক সম্পদ লুঠ করেছিল সেদিন। কিন্তু যে বুড়ো সেদিন মরেছিল, তাঁকে আমরা সকালেই জানি। তাঁর নাম আর্কিমিডিস। হ্যাঁ, উনি সেই লোক, যিনি স্নানাগার থেকে ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে লাফাতে লাফাতে রাজদরবারে পৌঁছে গেছিলেন। সম্পূর্ণ নগ্ন। প্লবতা আবিষ্কার হয় সেই দিন। আর আজ ছিল সেই দিন যেদিন ওনার π (পাই) এর মান নির্ণয় থেকে গেলো অসমাপ্ত। তবে কাজ ওনার অনেকটাই এগিয়ে গেছিলো। বাধ সাধলো এই আকাট মূর্খ সৈনিক, আর, আরও একটা জিনিস। সেটা বলবো। তার আগে π এর পাঁচালি গেয়ে নি। আর্কিমিডিসের মতো গণিতজ্ঞরা (গ্রীস, ভারত, চীন ইত্যাদি জায়গার) বুঝেছিলেন যে যেকোনো বৃত্তের পরিধি আর তার ব্যসের অনুপাত হলো সর্বদা একই, তা বৃত্ত বড় হোক বা ছোট। এই অনুপাতটির নাম পরে হয়েছিল π। অনুরূপ, তাঁরা এটাও বুঝতে পারলেন যে বৃত্তের ক্ষেত্রফল আর বৃত্তের ব্যাসার্ধের বর্গের অনুপাতও ওই একই π। বুঝতে পারলেও π এর সঠিক মান নির্ণয় ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। অনেকেই বৃত্তের পরিধি বরাবর, আর ব্যাস বরাবর সুতো বসিয়ে, পরিধি আর ব্যাস মেপে π এর মান বের করার চেষ্টা করলেন। হিসেবে বললো π এর মান ৩ এর থেকে একটু বেশি। কিন্তু, সুতো বসিয়ে মাপা বেশ চাপের ব্যাপার, কারণ সুতো একটু এপাশ ওপাশ হলেই মাপের ভুল হয়। তাই, আর্কিমিডিস নিলেন অন্য পন্থা। উনি বললেন, ‘আমি একটা আনুমানিক মান বের করবো।’ উনি একটি বর্গক্ষেত্র আঁকলেন যার বাহুগুলি বৃত্তকে স্পর্শ করে। এরপর আর একটি বর্গক্ষেত্র আঁকলেন যার শীর্ষগুলি বৃত্তকে স্পর্শ করে (চিত্র ১(ক))। বৃত্ত অপেক্ষা বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল বের করা অনেক সোজা। উনি বললেন এই দুই বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের গড় হলো বৃত্তের আনুমানিক ক্ষেত্রফল। সেখান থেকে π এর মান বের করলেন ৩। পছন্দ হলো না। উনি বুঝলেন আরো সঠিক ভাবে জানান করতে হবে। বর্গক্ষেত্র পাল্টে করলেন ষড়ভুজ (চিত্র ১(খ))। কিন্তু ষড়ভুজ কেন? আরো বেশি ভুজ নেবো না কেন? বাড়তে থাকলো ভুজের সংখ্যা, চলতে থাকলো অঙ্ক (চিত্র ১(গ))। ৯৬ বাহুযুক্ত বহুভুজ অব্দি উনি অঙ্ক কষে বের করে ফেললেন। ওনার গণিত বলেছিলো π এর মান ২২৩/৭১ এবং ২২/৭ এর মধ্যে। এই আনুমানিক মান ২২/৭, আজও π এর মান হিসেবে বহুল প্রচলিত। কিন্তু, আর্কিমিডিস কে ৯৬ তে থামতে হলো কেন? এর আগেও তো এগোনো যেত। উনি অনেক রকম কসরত করলেন। কিন্তু, হল না। কারণ, এক, ওই সৈনিক, আর দুই, ওনার ব্যবহৃত রোমান সংখ্যা পদ্ধতি।
π এর মান ২২৩/৭১ এবং ২২/৭ এর মধ্যে
রোমান সংখ্যা পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি জানি। ছেলেবেলার থেকেই বুড়ো দাদু ঘড়িতে দেখেছি আমরা সেই সব সংখ্যা। ১ থেকে ১২। তার আগে দেখিনি সেটা ভাগ্যের, কারণ ব্যাপারটা বেশ জটিল। I, II, III, .. এই ভাবে চলে রোমান সংখ্যা। ১২ হোল XII, ২০ হোল XX, ৩৮ হোল XXXVIII। ৫০ আবার হয়ে গেল L। ৮৮ হোল LXXXVIII। ১০০ হোল C, ৫০০ D, আর ১০০০ হচ্ছে M। মনে রাখাটাই বেশ গোলমেলে ব্যাপার, তারপর আবার এই সংখ্যা নিয়ে গুন যোগ ভাগ। সাথে বিষফোঁড়া আছে বর্গফল আর বর্গমূল। স্বভাবতই, আর্কিমিডিসকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল এই সংখ্যা পদ্ধতি। প্রাণ যেতে তবে নিস্তার।
