~ কলমে এলেবেলের অতিথি শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় ~
আমার এক পরিচিত স্মার্টফোনকে কখনোই স্মার্টফোন বলে ডাকতেন না। এখনো বোধ করি ডাকেন না। সেটা যুক্তাক্ষর সমন্বিত নাম বলে, নাকি শুধু ভুলে যেতেন বলে, সে রহস্য আজও ভেদ করতে পারিনি। তিনি স্মার্টফোনকে বলতেন ‘টানা ফোন’, আর ফিচার ফোনকে বলতেন ‘টেপা ফোন’! আরেকটু প্রবীণ ব্যক্তি যাঁরা, তাঁরা অনেকেই বলেন, বড়ো ফোন আর ছোটো ফোন! তা ‘টানা ফোন’ কেন বলেন, সেটা বোধকরি আপনিও সহজেই অনুমান করতে পারছেন। আসলে আপনিও তো দস্তুরমতো টানাটানি করেই এই লেখাটা এই পর্দায় পড়তে পারছেন, তাই না? উপরে, নীচে, ডাইনে, বাঁয়ে যতবার টেনে গেছেন এই পর্দার উপর দিয়ে, ততবার আপনার আঙুল থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে (আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি নিজেই একটা আস্ত ইলেকট্রিক যন্ত্র, বিশ্বাস না হয় নিজের হৃদয়কে জিজ্ঞেস করুন) আছড়ে পড়েছে একরকম যৌগিক পদার্থের কেলাসে। পর্দার উপরে আলাদা করে এ কেলাস দেখতে পাবেন না! কারণ, এটা স্বচ্ছ। আপনার আঙুলের ইলেকট্রনটা ঐ স্বচ্ছ কেলাসের ভেতর এদিক ওদিক যেতে পারে, মানে, কেলাসটা শুধুই স্বচ্ছ নয়, তড়িতেরও পরিবাহী। আবার এর তলায় আছে বিদ্যুতের তারের টানা আর পোড়েন, যেমনি কাপড়ের সুতো থাকে আর কি! আপনি যখন আঙুল ছোঁয়ান নি, তখন ব্যাটারির দৌলতে এগুলোর ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন দৌড়াদৌড়ি করছিলো। যেই আপনি কোনোখানে আঙুল ছুঁয়ে টানলেন, অমনি সেখানকার নীচের টানা তারের ভেতরে এই ইলেকট্রনিক দৌড়াদৌড়ি বাধা পেলো আর সেটা অনুভব করলো তার নীচের পোড়েন তারটা! তারপর আর কি, সে ফোনের মাথা অর্থাৎ প্রসেসরে বার্তা পাঠালো, ‘খোকাকে গিয়ে বল, মালিক এসচে!’ সেইমতো আপনি আপনার ফোনের লক খুলে উপরে টেনে ডেটা অন করে ফেসবুক খুলতেই এই অধমের লেখাটা দেখে স্ক্রোল করতে করতে নীচে নামলেন। ঠিক বলেছি কিনা?
আজ্ঞে সেটা বুঝতে গেলে একটু টাইম মেশিন চড়ে আঠারোশো ষাটের ইউরোপ মহাদেশে সালে পৌঁছাতে হবে কত্তা!
না আপনাকে অবশ্য আর বেশি নীচে নামতে দেবো না। আসলে ঘটনাটা হচ্ছে, এই যে স্বচ্ছ কেলাসের দৌলতে আপনি আপনার ফানসিক (আজ্ঞে মন থেকে মানসিক হলে ফোন থেকে ফানসিক, নিদেনপক্ষে fun sick হবে না কেনো?) স্মার্টনেস দেখাচ্ছেন, সেটার নামের সাথে ভারতবর্ষ আর নীলচাষ প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িত। কিভাবে? আজ্ঞে সেটা বুঝতে গেলে একটু টাইম মেশিন চড়ে আঠারোশো ষাটের ইউরোপ মহাদেশে সালে পৌঁছাতে হবে কত্তা! গন্তব্য? ঐ জার্মানি সেট করুন!