এরপর কেটে গেল কয়েকশ বছর। নবম শতাব্দীর এক পড়ন্ত বিকেলে কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছল সুদূর আরব দেশ থেকে আসা এক জাহাজ। জাহাজ থেকে নেমে এলো জামশিদ। এক মশলা ব্যবসায়ী। এই প্রথম সে এলো তার দেশের বাইরে| বাজারে ঘুরতে ঘুরতে তার নজর গেলো অন্ধকের দিকে। দেখল সে অবলীলায় করে চলেছে বড় বড় অঙ্ক। সংখ্যাগুলো আলাদা দেখতে। কিন্তু মোটে ১০ টা। আর তাই দিয়ে অন্ধক হাজার, লাখের হিসেব করে চলেছে। জামশিদ যে সংখ্যা পদ্ধতি জানে তা ঐ রোমান আর তার নিজের জায়গার একটি। দুটো প্রায় এক। রোমানরা I,V,X,L,M,C,D ব্যবহার করে, জামশিদরা সাপ, ব্যাং, ফুল, লাঠি, মানুষ, এসবের ছবি ব্যবহার করে। কিন্তু, অন্ধকের অঙ্ক তো পুরো আলাদা। জামশিদ অন্ধককে বলল “”শেখাবে?” সে এক কথায় রাজি। জানল অন্ধক কেবল ১০টা সংখ্যা ব্যবহার করে। ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, আর ০। “”০! সেটা কি?” জামশিদের প্রশ্ন। অন্ধক জানাল “”এর দাম কিছু নাই। কিন্তু ব্যবহার হয় স্থান ধারাক হিসেবে। ধর তুমি লিখবে বারো। ১২। এবার লিখবে একশদুই। ১০২।” জামশিদ অবাক। আগে যা পরিশ্রম করতে হত, এতো তার সিকি ভাগও নয়। সাপ, ব্যাঙ, ফুল, পাতা এঁকে অঙ্ক কষার থেকে এতো অনেক সোজা। ভাল করে খুঁটিয়ে জেনে নিলো সে সেই সংখ্যা পদ্ধতি। এও জানল যে প্রায় পাঁচশ বছর আগে আর্যভট্ট নামে এক খুব বড় মাপের গণিতজ্ঞ এই ‘০’ আবিষ্কার করে সকলের জীবন সহজ করে দিয়েছেন। এই আর্যভট্ট নিজে π এর একটি আনুমানিক মানও বের করেছিলেন। জামশিদের সাথে অন্ধকের বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল সেদিন। কালিকটে এলেই জামশিদ গিয়ে পৌঁছত অন্ধকের কাছে। দেশ বিদেশের গল্প নিয়ে। জামশিদ দেশে ফিরে বলতে শুরু করল এই অদ্ভুত সংখ্যা পদ্ধতির কথা। কেউ কেউ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করল বটে, তবে বেশ প্রচার পেল। অনেকে ব্যবহার করাও শুরু করল।
ফিবনাচি হাত ধরেই ইউরোপে এলো আর্যভট্ট আবিষ্কৃত সংখ্যা পদ্ধতি।
কেটে গেলো আরও দুশতক। স্থান আলজিরিয়ার এক বাজার। বাজারে দোকান দিয়েছে সুদূর ইতালি থেকে আসা এক ব্যবসায়ী। সাথে তার কিশোর ছেলে ফিবনাচি। কেনা বেচায় তার বিশেষ মন নেই। চরকির মতো পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। বাজারে সকলে ওকে বেশ সম্ভ্রমের চোখেই দেখে। বাবার বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। হঠাৎ ফিবনাচির চোখ গেলো উমিদের দিকে। উমিদ একজন স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী| একদম জামশিদের যা অবস্থা হয়েছিল, এখন ফিবনাচির সেই অবস্থা। একি নতুন গণনা পদ্ধতি! চিনা রেশম ব্যবসায়ী উং লিকে সে দেখেছিল একধরনের যন্ত্র নিয়ে দ্রুত হিসেব করতে। কাঠের ফ্রেমে সুতো দিয়ে বাঁধা অনেক পুঁতি সে যন্ত্রে। কিন্তু উমিদ তো হাতেই তা করে ফেলছে। যেহেতু, জানার ক্ষেত্রে লঘু-গুরু বলে কিছু হয় না, তাই পরের শব্দ যা উমিদ শুনল তা হোল “”শেখাবে?” চামড়া বিক্রি উঠল মাথায়। ফিবনাচির মনে আক্ষেপ এ জিনিস সে আগে দেখেনি কেন। কতো কি করে ফেলতে পারত সে?
ইতিহাসটা হয়ত ঠিক এরকম। আবার হয়ত অনেক আলাদা। কেউ জানে না। তবে ঘটনাটা এই যে সুদূর ভারতে আবিষ্কৃত এই সংখ্যা পদ্ধতি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো। তবে আর্যভট্ট আর ফিবনাচি দুজনেই সত্যি। ফিবনাচি হাত ধরেই ইউরোপে এলো আর্যভট্ট আবিষ্কৃত সংখ্যা পদ্ধতি। রোমান সংখ্যা পদ্ধতি ছেড়ে লোকে বেছে নিলো এই নতুন পদ্ধতি। বিজ্ঞান, গণিত করা হয়ে উঠল আরও সোজা। আর ৯৬ বাহুযুক্ত বহুভুজে থেমে থাকা নয়। যতদূর যাওয়া যায় ততদুর। পারলে π এর একদম সঠিক মান বের করে ফেলা। চেষ্টা চলল। ১০০, ২০০, ৫০০ দশমিক স্থান অব্দি πএর মান জানা হয়ে গেলো।
নিউটন আর লেবনিজের হাত ধরে আসা কলনবিদ্যাও স্বাধীনভাবে প্রমাণ করল যে π অমূলদ
গোল বাঁধালেন ফরাসি গণিতবিদ জোহান হেনরিক লাম্বার্ত। সেটা ইংরেজি ১৭৬১ সাল। ত্রিকোণমিতির সাহায্যে প্রমাণ করে দিলেন π একটি অমূলদ সংখ্যা। অমূলদ মানে এমন সংখ্যা যার কোনও দশমিক স্থানেই শেষ নেই। আবার কোনও বিন্যাসের পুনরাবৃত্তিও নেই। অর্থাৎ, ওকে দুটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হিসেবে লেখা যায় না। মজার কথা হল, যে π এর সংজ্ঞাতেই তো অনুপাত আছে। π তো বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত। অর্থাৎ, এদের একটিকে যদি দুটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হিসেবে লেখা যায়, তবে অন্যটিকে কোনভাবেই ওইভাবে লেখা সম্ভব নয়। π অমূলদ। কেউ যদি বলে π এর মান ২২/৭, সে ভুল বলছে কারণ ২২/৭ একটি অনুপাত। কেউ যদি বলে ৩.১৪, তাও ভুল কারণ ৩.১৪=৩১৪/১০০। আরও আগে গিয়ে কেউ যদি বলে π=৩.১৪১৫৯২৬৫, তাও চলবে না কারণ ঐ একই, ৩.১৪১৫৯২৬৫=৩১৪১৫৯২৬৫/১০০০০০০০০। নিউটন আর লেবনিজের হাত ধরে আসা কলনবিদ্যাও স্বাধীনভাবে প্রমাণ করল যে π অমূলদ। অতএব যা দাঁড়াল তা হল, এতো গণিত করে, জ্যামিতি করে, প্রাণ অবধি দিয়ে গণিতজ্ঞরা যা π এর মান বের করলেন, তা আর যাই হোক π নয়। তার একটি আনুমানিক মান মাত্র। আজকের দিনে π এর দশমিকের পর প্রায় ১০ লক্ষ স্থান অব্দি মান আমাদের জানা। সেটা সম্ভব হয়েছে আর্কিমিডিসের পথে বা তার সমতুল কোনও পদ্ধতিতে। কম্পিউটার ব্যবহার হয়েছে। পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যাদের πএর মান ৭০০০০ দশামিক স্থান পর্যন্ত মুখস্থ। কিন্তু তার পরও তা π নয়। π এর এই মজার গুণের কারণে মানুষ কোনদিনই πএর সঠিক মান জানতে পারবে না। তা সম্ভব নয়। অথচ বিজ্ঞান, অঙ্ক, রাশিশাস্ত্রের সব জায়গায়, π এর অবাধ বিচরণ। এমন এমন জায়গাতেও π খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে বৃত্তের সাথে কোনও সংযোগই নেই। এই কারণেই বোধ হয় π বিজ্ঞানের পাতার বাইরেও সমান জনপ্রিয়। বিজ্ঞানে অবশ্য π কে টেক্কা দিতে পারে এমন আরেক জন আছে। সেটি হল e। সে গল্প আজ থাক। পরে একদিন হবে। যাওয়ার আগে আর একটা ছোট π সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে যাই। π কে সবদিন π দিয়ে লেখা হতো না। এটা জনপ্রিয় করেন সুইস গণিতবিদ লিওনার্দ অয়লার (১৭০৭ – ১৭৮৩)। এই π আর e দুটিকে ব্যবহার করেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন পৃথিবীর ‘সব থেকে সুন্দর সমীকরণ।’
এলেবেলের দলবল
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।