এ জিনিস ও জিনিস ঘেঁটে, তারা আদপে কি দিয়ে তৈরি সেটা জানার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন। এই করতে করতে নানা মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার হয়েছে। ১৮৬০ সালের আগে এইসব আবিষ্কার করতে কত না রাসায়নিক পদার্থ লেগেছে! এর সাথে ওকে মিশিয়ে, তাকে ফুটিয়ে, সেই বাষ্প ঠান্ডা করে, একে গলিয়ে, তাকে দ্রবণ থেকে পাত্রের তলায় ফেলে, সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড মশাই! এসবে জিনিসের পরিমাণটাও লাগে গাদা গাদা, আর খরচাও প্রচুর, বিস্ফোরণ-টিস্ফোরণ তো লেগে আছেই! এমনি সময় জার্মানির রসায়নবিদ রবার্ট বুনসেন আর তাঁর পদার্থবিদ বন্ধু গুস্তাভ কার্শফ আবিষ্কার করে ফেললেন একটা দারুণ যন্ত্র। একটা প্রিজমের দুইধারে ছোট্ট দুখানি টেলিস্কোপ, তারা একে অন্যের সাপেক্ষে এদিকে ওদিকে গোল করে ঘুরতে পারে। তার একদিকে বুনসেন রাখলেন তাঁর আবিষ্কার, সেই বুনসেন বার্নার—সিনেমায় কেমিস্টদের যাতে আপনারা টেস্টটিউব ধরে ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করতে দেখে থাকেন! ইতিহাসে তার ব্যবহার আলাদা। ঐ আগুনের পরশমণিতে একেক অজানা পদার্থ ছুঁইয়ে ধরে এধারে টেলিস্কোপ দিয়ে তার আলো দেখলে দেখা যায় বারকোডের মতো আলোর রেখা, একেবারে হনুমানে খাওয়া খাওয়া বেনীআসহকলা আর কি (অনেক পরে মানুষ জানবে ঐ হনুমান আসলে পদার্থের পরমাণু)! এক এক মৌলিক পদার্থের এক এক রকম বারকোড প্যাটার্ন। ব্যস্! আর ঐরকম একে অন্যের মধ্যে মেশানোর হাঙ্গামা নেই। প্যাটার্ন অন্যরকম পেলেই, ইউরেকা! নতুন মৌল!! ঠিক যেন, ছোট্ট টিপ, হাল্কা লিপস্টিক, আর যামিনী শাড়ি! একটু গুঁড়ো, হাল্কা আগুন, আর শিখার রঙ!
এমনি সময় জার্মানির রসায়নবিদ রবার্ট বুনসেন আর তাঁর পদার্থবিদ বন্ধু গুস্তাভ কার্শফ আবিষ্কার করে ফেললেন একটা দারুণ যন্ত্র।
বুনসেন আর কার্শফ তো নিজেরাই আবিষ্কার করলেন বেশ কয়েকটা মৌল। এর বছর তিনেকের মধ্যেই ঘটলো সেই ঘটনাটা। জার্মানিতে ফ্রিবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে আধুনিক ধাতুবিদ্যা প্রযুক্তিশিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন পীঠস্থান। সেখানে কাজ করতেন বিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ রাইখ। ধাতুর নানা রকম আকরিক থেকে নতুন নতুন ধাতু বার করার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন তিনি। বুনসেন কার্শফের যন্ত্রটা সেসময় খুব জনপ্রিয়। আগুনের শিখার রঙ আর টেলিস্কোপে রঙিন বারকোড দেখে, বিশ্লেষণ করে ধাতু শনাক্ত করতে হবে। যে সময়ের যা রেওয়াজ আর কি! মুশকিল হচ্ছে, রাইখ আসলে বর্ণান্ধ! কী করে তিনি রঙ চিনে বিশ্লেষণ করবেন?
সমস্যার সমাধান হলো একজন বন্ধুর মাধ্যমে। তিনিও একই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী, নাম হিয়েরোনিমাস থিওডোর রিখটার। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তিনি দেখে দিতেন রঙের ব্যাপারটা। তখন জিঙ্কের এক খনির চারপাশে থ্যালিয়াম নামে একটা নতুন ধাতব মৌলের লবণ পাওয়া গেছে, তবে খুবই কম পরিমাণে। মৌলদের সব তো আর সোনা, রূপোর মতো একা পাওয়া যায় না, বেশিরভাগ মৌলই আসলে তার লবণের মাধ্যমে প্রকৃতিতে লুকিয়ে আছে, কেউ কম, কেউ খুব কম, কেউ বা বেশি। তা থ্যালিয়ামের এই লবণটা আগুনের শিখায় কচি কলাপাতার মতো সবুজ রঙ দেয়। গ্রীক ভাষায় ‘থ্যালোস’ মানে সবুজ কচিপাতা বা গাছ কিনা, তাই থেকে ‘থ্যালিয়াম’। জিঙ্কের আরেক আকরিক নিয়ে তার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেলো একরকম হলুদ পদার্থ। তার মধ্যে থ্যালিয়াম মৌল আছে কিনা দেখতে গিয়ে রিখটার দেখলেন, আরেন্না! এটা তো থ্যালিয়ামের মতো সবুজ রঙের আলো নয়, বরং আকাশি নীলচে-বেগুনী রঙের আলো দিচ্ছে। আর টেলিস্কোপে দেখলে এর রঙিন বারকোডের প্যাটার্নটাও আর সবের থেকে অনেক আলাদা। নিশ্চয়ই এটা নতুন কোনো মৌলিক ধাতু হবে। বেনীআসহকলার আকাশি নীল অর্থাৎ কিনা ইন্ডিগো (নীলচাষের সেই নীল রঞ্জক) অঞ্চলে উজ্জ্বল রঙিন দাগের উপস্থিতি দেখে রিখটার আর রাইখ এই নতুন মৌলের নাম দিলেন, ‘ইন্ডিয়াম’। ইন্ডিগো নামটাই তো এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ইন্ডিকাম’ থেকে। ‘ইন্ডিকাম’ অর্থ ‘ভারতের’। তাহলে হলো কিনা ভারতীয় ভারতীয় গন্ধ? আজ একুশে নভেম্বর সেই বিজ্ঞানী দুজনের একজন, শ্রী থিওডোর রিখটারের জন্মদিন। ঠিক চারবছর পরেই জার্মানির এই ধাতুবিদের জন্মের দুশো বছর হতে চলেছে!
তাহলে হলো কিনা ভারতীয় ভারতীয় গন্ধ?
রিখটার নিজে ‘টানা ফোন’ ব্যবহার করে যেতে পারেননি। অথচ এই ইন্ডিয়ামের সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন অক্সাইড যৌগে সামান্য টিন (মুড়ির নয়, মৌলিক ধাতু) মিশিয়ে স্যামসাং, অ্যাপল্ কোম্পানি তৈরি করে দিয়েছেন আপনার আমার টানা ফোনের স্বচ্ছ বিদ্যুৎ পরিবাহী পর্দা। দুশো বছরে কোন্ মৌলের ব্যবহার কিসে এসে দাঁড়িয়েছে! আসলে তো নতুন মৌল আবিষ্কারের নেশাতেই ইন্ডিয়ামের জন্ম। তার ব্যবহার যে এই টানা ফোনে এসে দাঁড়াবে সেটা না রিখটার, না রাইখ কারো পক্ষেই জানা সম্ভব ছিলো না। যেমন আমরা আজ জানি না যে আজ থেকে দুশো বছর পরে টানা ফোনের ভবিষ্যতটাই বা কী হবে! এখনই ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইডের কেলাস ছেড়ে মানুষ আরো স্বল্পমূল্যের স্মার্টফোন পর্দা তৈরিতে হাত পাকিয়ে ফেলেছে, শেষটায় স্মার্টনেসের সংজ্ঞা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে!
তথ্যসূত্রঃ Weeks, Mary Elvira (1932). “”The Discovery of the Elements: XIII. Some Spectroscopic Studies””. Journal of Chemical Education. 9 (8): 1413–1434. Bibcode:1932JChEd…9.1413W. doi:10.1021/ed009p1413
চিত্রসূত্রঃ তথ্যচিত্র ‘দ্য মিস্ট্রি অফ এলিমেন্টস’ থেকে ক্ষণিকদৃশ্য, ইন্ডিয়াম ও থ্যালিয়ামের বর্ণালী যেমন দেখা গেছিলো বুনসেন আর কার্শফের যন্ত্রে।
শ্রুতিসৌরভ পেশায় একজন রসায়ন শিক্ষক। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র: প্রাকৃতিক পলিস্যাকারাইড-রসায়ন। সহজ বাংলা ভাষায় সবার বোঝার জন্য বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি লিখে থাকেন।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
লেখাটি পঠিত হয়েছে বার
এলেবেলে – Elebele